Logo
Logo
×

অভিমত

মোদির কোয়ালিশন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সংশয়

কাকন রেজা

কাকন রেজা

প্রকাশ: ১২ জুন ২০২৪, ১২:৩৬ এএম

মোদির কোয়ালিশন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সংশয়

ভারতে দুর্বল বিজেপির কোয়ালিশন সরকারের বিদেশনীতি কী হবে এটা নিয়ে আলাপ চলছে না-না মহলে। বিভিন্ন দিক থেকে বিশ্লেষণ করা হচ্ছে, হাইপোথিসিস নির্মিত হচ্ছে। তবে সব আলাপেই বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়াটা আলোচনায় গুরুত্ব পেয়েছে। মোদিজিকে নির্ভর করতে হচ্ছে দুই ‘এন’ এর ওপর। এই দুই ‘এন’ হলো অন্ধ্র প্রদেশের চন্দ্রবাবু নাইডু ও বিহারের নীতীশ কুমার। 

মুশকিল হলো এ দল দুটিরই জোট পাল্টানোর ইতিহাস রয়েছে। আমাদের চলতি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘পল্টিবাজ’। বিশেষ করে বিহারের নীতিশ কুমার কথা বলেন সংখ্যালঘু ও দলিতদের হয়ে। তেলেগু দেশম পার্টির নেতা চন্দ্রবাবু নাইডুকেও নির্বাচনে জেতার জন্য নির্ভর করতে হয় সংখ্যালঘুদের ওপর। তারও উপায় নেই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধাচারণ করার। 

বিপরীতে বিজেপির দিকে তাকাই। এবার তাদের নির্বাচিত ২৪০ জন সদস্যের মধ্যে একজনও মুসলিম নেই, সাথে নেই কোনো দলিত সদস্যও। মন্ত্রী তো নেই-ই। তার ওপর বিজেপি নেতাদের অনেকেরই তীব্র মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশে কোন রাখঢাক ছিল না। সুতরাং দুই ‘এন’ এর গাঁট-বন্ধন বিজেপির সাথে কতদিন জুড়ে থাকবে তা নিয়ে শঙ্কা থেকেই যায়। 

আগের মোদি সরকার আর এবারের মোদি সরকারের পার্থক্য থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। চারশ পার করলে যেটা হতো সেটা এখন আর চিন্তা করে লাভ নেই। বরং চিন্তা করতে হবে বর্তমান বাস্তবতার নিরিখে। দিল্লি আম আদমি পার্টির নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল এর নির্বাচনী প্রচারে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের নির্বাচন পরিস্থিতি নিয়ে তার সাউন্ড ছিল ক্রিস্টাল ক্লিয়ার। সুতরাং এই বক্তব্যকে দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে নজর-আন্দাজ করাটা হবে দূরদর্শিতার অভাব। এই বক্তব্য একা কেজরিওয়াল এর ভাবলে ভুল হবে। এটা ভারতের সব বিরোধীপক্ষ তথা ইন্ডিয়া জোটেরই বক্তব্য এবং তা যে আগামীতে তাদের কর্মকাণ্ডে প্রতিফলিত হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। মোদিকে চ্যালেঞ্জ করার সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং তা বিরোধীরা অবশ্যই করবে তার জানানই দিয়েছেন কেজরিওয়াল। বাংলাদেশের পরিস্থিতি হলো তাদের জন্য যুক্তি, আর পাকিস্তান সে যুক্তির উদাহরণ।  

মোদিজিকে এবার পশ্চিমা বিশ্বের সাথে সামলাতে হবে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর চাপও। দুর্বল পেলে সবাই চেপে ধরতে চায়। যার বড় প্রমাণ আমরা। আদানির বিদ্যুৎ তিনগুণ বর্ধিত দামে আমাদের কিনতে বাধ্য করা হয়েছে। না, এটা আমার কথা নয়, খোদ ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের কথা। খোদ রাহুল গান্ধী বলেছেন এমন কথা। 

বলেছেন, ভারতের অন্যান্য বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চেয়ে আদানির কাছ থেকে তিনগুণ বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে বাংলাদেশকে বাধ্য করেছেন মোদিজি। দুর্বল বলে মোদি সরকারকে হয়তো উল্টো এবার এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে। একদিকে মোদিজির ইউক্রেন নীতিতে রাশিয়ার প্রতি অবিচল সমর্থন এবং রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সহায়তা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ক্ষুব্ধ করেছে। 

তারা যে ক্ষুব্ধ তার প্রমাণ তারা রেখেছে টোকেন স্যাংশানের মাধ্যমে। বর্তমান দুর্বল মোদি সরকারের ওপর পশ্চিমারা যে আরো চাপ বাড়াবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর মোদি সরকারকেও তার অনেকটাই হয়তো মেনে নিতে হবে। যেহেতু তার সাথে রয়েছে অনির্ভরযোগ্য দুই বন্ধু। যারা পল্টিবাজির জন্য ইতোমধ্যে নাম কুড়িয়েছেন। বিগত মোদি সরকার যে চাপ দিতেন পশ্চিমাদের। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের কথা উল্লেখ করা যায় দ্বিধাহীন ভাবেই। কারণ, বাংলাদেশের দায়িত্বশীলরাই নিজ মুখে বলেছেন, ভারত তাদের নির্বাচন করতে সহায়তা করেছে। কেউ তো বলে ফেলেছেন, পশ্চিমাদের চাপ সামলেছে ভারতই। কিন্তু বর্তমান মোদি সরকারের সে চাপ সামলানোর ক্ষমতা সম্ভবত আর থাকছে না। বরং তারাই পড়বে উল্টো চাপের মুখে। সেই চাপে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সাথে ভারতের সম্পর্কের রসায়ন অনেকটাই পাল্টে যেতে পারে। 

অপরদিকে রয়েছে চীন। সমৃদ্ধ অর্থনীতির এই দেশটির হাতে রয়েছে অঢেল অর্থ। যে কারণে লোভী শাসকরা দেশটির দিকে সহজেই হেলে পড়ে। শ্রীলঙ্কার কথাই বলি, সেখানে অর্থের ফাঁদ পেতেছিল চীন, সেই ফাঁদে ধরা পড়েছিলো লোভী শাসকরা। তার পরিণতি সকলেরই জানা। 

কিন্তু সেখানের জনগণ শিক্ষিত ও সচেতন বলেই তারা তাদের দুরবস্থা দ্রুতই কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। তবে সব দেশই শ্রীলঙ্কা নয়। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব বলয় কমে আসছে ক্রমেই। মালদ্বীপের মতন একটা ক্ষুদ্র রাষ্ট্রও ভারত বিরোধিতায় টিকে আছে এবং তা ভালোভাবেই। সেখানের জনগণ স্পষ্টতই ভারতের বিপক্ষে। 

ভারতীয় থিঙ্কট্যাংকের সবচেয়ে বড় ভুল হলো প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের মনোভাব বুঝতে না পারা বা বুঝেও তা গায়ে না লাগানো। দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনোভাব স্পষ্টতই ভারতবিরোধী। আর সরকারের কথা বললে, একমাত্র বাংলাদেশের শাসকরাই ভারতের পক্ষে রয়েছে এবং তা দৃশ্যত। দৃশ্যত বললাম এ কারণে যে, চীনের রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরকে ‘গেম চেঞ্জার’ বলে উল্লেখ করেছেন। কূটনীতির ভাষায় ‘গেম চেঞ্জার’ শব্দটির মানে কিন্তু সুদূরপ্রসারী।

এখন ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কথা বলি। সংখ্যালঘু মুসলিম ও হিন্দু দলিত এবং অন্যান্য পিছিয়ে থাকা জাতিগোষ্ঠী এবার ইন্ডিয়া জোটের এই ভালো অবস্থানের কৃতিত্বের দাবিদার। এক্ষেত্রে ইন্ডিয়া জোটকে বাধ্য হয়েই তাদের পক্ষে কথা বলতে হবে। আর বিজেপি জানে এই ভোট আর তাদের দিকে ফিরবে না, তাই তারা নিজেদের বর্তমান অবস্থানটুকু ধরে রাখার জন্য বাধ্য হয়েই হিন্দুত্ববাদকে আরো জোর দিয়ে আঁকড়ে ধরবে। 

এই সুযোগটাই নেবে ইন্ডিয়া জোট। আর এক্ষেত্রে ইন্ডিয়া জোটের পক্ষে থাকবে পশ্চিমা মনোভাব। কারণ পশ্চিমারা ইতোমধ্যে পরিষ্কার করেছে বিজেপি সরকার সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ইস্যুতে ইন্ডিয়া জোট সোচ্চার হলে যেমন পশ্চিমা সমর্থন পাবে, তেমনি বিজেপি চাপে পড়বে তার দুই অনির্ভরযোগ্য বন্ধু তথা ডাবল ‘এন’ এর। অবস্থা বেশি ক্রুশিয়াল হয়ে উঠলে তারা সংখ্যালঘু ও দলিতের অজুহাত দিয়ে পল্টিও মারতে পারে। 

তবে শেষের কথা হলো, এগুলো সবই হাইপোথিসিস। সব যে ঠিক হবে এমন কথা নেই। কিন্তু সম্ভাবনার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না একেবারেই।  

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন