Logo
Logo
×

অভিমত

হামাস গণধর্ষণকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে, এমন প্রচার থেকে ইসরায়েল কি সরেছে?

Icon

পামেলা ফিলিপোস

প্রকাশ: ২৩ জুন ২০২৪, ০৬:১৯ এএম

হামাস গণধর্ষণকে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করেছে, এমন প্রচার থেকে ইসরায়েল কি সরেছে?

গাজায় গণহত্যার পাশাপাশি ইসরায়েল প্রবলভাবে চালাচ্ছে তার প্রচারযুদ্ধ, যেখানে তার মিত্রদের মধ্যে রয়েছে প্রবল শক্তিশালী পশ্চিমা গণমাধ্যম। এসব গণমাধ্যম ব্যবহার করছে সেইসব তথ্য যেগুলো তেল আবিব থেকে সরবরাহ করা হচ্ছে। গণমাধ্যমগুলো পদ্ধতিগতভাবে এবং বিশ্বস্তভাবে তুলে ধরছে তেল আবিবের সব তথ্য, যেগুলো সাধারণ পাঠকের মনে হামাস সম্পর্কে একটি জোরালো নেতিবাচক ইমেজ সৃষ্টি করতে পারে। তবে প্রকৃত চিত্র কেমন সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন লিখেছেন দ্য ওয়্যার ডট ইনের ন্যায়পাল পামেলা ফিলিপোস।

গত বছর ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পরপরই ইসরায়েলের প্রচার ব্যবস্থা (বিশ্বের অন্যতম অত্যাধুনিক এবং প্রযুক্তিগতভাবে সুসজ্জিত) কাজ শুরু করে। কিছু দিনের মধ্যেই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম হামাস সদস্যদের ইসরায়েলি শিশুদের শিরশ্ছেদ করার গল্পে ছেয়ে যায়। সেই পরিসংখ্যান ভয়ঙ্কর ছিল। ১২ অক্টোবরের এনবিসির শিরোনাম ছিল: 'ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধে ৪০ শিশুর শিরশ্ছেদ করার অযাচাইকৃত প্রতিবেদন সোশ্যাল মিডিয়ায় উত্তেজনা ছড়িয়েছে'।

এই প্রতিবেদনের উৎসগুলির মধ্যে একটি হলো তেল আবিব-ভিত্তিক সংবাদ চ্যানেলের লাইভ সম্প্রচার, যার প্রতিবেদক ইসরায়েলি সৈন্যদের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছেন, যারা এ ধরনের শিরশ্ছেদ দেখেছিলেন বলে দাবি করেছেন।

এর কিছুক্ষণ পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ ঘটনাকে সত্য বলে প্রকাশ্যে প্রচার করেন।

যদিও অনেক আগেই ইসরায়েলি কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন যে, তারা বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারেননি।

একজন সিএনএন প্রতিবেদক আগে এই গল্পের একটি সংস্করণ প্রকাশ করেছিলেন। পরে তিনি টুইট করেছেন, ‘আমার আরও সতর্ক হওয়া দরকার। আমি দুঃখিত।’

শিশুদের গণহারে শিরশ্ছেদের গল্পটি ম্লান হওয়ার সাথে সাথে আরেকটি প্রথমটির জায়গা দখল করে নেয়। ৭ অক্টোবর হামলার সময় গণধর্ষণকে কৌশল হিসেবে অনুমোদন দিয়েছে। এবারও পশ্চিমা মিডিয়া তাদের নির্ধারিত ভূমিকা পালন করেছে এবং এবারও তাদের গল্পের সমস্ত উৎস একচেটিয়াভাবে ইসরায়েলি।

বিবিসির মধ্যপ্রাচ্য সংবাদদাতার প্রতিবেদন এর একটি ভালো উদাহরণ। শিরোনাম, '৭ অক্টোবর হামাস নারীদের ধর্ষণ ও বিকৃত করেছে, বিবিসি শুনেছে' (ডিসেম্বর ৫, ২০২৩)। এই প্রতিবেদনের উৎস একজন ইসরায়েলি পুলিশ সদস্য। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই পুলিশ সদস্য বলেছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে দেখেছেন হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে একজন মহিলাকে বীভৎসভাবে গণধর্ষণ করেছেন। হামাস যোদ্ধারা সেই মহিলার শরীরের বিভিন্ন অংশ কিভাবে কেটে ফেলেছে তা বিশদভাবে বলেছেন এই পুলিশ সদস্য, ‘তারা তার স্তন কেটে রাস্তায় ফেলে দিয়েছে এবং সেই কাটা স্তন নিয়ে তারা খেলা করেছে।’

কিন্তু বাস্তবে ইসরায়েলি পুলিশ স্বীকার করেছে, তারা এ ধরনের ধর্ষণের শিকার কোনো জীবিত ব্যক্তির সাক্ষাৎ পায়নি। 

এ ধরনের অনিশ্চিত প্রমাণ অবশ্য নিউইয়র্ক টাইমসকে আটকাতে পারেনি। বিবিসির ওই প্রতিবেদনের ২৩ দিন পরে নিউ ইয়র্ক টাইমসও অনিশ্চিত উৎসের ওপর ভিত্তি করেই প্রতিবেদন (বস্তুত কাল্পনিক গল্প) প্রকাশ করে। অথচ তারা সগৌরবে প্রচার করে থাকে, তারাই বিশ্বের সবচেয়ে নিশ্চিত-সত্যনির্ভর খবরের প্রধান ভাণ্ডার।

৭ অক্টোবর-পরবর্তী ইসরায়েলের তথ্যমূলক আক্রমণে যে গল্পটি গর্বের সঙ্গে স্থান দখল করে নিয়েছিল তার শিরোনাম ছিল, ‘শব্দ (word) ছাড়াই চিৎকার: হামাস কিভাবে ৭ অক্টোবর ধর্ষণকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে’ (ডিসেম্বর ২৮)। প্রতিবেদক জেফরি গেটলম্যান একজন পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী সাংবাদিক। তিনি ও তার দুইজন ইসরায়েলি সহকর্মী (আনাত শোয়ার্টজ ও অ্যাডাম সেলা) এই গল্প লিখেছেন। তিনি কেবলই ইসরায়েলিদের কথা এখানে বলেছেন। আদৌ এই গল্পের সত্যতা আছে কিনা তা যাচাই করেননি।

যেহেতু নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশ হয়েছে, গল্পটি শিগগিরই বিশ্বজুড়ে অন্যান্য গণমাধ্যম পুনঃপ্রচার করে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুকের প্রাক্তন প্রধান অপারেশন অফিসার শেরিল স্যান্ডবার্গের মতো হেভিওয়েটরা এমনকি ‘স্ক্রিমস বিফোর সাইলেন্স’ শিরোনামে তথ্যচিত্রও তৈরি করেছেন।

স্তন কাটার যে-গল্প বিবিসি বলেছে, নিউ ইয়র্ক টাইমসের সেই গল্প ছিল আরও বেশি রোমহর্ষক। তাদের গল্পে ‘গাল আবদুশ’ নামে যে নারীকে ধর্ষণ ও স্তন কেটে রাস্তায় ফেলে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেই আবদুশ পরিবার এমন ঘটনার কথা অস্বীকার করেছে।

আবদুশ পরিবার বলছে, ‘গালকে ধর্ষণ করা হয়েছে—নিউ ইয়র্ক টাইমসের এই তথ্য ভুয়া!’ গালকে ধর্ষণের ঘটনা যাচাই করেছে ‘দ্য ইন্টারসেপ্ট’ (একটি আমেরিকান বামপন্থী অলাভজনক সংবাদ সংস্থা, যারা অনলাইনে নিবন্ধ ও পডকাস্ট প্রকাশ করে)।

নিউ ইয়র্ক টাইমসে আরও দুই তরুণীকে ধর্ষণের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু দ্য ইন্টারসেপ্ট বলছে, ‘দুই তরুণীর মধ্যে একজন হলেন কিবুৎজ বেইরি, যিনি ধর্ষণের কথা অস্বীকার করেছেন। বেইরি বলেছেন, মেয়েদের গুলি করা হয়েছিল, যৌন নির্যাতন করা হয়নি।’

ইসরায়েল 'সাপির' নামে এক নারীর গল্পটি নির্ভুলভাবে উপস্থাপন করার জন্য প্রয়োজনীয় ফরেনসিক প্রমাণ সংগ্রহের প্রচেষ্টায় বিপুল বিনিয়োগ করেছে। কারণ এটি ছিল হামাসকে ‘নৃশংস ধর্ষক’ হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উপস্থাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই অকথ্য নৃশংসতার শিকার ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েল।

এবং দ্য ডেইলি নিউ ইয়র্ক টাইমস ও নিউ ইয়র্ক টাইমস পডকাস্টের সম্পাদকরা শেষ পর্যন্ত হামাস যোদ্ধাদের কথিত ধর্ষণ-সংক্রান্ত গল্প বলা থেকে বিরত হয়েছে।

প্রথম দিকে শুধু ইন্তিফাদা, দ্য গ্রেজোন, আরব নিউজ, দ্য ইন্টারসেপ্টের মতো বিকল্প বামপন্থী গণমাধ্যমগুলো এই বিপর্যয়মূলক সাংবাদিকতা রুখতে পেরেছিল। তবে ধীরে ধীরে পশ্চিমা গণমাধ্যমেও পরিবর্তন আসে হামাস যোদ্ধাদের কথিত ধর্ষণ-সংক্রান্ত খবর নিয়ে। দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট রিপোর্ট করেছে, সাংবাদিকতার ৫০ জন সিনিয়র অধ্যাপক নিউ ইয়র্ক টাইমসকে একটি যৌথ চিঠি লিখেছিলেন, যেখানে তারা ওই প্রতিবেদনের ব্যাখ্যা ও বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দাবি করেন।

পরিশেষে, লক্ষ করা দরকার যে, ৭ অক্টোবরের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরায়েল গাজাকে ধ্বংস করার অজুহাত হিসেবে বলতে চেয়েছিল, ইসরায়েল এখানে ভিকটিম, হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলি নারীদের ধর্ষণ করছে, এবং হামাস এখানে নৃশংস। সুতরাং তারা গাজায় হামলা চালাতে পারে। গাজায় ইসরায়েলি সেনারা এখন পর্যন্ত নিরীহ ৩৭ হাজারের বেশি মানুসের জীবন কেড়ে নিয়েছে।

তার মানে, ধর্ষণের তথ্যকে ইসরায়েল এখানে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে।

পামেলা ফিলিপোস, ন্যায়পাল, দ্য ওয়্যার। ইংরেজি থেকে অনুবাদ

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন