দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ
কংগ্রেসের কৌশল কি বিএনপি কাজে লাগাতে পারে?
সাকলাইন রিজভি
প্রকাশ: ১৪ জুন ২০২৪, ১১:৪৪ এএম
সাম্প্রতিক ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিরোধী কংগ্রেস দলের রাজনৈতিক কৌশল মানুষের মন জয় করেছে এবং অনেক বাংলাদেশির কল্পনাকে উস্কে দিয়েছে। বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের লৌহদৃঢ়তাকে দুর্বল করার জন্য কংগ্রেস ও তাদের আইএনডিআইএ জোটের কৌশল বিএনপি অবলম্বন করতে পারে কিনা তা নিয়ে জনগণ আলোচনা করছে।
বাংলাদেশিরা কংগ্রেসনেতা সংসদ সদস্য রাহুল গান্ধীর ক্রস-কান্ট্রি পদযাত্রা, ভারতজোড়ো যাত্রা এবং ভারতজোড়ো ন্যায়যাত্রার প্রতি গভীর মনোযোগ দিয়েছে, যা রাহুলকে জনসাধারণের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে, কংগ্রেসকর্মীদের উৎসাহিত করতে এবং বিভাজনমূলক শাসনব্যবস্থার প্রতি মনোযোগ আকর্ষণ করতে সাহায্য করেছিল।
রাহুল ও তার দল কংগ্রেস ভারতীয় যুবকদের তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে দক্ষতার সাথে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেছিল। তাদের প্রচারণা মোদির শাসনে গণতন্ত্রের পতনের দিকে মনোনিবেশ করেছিল। রাহুল সাংবিধানিক অধিকার রক্ষার প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিয়েছিলেন এবং তার প্রচারাভিযানজুড়ে সংবিধানকে একটি প্রতীকী সমর্থন হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিষয়গুলিকেও সামনে এনে তার ওপর জোর দিয়েছিলেন। কংগ্রেস পার্টিতে নেহরু ও গান্ধী পরিবারের আধিপত্য নিয়ে বিজেপি ও জনসাধারণ সমালোচনা করত। তার প্রতিক্রিয়ায় দলিত নেতা মল্লিকার্জুন খার্গকে কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত করা হয়। ২৪ বছরের মধ্যে প্রথম অ-গান্ধী এই পদে অধিষ্ঠিত হন।
কংগ্রেস তার আঞ্চলিক নেতাদের প্রভাবকে কাজে লাগায়। তারা আইএনডিআইএ জোট গঠনের জন্য অন্য বিরোধী দলগুলির কাছে যায় এবং নির্বাচনের সময় তাদের টিকে থাকা নিশ্চিত করতে আসন ভাগাভাগির বিষয়ে জোটের অংশীদারদের বড় রকম ছাড় দেয়।
বিরোধীদের দুর্বল করার জন্য মোদি সরকারের নিয়মতান্ত্রিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আইএনডিআইএ ব্লক প্রশংসনীয় পারফরম্যান্স দেখিয়েছে। বিরোধী নেতাদের কারাগারে নিক্ষেপ করার পাশাপাশি বিজেপি বিরোধী দলগুলিকে বিভক্ত করেছে, নির্বাচনী বন্ড স্কিমের মাধ্যমে তহবিল কোণঠাসা করেছে এবং কংগ্রেসের তহবিল স্থগিত করেছে। ভারতের নির্বাচন কমিশন বিজেপির সম্প্রসারক হিসেবে কাজ করেছে।
তবু আইএনডিআইএ ব্লক সাম্প্রতিক নির্বাচনে একটি বিশ্বাসযোগ্য পারফরম্যান্স করার জন্য প্রতিকূলতার সাথে লড়াই করেছিল। এটা বাংলাদেশের বিএনপিকে অনুপ্রাণিত করেছে। কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, বিএনপি ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে লড়তে পারবে কি না।
২০০৯ সাল থেক আওয়ামী লীগ শাসন করছে। তারা ভারতের বিজেপির মতো বিরোধী দলগুলিকে চূর্ণ করেছে এবং তাদের নেতাদের ব্যাপকভাবে জেলে ভরেছে। শেখ হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য গণতান্ত্রিক পশ্চাৎপসরণ হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিরোধীদের দাবি অনুযায়ী নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নয়, বরং আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের সব নির্বাচনেই ব্যাপক কারচুপি ও অন্যান্য অনিয়ম হয়েছে। নির্বাচন অবাধ বা সুষ্ঠুতা থেকে অনেক দূরে।
উপরন্তু, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, দুইবারের প্রধানমন্ত্রী, ২০১৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে কারাবন্দি হন এবং ২০২০ সাল থেকে অসুস্থতার কারণে গৃহবন্দি জীবনযাপন করছেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হলেন তার ছেলে তারেক রহমান, যিনি এখান বসবাস করছেন লন্ডনে। স্ব-নির্বাসিত।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বিএনপির কৌশলের মধ্যে রয়েছে হরতাল, সহিংস বিক্ষোভ ও নির্বাচন বয়কট। তারা ২০১৪ ও ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচন বর্জন করেছিল, কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না।
বিএনপির বয়কট ফল দেয়নি। ২০১৪ সালে তাদের বয়কটের আহ্বান সত্ত্বেও নির্বাচন এগিয়ে যায় এবং আওয়ামী লীগ ৩০০টি সরাসরি নির্বাচিত আসনের মধ্যে ১৫৩টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়। সহিংসতা, বিরোধী সদস্যদের গ্রেপ্তার ও নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মধ্যে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে তারা। ফলে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
২০১৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করেছিল। এটা করার অন্যতম কারণ ছিল দলীয় নিবন্ধন বজায় রাখা। চ্যালেঞ্জিং রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপ সত্ত্বেও বিএনপির অংশগ্রহণ তার কৌশলে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন চিহ্নিত করেছে। যদিও তারা ৩০০টির মধ্যে মাত্র ৭টি আসন লাভ করে। ফলে বিএনপি জাতীয় সংসদে শুধু আনুষ্ঠানিক উপস্থিতি বজায় রাখার সুযোগ পায়। রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা অস্তিত্ব নিশ্চিত করে এবং ভবিষ্যতে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য যোগ্যতা বজায় রাখে।
মাঠে নেতৃত্ব না থাকায় আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপির লড়াই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারেক রহমান ২০০৪ সাল থেকে লন্ডনে স্বনির্বাসিত থাকায় নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়েছে দলটির। দল পুনর্গঠন ও সমর্থন জোগাড় করার জন্য বিএনপির প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করেছে নেতৃত্বশূন্যতা।
এছাড়া তারেক রহমান দুর্নীতির অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন এবং সহিংস রাজনীতির ইতিহাসের সাথে যুক্ত রয়েছেন। সমালোচকরা তাকে ভীতি প্রদর্শন এবং দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত করেন, যার ফলে ২০০৪ সালের ঢাকায় গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বিএনপির শাসনামলে একটি সমান্তরাল ক্ষমতা কেন্দ্র হাওয়া ভবনের সাথে তার যোগসাজশ, ২০০৪ সালে ১০ ট্রাক অস্ত্র উদ্ধার মামলায় তার ভূমিকাসহ দুর্নীতির জন্য কুখ্যাত ছিল।
কিন্তু রাহুল গান্ধীর বিরুদ্ধে সে রকম কোনো অভিযোগ নেই। সুতরাং ভারতের কংগ্রেসের সঙ্গে বিএনপির তুলনা করা কঠিন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমি সন্দিহান যে বাংলাদেশে কেউ রাহুল গান্ধীর মতো রাজনৈতিক দৃশ্যপট পরিবর্তন করতে পারেন। রাহুলের মতো কিছু করার জন্য নেতাদের অবশ্যই কৌশল পরিবর্তন করতে হবে যা আমাদের জাতির জন্য উপযুক্ত।’
কংগ্রেসের গণসংহতি অভিযান ও সোশ্যাল মিডিয়ার সম্পৃক্ততা ভারতে কাজ করেছে, কিন্তু বিএনপি আরও জটিল পরিবেশের মুখোমুখি হয়েছে, যা ভিন্নমতের বিরুদ্ধে তীব্র ক্র্যাকডাউন ও নেতৃত্বের শূন্যতা দ্বারা চিহ্নিত। বিএনপি ভারত থেকে অনুপ্রেরণা এবং ধারণা পেতে পারে, তবে বাংলাদেশের অনন্য রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য তার কৌশল তৈরি করতে হবে, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ সংহতি গড়ে তোলা, এর ভাবমূর্তি পুনরুজ্জীবিত করা ও বাংলাদেশি ভোটারদের সাথে সখ্য গড়ে তোলা জরুরি।
সাকলাইন রিজভি : সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার। তিনি দ্য ডিপ্লোম্যাটের জন্য ঢাকা থেকে রাজনীতি ও সামাজিক বিষয় কভার করেন।