ছবি: সংগৃহীত
একজন মহিলা কবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোরবানি বিষয়ক তার মন্তব্যে অনেকটা এমন বললেন, ‘মানুষ থেকেও যদি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী পৃথিবীতে থাকতো এবং তাদের তথাকথিত সৃষ্টিকর্তা যদি ঈদ তথা আনন্দের নামে মানুষকে কোরবানি দেয়ার হুকুম জারি করতো, তাহলে কেমন হতো?’ কী হাইপোথিসিস, রীতিমতো বিস্ময়কর। এই মহিলা কবি বিধর্মী নন, তবে ভীষণ রকম ‘প্রগতিশীল’। অনেকের ভাষায় ‘কলাবিজ্ঞানী’ এবং তাদের ভাষায় ‘বিজ্ঞানমনস্ক’। এসব বিজ্ঞানমনস্কদের জীবের খাদ্যচক্র জানা নেই। বাঘেরা গোশত খায়। হরিণ, ছাগল, গরু, ভেড়া সব তাদের খাদ্য। তাদের জীবনচক্রে আমিষের কোনো বিকল্প নেই। মানুষের খাদ্যচক্রে আমিষ এবং নিরামিষ দুটোই অত্যাবশ্যকীয়। মানুষের আমিষের প্রয়োজন মেটে পশু থেকে। নিরামিষভোজী যাদের বলেন, তারাও আমিষ তথা প্রোটিন খায়। ডাল জাতীয় খাদ্য থেকে তাদের প্রোটিন আসে, কিন্তু এই প্রোটিন নিম্নমানের। যে প্রোটিন মানবদেহের সব চাহিদা মেটায় না।
এটা গেলো সহজ ভাষায় শরীরবৃত্তিয় বিষয়। এখন সামাজিক বিষয়ে আসি। এই যে বিজ্ঞানমনস্কদের বিভিন্ন সময় আনন্দ করতে দেখা যায়। সেটা রেস্তোরাঁতে হোক, সমুদ্রপাড়ে হোক, যেখানেই হোক, সে আনন্দের একটি বড় অংশ বারবিকিউ। গোশত বা মাছ পুড়িয়ে খাওয়া। বিজ্ঞানমনস্কদের এমন একটি আনন্দ উৎসবে যোগ দেয়ার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিলো। যে উৎসবে ছিলো লালপানির অঢেল সরবরাহ এবং একটি আস্ত ছাগলকে বারবিকিউ করার ব্যবস্থা। এই যে যারা কোরবানিতে পশু হত্যায় আপত্তি জানান। তাকে নৃশংসতা বলে আখ্যায়িত করেন। তাদের কাছে যদি সেই ঝলসানো ছাগলটা প্রশ্ন করে, ‘আমাকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হলো এবং তাতেও আপনারা ক্ষান্ত হলেন না, আমার শরীরকে বিভৎসভাবে আগুনে ঝলসানো হচ্ছে আপনাদের উদরপূর্তির জন্য। একেবারে আদিমযুগের মানুষ যেমন করে পশু হত্যার পর পুড়িয়ে খেতো ঠিক তেমনি।’ কী জবাব দেবেন আপনারা? না হয় নিজেকে ছাগল মেনে আমিই প্রশ্ন করলাম, আপনাদের জবাব কী হবে? কোনো জবাব নেই। লজিক থাকলে তো জবাবের আলাপ। তাদের লজিক একটাই এবং তা ইসলাম বিদ্বেষ। এসব তথাকথিত প্রগতিশীল ও বিজ্ঞানমনস্কদের কাজ মূলত ইসলাম বিরোধিতা।
ওই মহিলা কবির লেখায় আরেকজন, যিনি আটলান্টার একটা ‘স্কুল অব মেডিসিন’-এ পড়ান, তিনি মন্তব্য করলেন, ‘হত্যার সময় সেই প্রাণীটি বোঝে যে তাকে হত্যা করা হচ্ছে, এবং সে ভয়ংকর মৃত্যু যন্ত্রণা সহ্য করে। খালি জানে না যে ঈশ্বর/আল্লাহ/গড নামের যে কাল্পনিক সত্তাটি রয়েছে, যার নির্দেশে এই হত্যা, সে কতটা নিষ্ঠুর...’- অথচ এই ভদ্রলোক একজন জীববিজ্ঞানী বলে নিজেকে পরিচয় দেন। সেই জীব বিজ্ঞানীকে যদি প্রশ্ন করা হয়, গবেষণার জন্য কত জীবকে হত্যা করা হয় তার পরিসংখ্যান কি তার জানা আছে? কত গিনিপিগ, বানর, খরগোশসহ অন্যান্য প্রাণীকে ব্যবহার করা হয় মানুষের জন্য ঔষধ তৈরির ক্ষেত্রে। রোগের গবেষণার কারণে কত প্রাণীর যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু ঘটে এ প্রক্রিয়ায়। অথচ সেই জীববিজ্ঞানীর কষ্ট দাঁড়াল গিয়ে কোরবানির ক্ষেত্রে। এটা পরিষ্কার ইসলাম বিদ্বেষ। তিনি নিরপেক্ষ থাকার জন্য ঈশ্বর ও গড এর নাম নিয়েছেন বটে, কিন্তু তার মন্তব্যটা ঈদ ও কোরবানিকে কেন্দ্র করে। যদিও তিনি বিধর্মী, মেনে নিলাম তার ইসলামফোব রয়েছে। কিন্তু তিনি কী নেপালে বলির উৎসব নিয়ে কোনো কথা বলেছেন কখনো। কীভাবে একটা বিশাল জায়গা জুড়ে মৃত পশুগুলোকে ফেলে রাখা হয়। রক্তে ভেসে যায় পুরো জায়গাটি। পশুর রক্ত উৎসর্গ করা হয় দেবতাকে। অথচ কোরবানিতে কোনো রক্ত উৎসর্গ করতে হয় না আল্লাহতায়ালাকে। বরং ইসলাম কোরবানির পরই পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কথা বলেছে সোচ্চার ভাবে। ইসলাম এই পশু কোরবানিকে মানুষের জন্যই উৎসর্গ করেছে। আরো একটি কথা, কোরবানিকে ইসলাম অত্যাবশ্যকীয় অর্থাৎ ফরজ করেনি।
আরেকজন অর্থনীতি নিয়ে যিনি মাঝেমধ্যে লিখেন-বলেন। তারও পশু হত্যা অপছন্দ। তিনিও সামাজিকমাধ্যমে তার জানান দিয়েছেন। বিস্মিত হলাম, কোরবানির অর্থনৈতিক দিকটাও তার বোধে এলো না কেন এই ভেবে। একটি কোরবানি প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকে একেবারে তৃণমূলের নিম্নবিত্ত মানুষ থেকে উচ্চবিত্তরা। কোরবানিকে কেন্দ্র যে ইকোনমি গড়ে ওঠে, তা এককথায় অসাধারণ। ফাইভস্টার হোটেলে থার্টিফাস্ট, হ্যালোইন পালনের চেয়ে কোরবানি ও ঈদকে ঘিরে যে আনন্দ উৎসব তার অর্থনৈতিক ফায়দা একেবারে তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে যায়। একটা রাখাল থেকে উচ্চবিত্ত সবাই এই অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ায় জড়িত থাকে। ওই অর্থনীতিবিদ চামড়া শিল্পের বিষয়টাও নজর-আন্দাজ করেছেন। বলুন তো, এমন অর্থনীতিবীদ লইয়া আমরা কী করিব! এদিকে আরেক ভেগান, পশু হত্যায় মারাত্মক মর্মাহত। তার মতে আমিষ বর্জনীয়। অথচ তার দেয়া খাবারের ছবিতে ডালের আধিক্যই থাকে বেশি। প্রাণিজ হোক উদ্ভিদেরই হোক আমিষের ইংরেজি কিন্তু প্রোটিনই। কাজেই ভেগানদের আমিষ বিষয়ক তত্ত্বটি খুব একটা যায় না পশু হত্যার বিপরীতে।
না, কোরবানি নিয়ে বাহাস শুধু পশু হত্যার সিজনাল বিরোধীদের মধ্যে নয়, ইসলামিস্টদের মধ্যেও রয়েছে। হত্যার বিরোধিতা নয়, তাদের বাহাস হলো কোরবানির পশুর গোশত ভাগ নিয়ে। তিনটে সমান ভাগের কথা একজন লিখলেন। তার উত্তরে আমি বলেছিলাম, ইসলামে গোশতের সমান ভাগ নিয়ে বলা নেই। বলা আছে, কাকে কাকে দেয়া যায় তা নিয়ে। তিন ভাগ বা ভাগের যে কথা বলা হয়েছে তা মূলত ধর্মীয় নয়, সামাজিক। অবস্থা বুঝে কোথায় কতটুকু দেয়া যাবে সে কথাই হাদিসে সাহাবীদের ভাষায় বর্ণিত হয়েছে। যেমন, আমাদের অনেক গ্রামে কোরবানিকে ঘিরে একধরনের সামাজিক ব্যবস্থা চালু আছে। সে ব্যবস্থায় গ্রামের সবার কোরবানির প্রদেয় গোশত এক জায়গায় জড়ো করতে হয় এবং সেখান থেকে ভাগ-বণ্টনের ব্যবস্থা হয়। এই যে ভাগ-বণ্টনের সামাজিক ব্যবস্থা এটাও কিন্তু সামাজিক এবং তা ঠিক ধর্মের সাথেও যায় না। তারপরেও সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে এটা মানা হয়। কেউ যদি একশ বছর পরে এর উদাহরণ দিয়ে বলেন, এইভাবে কোরবানির গোশত ভাগ-বণ্টনের ব্যবস্থা করা উচিত, তখন তা নিশ্চয়ই ধর্মীয় হবে না, হবে তা সামাজিক সংস্কারের বিষয়। ইসলাম কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়নি কারো উপর। কতটা ভাগ করবে কতটা নিজে খাবে, কতটা দেবে, এটা অবস্থা বুঝে নির্ণয় করতে হয়, এর বেশি কিছু নয়। জানি অনেক ইসলামিস্ট আমার এ কথায় আপত্তি জানাবেন। না-না উদাহরণ দেবেন। কিন্তু একটু খেয়াল করবেন, যে উদাহরণ দেবেন তা ইসলামের পুরোধারা করেছেন তৎকালীন সামাজিক অবস্থার উপরই ভিত্তি করে।
শেষে বলি, যারা পশু হত্যার বিরোধিতা করেন এবং তা শুধু কোরবানি এলেই। এসময় সামাজিকমাধ্যম মনের পশুরে জবাই করার তাগিদে ভরে যায়। কিন্তু তারা তাদের মনের পশুকে কি জবাই করেছেন? আমি যে মহিলা কবির কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, তার ফেসবুকের প্রোফাইল ঘেটে কোথাও পায়নি, যে গুম, খুন নিয়ে সারাবিশ্ব তৎপর তার বিরুদ্ধে একটি কথাও। মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে তার প্রোফাইলে কোনো কথা নেই, রয়েছে পশু হত্যার বিরুদ্ধে, আজব না? দুষ্টুলোকেরা হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন তারা কি পশুপ্রেমী না কামী, তাহলে মানুষের জন্য তাদের দরদ নেই কেন? অনেক আত্মস্বীকৃত বুদ্ধিজীবীর বয়ানেও দেখেছি কোরবানির বিরোধিতা। অথচ সামাজিকমাধ্যমে শেয়ার করেছেন বিদেশি রেস্তোরাঁর লাঞ্চে বিফস্টেকের ছবি। এই যে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড তা যে নিজেদের নৈতিকতার বিরুদ্ধে যায়, একথা তাদের চিন্তায় আসেনি কখনো। কারণ, তাদের চিন্তাক্ষেত্রটি ভরে আছে স্রেফ ইসলাম বিদ্বেষ নিয়ে।
এই ইসলাম বিদ্বেষের ব্যাপারটি বুঝেছিলো জাতিসংঘ। যার ফলে জাতিসংঘ ২০২২ সালে ইসলামভীতি তথা বিদ্বেষের বিরুদ্ধে ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে টু কমব্যাট ইসলামফোবিয়া’ নামে একটি আন্তর্জাতিক দিবসই ঘোষণা করেছে। যা পালিত হয় ১৫ মার্চ। জাতিসংঘ ইসলামফোবিয়ার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছে, ইসলাম ভীতি হলো সেটা, যেটা ধর্ম হিসেবে ইসলাম ও অনুসারী হিসেবে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণা, কুসংস্কার বা ভয়। তবে মজার বিষয় হলো, মুসলিম প্রধান দেশ হলেও এই দিবসটি ২০২৩ সালে বাংলাদেশ পালিত হয়নি। কেন হয়নি, হয়নি সম্ভবত বাংলাদেশে থাকা আত্মস্বীকৃত কথিত বুদ্ধিজীবীদের কারণে। এরা পরিবেশটাকে এতটাই ঘোলাটে করে রেখেছে যে, তাদের কারণে ইসলাম নিয়ে কথা বলতে গেলেই বিপদ। যে বলবে তাকে সাম্প্রদায়িক বানিয়ে তার চৌদ্দগোষ্ঠীর পিণ্ডদান করে ছাড়বে। এরা চিন্তায় এতটাই অন্ধ যে, নিজেদের অন্ধত্বটা দেখার সক্ষমতাও তাদের নেই।