Logo
Logo
×

অভিমত

আলী রীয়াজের গবেষণা ও ভোট চোরের বড় গলা

Icon

আহমেদ খিজির

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪, ০৮:০০ পিএম

আলী রীয়াজের গবেষণা ও ভোট চোরের বড় গলা

জনপ্রিয় ওয়েব প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে একটা সিরিজ আছে- দি ডিকটেটর’স প্লেবুক- নামে। এই সিরিজে দেখানো হয়, পৃথিবীর ইতিহাসে নামকরা স্বৈরাচাররা কীভাবে একই ধরনের আচার-আচরণ এবং কৌশল মেনে চলতো। এইসব দানবেরা কীভাবে নিজেদের জনগণের উদ্ধারকর্তা ভাবার দম্ভ দেখাতো। নানাভাবে তাঁদের তাঁবেদাররা তা প্রমাণ করারও চেষ্টা করত। 

সম্প্রতি জাতীয় সংসদে আবারও সেই রুলবুক অনুসরণ করার উদাহরণ দেখা গেলো। সমাজকল্যাণমন্ত্রী দীপু মনি একটি গবেষণার উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক আলী রিয়াজের একটি গবেষণার সমালোচনাই শুধু করেননি, বোঝাতে চেয়েছেন যে, দেশে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হলেও তাঁরা খুশি। 

অধ্যাপক রীয়াজ বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজ নিয়ে বহুদিন ধরে গবেষণা করছেন। তিনি নানা গবেষণায় দেখিয়েছেন কীভাবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র তলানিতে ঠেকেছে। তাঁর গবেষণাপত্র ডেমোক্রেটিক ব্যাক স্লাইডিং ইন বাংলাদেশ” বহুল আলোচিত। স্বাভাবিকভাবেই সরকারি দল উনার ওপর ক্ষিপ্ত। আর ডিকটেটর’স প্লেবুকের শিক্ষা হচ্ছে, এইসব গবেষণা ও গবেষকদের ছোট করে পালটা বক্তব্য হাজির করা।

আমরা যদি হিটলারের শাসনামলের কথা মনে করি, তাহলে দেখতে পাবো হিটলারের দাবিকে সত্য প্রমাণ করার জন্য বিজ্ঞানী, দার্শনিক, গবেষকরা কাজ করতেন। নানা ধরনের তথ্য উপাত্ত দিয়ে তাঁরা বোঝাতে চাইতেন হিটলারের চিন্তাধারা কত সঠিক। সে সময়, নানারকম গবেষণায় দেখানো হতো, জার্মান জাতি কেন প্রাকৃতিকভাবেই শ্রেষ্ঠ আর অন্যরা তাঁদের চেয়ে পিছিয়ে থাকা। ইউজেনিক্স নামে অপবিজ্ঞান দিয়ে রীতিমতো একে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা হতো। নীটশের মতো দার্শনিকের উবারমানস তত্ত্বকে নিজেদের মতো ব্যাখ্যা দিয়ে বলা হতো, আর্যজাতি বাদে বাকিদের মেরে ফেলা জায়েজ। সিনেমার পরিচালকেরা আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রপাগান্ডা চালাতেন, জনগণকে বোঝাতেন হিটলারের শাসন কেন সেরা। যুগে যুগে সব হিটলাররাই হরে দরে এইসব কৌশল ব্যবহার করে। 

তবে দীপু মনি ‘দ্য কিউরিয়াস কেস অব ডেমোক্রেটিক ব্যাক স্লাইডিং ইন বাংলাদেশ: অ্যান অ্যানালাইসিস অব পিপলস ফিন্যান্সিয়াল স্যাটিসফেকশন’ নামে যে গবেষণাপত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে আলী রিয়াজের কাজকে খাটো করতে চাইলেন তা পড়লেই অনেক অসংগতি ধরা পড়বে।

মূলত আলী রীয়াজের কাজটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেই যে এই গবেষণার উদ্দেশ্য তা পাঠকমাত্রই বুঝবেন, আর শিরোনাম খেয়াল করলেই বোঝা যায়, গবেষকদ্বয় ফিন্যান্সিয়াল স্যাটিসফেকশনের যে ব্যাপারটা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন তা ধোঁয়াশাপূর্ণ। গবেষণাপত্রটি পড়তে থাকলে এই ধোঁয়াশা আরো বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে তাঁরা নিজেরাই উল্লেখ করেন মাসলোর হিয়ারারকি অফ নিডস আর রিলেটিভ ডিপ্রাইভেশন থিওরির কথা। 

সহজ ভাষায় মোটাদাগে বললে, এই তত্ত্বগুলোতে দেখানো হয় যে, মানুষ তাঁর চাহিদার ক্রম অনুসারে বিভিন্ন স্তরে বাস করে। কারো কারো কাছে কোনোমতে জৈবিক চাহিদা( খাবার, পানি, ঘুম, পোষাক, আশ্রয়) এই পর্যায়ে টিকে থাকাই লড়াই আবার পর্যায়ক্রমে পঞ্চম স্তরে মানুষ পৌঁছাতে পারে যেখানে সে নিজের সর্বোচ্চ মানবিক ক্ষমতার উন্মেষ ঘটাবে। এর মাঝের স্তরগুলোতে নিরাপত্তা, ভালোবাসা, আত্মমর্যাদাবোধ ইত্যাদি আছে। 

এই বহুল আলোচিত মডেলের একটা মূলকথা হচ্ছে, মানুষের স্তর যত উন্নত হতে থাকে তাঁর চাহিদা ততো বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে আত্মমর্যাদা ও মানবিক চেতনার। রাষ্ট্রের কর্তব্য জনতাকে ক্রমশ এই মডেলের সর্বোচ্চ স্তরের দিকে নিতে থাকা। কেবল খাওয়া, পরাতেই জীবন নয় বরং মানুষ হিসেবে বিকাশ লাভ এই ধারণা তৈরি করা। 

কিন্তু, স্বৈরাচারদের সমস্যা হচ্ছে, তাঁরা এই মডেলের সর্বোচ্চ স্তরের মানুষদের মুখোমুখি হতে অস্বস্তিবোধ করে। তাঁরা চায় প্রজারা উনমানুষ হয়ে থাক। খেতে আর পরতে পারাটাই সর্বোচ্চ প্রাপ্তির ভাবুক। এতে করে, তাঁরা সহজে শাসন চালাতে পারবে। এই উদ্দেশ্য, তাঁরা জনগণের মধ্যে নানা ধরনের তৃপ্তি আনার চেষ্টা করে, ভয় দেখানোর চেষ্টা করে যে এখন তো দুবেলা অন্তত খেতে পারছো, মাথা গোজার একটা ঠাঁই আছে, গণতন্ত্র এসব কেড়ে নিবে। 

নানারকম তত্ত্ব দিয়ে বোঝানো হয় যে, গণতন্ত্র ও প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এই তৃপ্তি জরুরি। ব্যাপারটা পুরোপুরি মিথ্যাচার। দীর্ঘমেয়াদে তো বটেই, স্বল্প মেয়াদেও। দুইটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে। আমাদের দেশে বিপুল জনশক্তি থাকলেও তাঁর মান খুব খারাপ। কোটি কোটি মানুষ প্রবাসে যান কাজের আশায় এবং সেখানে তাঁরা মূলত নিম্নমানের কায়িক শ্রম দেন। এইসব কাজের ঝুঁকি সর্বোচ্চ হলেও আয় সর্বনিম্ন। 

এশিয়ার বেশকিছু উন্নত দেশে গত কয়েক যুগের আলাপ বাদই দিলাম, প্রতিবেশী ভারতেও আমরা অবস্থার পরিবর্তন দেখতে পাই। সেখানে এখন কায়িক শ্রমের বদলে হোয়াইট কালার জবের পরিমাণ বাড়ছে। মাসলোর যে মডেল তাঁতে হরেদরে সেদেশের মানুষের জীবনযাত্রা উন্নত হচ্ছে। আর আমাদের এইখানে গার্মেন্টস শ্রমিক বা প্রবাসী হিসেবে প্রচণ্ড কষ্টের অথচ স্বল্প আয়ের বিপুল মানুষ অর্থনীতি ধরে রাখছেন। আগেই যেটা বলা হলো, এই ধরনের স্তরে থাকা মানুষদের কারেন্ট স্ট্যাটাস কো বা যা আছে সেই অবস্থা থাক, পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা করলে অবস্থা আরো খারাপ হবে সেই ভয় দেখানো সহজ। কোনোমতে জীবন কাটানো মানুষদের শেষ সম্বলটুকু হারানোর ভয় সবচেয়ে প্রকট। 

এই ব্যাপারটাই কাজে লাগিয়ে একাডেমিকভাবে, রাজনীতিতে স্বৈরাচাররা বলতে চায় যে দেশের মানুষ ‘সুখে’ আছে। তাঁদের গণতন্ত্র লাগবে না। তাঁরা পোশাকি গণতন্ত্র চায়না। স্বৈরাচারেরা চেষ্টা করে প্রজাদের এই অবস্থাতেই রেখে আজীবন শোষণ করতে। 

উল্লেখিত গবেষণার আরো একটি সমস্যাজনক দিক হচ্ছে উপাত্তের সত্যতা। আমরা বাংলাদেশের বেলায় দেখতে পাই, জিডিপি থেকে শুরু করে প্রায় সমস্ত ধরনের সরকারি উপাত্ত নিজেদের সুবিধামতো উপস্থাপন করা হয়। প্রায়শই উপাত্ত বাস্তবের না হয়ে হয় মনগড়া। সে এক বিশাল আলাপ। 

অবশ্য, গবেষণা ও পালটা গবেষণার ব্যাপারটি উৎসাহব্যঞ্জক। আর আলোচ্য গবেষণাটিতেও নানারকম সন্দেহ ও ক্রিটিক্যাল ব্যাপারের উল্লেখ আছে যা সব গবেষণাতেই জরুরি। কিন্তু, মূল আলাপটা হচ্ছে, স্বৈরাচারের মনোভাব যা জনতাকে দমন করে। এই মনোভাবকে পরিষ্কার করে দেয়া জরুরি।  

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন