সাংবাদিক ফাগুন রেজা হত্যাকান্ডের ৬১ মাস, জানা যায়নি কারণ, বিচারও হয়নি
ফাগুন চলে যাওয়ার একষট্টি মাস। পিতা হিসেবে ‘হত্যা’ লিখতে ভালো লাগে না বলেই ‘চলে যাওয়া’ শব্দটি ব্যবহার করি লেখার শুরুতে এবং প্রতি মাসের একুশ তারিখে ফাগুনকে নিয়ে লিখি। একুশ হলো ফাগুনে চলে যাওয়ার তারিখ। ২০১৯ সালের একুশে মে ফাগুনকে প্রথমে গুম ও পরে হত্যা করা হয়। তাই প্রতিমাসের একুশ তারিখে লিখে রাতেই সে লেখা পোস্ট করি সামাজিকমাধ্যমে। এ লেখা মূলত আমার একধরণের মানসিক প্রশান্তির চেষ্টা। বলতে পারেন, ব্যর্থ চেষ্টা। তবে এবার লিখছি দুপুর বেলা। রাতে লিখতে ইচ্ছে করেনি। এখন লিখতে বসে মনে হচ্ছে, আমিও কি ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়ছি? যে দেশে হাজার কোটি টাকা লোপাটকারী নিশ্চিন্তে দেশের বাইরে চলে যেতে পারে। মানুষ গুম, খুনের সাথে জড়িতরা বিদেশে কাটাতে পারে বিচারহীন আয়েশী জীবন, সেদেশে একটা হত্যাকাণ্ডের বিচারের অপেক্ষা কতটা বাস্তবনির্ভর। কতজন গণমাধ্যমকর্মীর হত্যার বিচার সম্পন্ন হয়েছে এদেশে, কতজন শাস্তি পেয়েছে, এমন প্রশ্ন সঙ্গতই ভীড় করে মাথায়। কিন্তু উত্তর খুঁজতে গিয়ে রীতিমত বিভ্রান্ত হতে হয়, বিব্রত হতে হয়। গত দেড় দশকে গণমাধ্যকমকর্মীদের হত্যা কিংবা নির্যাতন করেছে এমন কারো শাস্তি নিশ্চিতের নজির স্মৃতিতে নেই। নিশ্চিত গুগলে সার্চ করলেও তেমন কিছু পাওয়া যাবে না। যা যাবে তা নিজেকে আরো বিভ্রান্তিতে ফেলবে। এক ডিসির আদেশে সাংবাদিককে তুলে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিলো। সেই ডিসি’র শেষ পর্যন্ত কিছুই হয়নি, উল্টো প্রমোশন হয়েছে। এমন আরো কিছু খবর গুগল দেবে যাতে আশাহত হওয়ার উপাদানের কমতি নেই।
একজন তরুণ, মেধাবী সর্বোপরি সৎ গণমাধ্যমকর্মী, তাও মূলধারার। শুধু গণমাধ্যমকর্মী নয়, ইংরেজি বিভাগের একজন উপ-সম্পাদক। তিনি নিখোঁজ হলেন, তাকে গুম করা হলো। তারপর তার লাশ পাওয়া গেলো রেললাইনের ধারে। খুনের পর খুনিদের লাশ ফেলার সবচেয়ে নিরাপদ স্থান হলো রেললাইনের আশপাশ। যেখানে লাশ পাওয়া গেলে সেটা ধরা হয় অপমৃত্যু হিসেবে এবং মামলাও হয় অপমৃত্যুর। আমাদের মতন কোনো নাছোরবান্দা অভিভাবকের কারণে সেই অপমৃত্যুর মামলা হয়তো শেষ পর্যন্ত হত্যা মামলায় দাঁড়ায়। ইহসান ইবনে রেজা, ফাগুন রেজা’র ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিলো। কিন্তু তারপরও সেই মামলাকে স্রেফ ছিনতাই মামলায় পর্যবসিত করার চেষ্টা হয়েছে। যে চেষ্টা এখনো চালু রয়েছে। ১৬৪ ধারায় খুনের স্বীকারোক্তি যে দিয়েছে, সে কারাগারে থাকলেও তার জামিন প্রচেষ্টা চলছিলো। জানি না ইতোমধ্যে তার জামিন হয়ে গিয়েছে কিনা। এছাড়া সে স্বীকারোক্তিতে অন্য যাদের নাম এসেছিলো, তাদের গ্রেপ্তার কিংবা জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়নি। আরো বিস্ময়ের বিষয়, আমি পিতা হিসেবে এ মামলার বাদি, কিন্তু কখন জামিন শুনানি হচ্ছে কিংবা কী হচ্ছে মামলা বিষয়ে, তার কোনো কিছুই আমি জানি না, জানানো হয় না। কেন হয় না, এই প্রশ্ন কার কাছে করি। এর উত্তর পেতে গেলে তো নিজের পকেট খালি হয়ে যাবে। রাষ্ট্র-ব্যবস্থা যখন দায়িত্বে তখন নিজের তো সেই ব্যবস্থার উপরই নির্ভর করতে হয় এবং একজন নাগরিকের তাই করা উচিত। কিন্তু সেই নির্ভরতা বলতে গেলে এখন প্রশ্নের সম্মুখিন। মামলার ব্যাপারে এখন নিজেরই একজন উকিল নিয়োগ করতে হয় এবং নিজের পকেটের টাকায়। যদিও ব্যক্তিগত ভাবে উকিল নিয়োগের দিকটা আইনগতভাবেই শুদ্ধ নয়। কিন্তু তারপরও এদেশে বিচার পেতে হলে অধিকাংশ মানুষের এমনটাই করতে হয়। একদিকে প্রিয়জন হারানো, অন্যদিকে মামলা চালাতে গিয়ে নিজে সর্বশান্ত হওয়া, এই হলো এদেশের নাগরিক হওয়ার মাশুল। দেশটাকে যারা স্বাধীন করেছিলেন, তারা চেয়েছিলেন পাকিস্তানের শাসন বৈষম্য থেকে মুক্তি। নাগরিক হিসেবে প্রধান মৌলিক অধিকারগুলি নিশ্চিত করার লক্ষেই তারা জীবনবাজি রেখে লড়েছিলেন। কিন্তু তাদের যদি প্রশ্ন করি, আমরা কি সে দেশটা পেয়েছি? তাদের আত্মত্যাগ কি সফল হয়েছে? জানি না, তারা কী উত্তর দেবেন। তবে আমি যাদের প্রশ্ন করেছি তারা বেশিরভাগই নিরুত্তর ছিলেন।
একটা হত্যাকাণ্ড ঘটলো। সেই হত্যাকাণ্ডের শিকার যিনি হলেন, তার পরিচয় নিশ্চিত না করেই রেলওয়ে পুলিশ কেন তড়িঘড়ি কবরস্থ করতে চাইলো তার উত্তর এখনো পাইনি। কেন তার আঙুলের ছাপ নেয়া হলো না। আঙুলের ছাপ নিলেই তো তার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে যেত। কেন তাকে পরিচয়হীন দাফনের সর্বাত্মক চেষ্টা হলো। পিতা হিসেবে আমি যদি একজন গণমাধ্যমকর্মী না হতাম, আমার পরিচিতজন না থাকতো, লাইন-লিঙ্ক না থাকতো, তাহলে তো কোথায় লাশ পাওয়া গেলো, কোথায় দাফন করা হলো, তার কোনো খবরই আমি পেতাম না। এখন পর্যন্ত সন্তানের খোঁজে পাগলের মতো চষে ফেলতাম সারাদেশ। হয়তো ‘মায়ের ডাক’ এর সাথে গলায় ছবি ঝুলিয়ে দাঁড়াতাম রাস্তায়। নিখোঁজ সন্তানের সন্ধান চাইতাম। অথচ সেই সন্তান আমার মাটিচাপা থাকতো বেওয়ারিশ হিসেবে কোনো বেওয়ারিশ দাফনের কবরস্থানে। একজন পিতার জন্য, একজন মায়ের জন্য, একটা পরিবারের জন্য এরচেয়ে যাতনার আর কী হতে পারে। উল্লেখ্য, এমন একটা কবরস্থান থেকেই লাশ দাফনের পূর্বমুহূর্তে ফাগুনের শরীরকে উদ্ধার করতে পেরেছি আমি। যারফলেই আজ আমি ছেলেটার কবরের পাশে গিয়ে বসতে পারছি, প্রার্থনা করতে পারছি।
কেন গণমাধ্যমকর্মী ফাগুন রেজাকে হত্যা করা হলো? ‘ডয়চে ভেলে’ ফাগুন রেজা হত্যার পরই খবর করেছিলো, সংবাদ প্রকাশের কারণেই কি ফাগুন কে হত্যা করা হলো- এমন প্রশ্ন তুলে। ফাগুন উপ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি রিপোর্টিংও শুরু করেছিলো। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উপর তার ঝোঁক ছিলো এবং সে কাজটাই সে করছিলো। অত্যন্ত মেধাবী হওয়ার কারণে হয়তো তার কাছে এমন কোনো তথ্য ছিলো, যা তার মৃত্যুর কারণ। কিংবা আমার সাংবাদিকতাও হতে পারে আরেকটা কারণ। জানি না, কোন কারণটা সত্যি। কখনো জানা যাবে কিনা তাও নিশ্চিত নই। কারণ, ফাগুন হত্যাকাণ্ডকে প্রথমে অপমৃত্যু প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। তারপর স্রেফ ছিনতাইয়ের ঘটনা হিসেবে আখ্যা দেয়ার চেষ্টা চলেছে, যা এখনো চলমান। কিন্তু এসবই যে হত্যাকাণ্ডের ধরণ, পারিপার্শ্বিক ঘটনাপ্রবাহের সাথে মেলে না তা একেবারে সাদাচোখেই দেখা যায়, অনুসন্ধানের অণুবীক্ষণের প্রয়োজন পড়ে না। এনটিভি’র ক্রাইম ওয়াচের অনুসন্ধানও ফাগুন হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে সে আভাসই দিয়েছে। সেই অনুসন্ধান অনেকটাই প্রমাণ করেছে ফাগুন হত্যাকাণ্ড ছিলো পরিকল্পিত। তারপরও ফাগুন হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা থেমে নেই।
এসব কারণেই হতাশ হই সত্যি, হতাশ হওয়ার সকল কারণ বিদ্যমান বলেই। যা শুরুতেই কিছুটা বলেছি। সবটা হয়তো বলা যায় না। কিন্তু হতাশ হওয়ার পরও একটা বিশ্বাস নিজের ভেতর কাজ করে যে, কোনো অন্যায়ই বিনা দণ্ডে পার পায় না। সে দণ্ড জাগতিক বিচারের হোক কিংবা সৃষ্টিকর্তার শাস্তিতে।