Logo
Logo
×

অভিমত

যুগে যুগে প্রতিরোধ

বাংলাদেশে ‘ইন্ডিয়া আউট’ কর্মসূচির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

Icon

জুনায়েদ এহসান

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৪, ০৭:২১ পিএম

বাংলাদেশে ‘ইন্ডিয়া আউট’ কর্মসূচির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ছবি: সংগৃহীত

ভারতে টানা তৃতীয়বারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে গতকাল শপথ নিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি, যা দেশটির সাম্প্রতিক ইতিহাসে বড় ধরনের এক অর্জন। তার এই শপথ অনুষ্ঠানে এমন একজন উপস্থিত ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথের ক্ষেত্রে যিনি মোদির চেয়ে আরও এক ধাপ এগিয়ে। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, চলতি বছরের শুরুতেই টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শপথ নিয়েছেন। 

মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের একদিন আগে শনিবার হাসিনা দিল্লি পৌঁছে প্রথম ‘বিশিষ্ট’ অতিথি হয়ে উঠেন।  নয়া দিল্লির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় এবং তাদের অন্যতম ‘মূল্যবান অংশীদারের’ এই সফর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বকে আরও দৃঢ় করবে বলে মন্তব্য করা হয়। 

যদিও মোদি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন বিরোধী শক্তিশালী জোটের সঙ্গে কঠিন লড়াইয়ে ভোট পেতে সুউচ্চ হিমালয় থেকে ঘন জঙ্গল চষে বেড়িয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালিয়েছেন এবং এর মাধ্যমে তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসা নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু হাসিনা যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফেরেন সেটিকে ‘ডামি নির্বাচন’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে। সেই নির্বাচনে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিরোধীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না।

 ‘ইন্ডিয়া আউট’ বাংলাদেশে ভারতবিরোধী রাজনীতি ও প্রতিরোধের স্লোগানে পরিণত হয়েছে।  অনলাইন এবং অফলাইন সব জায়গায় ভারতবিরোধী প্রচারে এই স্লোগান ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। ছবিটি মালদ্বীপের ভারতবিরোধীদের। তারাও একই স্লোগান ব্যবহার করছেন। দেশটিতে মুইজ্জু ‘ইন্ডিয়া আউট’কর্মসূচির প্রচারণা চালান এবং সেখান থেকে ভারতীয় সেনাদের প্রত্যাহার এবং ভারতের সঙ্গে নিরাপত্তা সম্পর্ক পর্যালোচনার আহ্বান জানান তিনি। 

একটা বদ্ধমূল বিশ্বাস আছে যে, মোদির সমর্থনের ফলেই সহজে হাসিনা ক্ষমতায় ফিরতে পেরেছেনে। এর পেছনে অবশ্য যুক্তিসঙ্গত কারণও রয়েছে। কারণ একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দিতে ঢাকার ওপর যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের তীব্র চাপ প্রশমনে নয়া দিল্লি সহায়তা করেছিল। 

এখন ঢাকার মসনদে নিজেদের পছন্দের প্রার্থী ধরে রাখতে নয়াদিল্লির ক্রমাগত হস্তক্ষেপে বাংলাদেশে যে ব্যাপক অসন্তোষ তা ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। তাই অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগে এই আন্দোলনের অংশ হিসেবে জনসাধারণকে ভারতীয় পণ্য বয়কট করতে দেখা গেছে। কারণ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশে প্রায় ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের রপ্তানি বাজার রয়েছে ভারতের। 

বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব নতুন কিছু নয়। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে ভারতের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে—বিশেষ করে নয়াদিল্লির সঙ্গে ঐতিহাসিক সম্পর্কযুক্ত আওয়ামী লীগ শাসনামলে ভারতের হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখে না।  

স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে আঞ্চলিক এই আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রান্তিক ও নিপীড়িত গোষ্ঠীর বারংবার উপেক্ষিত এ প্রতিরোধের ইতিহাসে চোখ ফেললে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ভেতরে ভেতরে ভারতবিরোধী মনোভাব সব সময় ছিল। মিশেল-রলফ ট্রুইলোটের ‘নীরব অতীত’ ধারণায় যেমনটা উল্লেখ আছে। 

শুরুর দিকের ভারতবিরোধী প্রতিরোধ

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভয়াবহ এক মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যদিও ভারতের কৌশলগত সমর্থন এই স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক ছিল। এমনকি সেই সমর্থন দুই দেশের মধ্যে অব্যাহত বন্ধুত্বের প্রত্যাশাও জাগিয়েছিল। তবে স্বাধীনতা উত্তর সময়ে দ্রুত সেই সম্পর্কের তিক্ততা দেখা দেয়।

ভারতীয় শাসকশ্রেণির মধ্যে থাকা আধিপত্যবাদী প্রবণতা, চলমান শোষণ এবং বাংলাদেশকে বগলদাবা অবস্থায় রাখার তথাকথিত আকাঙ্ক্ষা বাংলাদেশের জনগণ এবং জনগণের জন্য রাজনীতি করা নেতাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষের জন্ম দেয়।

ভারতীয় এই ধরনের সম্প্রসারণবাদের অন্যতম কট্টোর সমালোচক ছিলেন বিশিষ্ট রাজনীতিক মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি বাংলাদেশি প্রশাসনের ওপর ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এবং এর তথাকথিত প্রভাবের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।

ভাসানীর সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘হক কথা’ (১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর নিষিদ্ধ) মূলত সমসাময়িক ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণার শুরুর দিকের কণ্ঠস্বর হিসেবে কাজ করে। ম্যাগাজিনের বিষয়বস্তু ভারতবিরোধী মনোভাবের জন্য এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট সামনে নিয়ে আসে, যা পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশে বার বার ফিরে এসেছে এবং দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার জটিল এবং প্রায়শই বিতর্কিত সম্পর্ককে তুলে ধরে।

হক কথা ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতীয় হস্তক্ষেপের সমালোচনা করেছে।  ১৯৭২ সালের ২ জুনে হক কথা একটি নিবন্ধ প্রকাশ করে। নিবন্ধটিতে ‘বাংলাদেশের প্রতিরক্ষাকে পঙ্গু করতে ভারত-রাশিয়ার ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ করা হয় এবং সেটিতে ব্যঙ্গাত্মকভাবে ভারতের পরিকল্পনা মন্ত্রীকে বাংলাদেশের ‘অনানুষ্ঠানিক প্রধানমন্ত্রী’ বলে উল্লেখ করা হয়। একই বছরের ২১ জুলাই প্রকাশিত আরেকটি নিবন্ধে দাবি করা হয়, বাংলাদেশ সরকার ভারতকে তুষ্ট করার জন্য দেশে ভারতীয় প্রভাবের বিরুদ্ধে ভিন্নমত দমন করাসহ নানা কাজ করছে।

১৯৭২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর মওলানা ভাসানী এক ভাষণে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের জন্য ভারতকে দায়ী করে বলেন, ‘পাকিস্তান ২৫ বছরে যা লুট করেছে ভারত গত ৭-৮ মাসে তার চেয়ে বেশি লুট করেছে।’ ভারতের পদক্ষেপের সঙ্গে যে দেশের দুরাবস্থার যোগসূত্র রয়েছে বাংলাদেশের তৎকালীন সরকার বরাবরই তা অস্বীকার করেছে। সরকারের এই অস্বীকারকে মওলানা ভাসানী বারবার চ্যালেঞ্জ করেছেন।

তখন ভারতবিরোধী মিছিলে ‘পাকিস্তানের পর ভারতীয় নিপীড়ক কেন?’ উক্তি ক্রমশ স্লোগানে পরিণত হয়। যা বাংলাদেশে ভারতের ভূমিকার প্রতি জনসাধারণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষকে সামনে নিয়ে আসে।  

ফারাক্কা লং মার্চ এবং ভাসানীর হুমকি

ভারতীয় আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের অংশ হিসেবে ১৯৭৬ সালের ১৬-১৭ মে ফারাক্কা বাঁধ মুখী বিশাল লং মার্চের নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাসানী । এই পদযাত্রায় প্রায় ৪ লাখ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল। গঙ্গা নদীর পানির (বর্তমানে পদ্মা) ন্যায্য বণ্টনের দাবিতে এই লং মার্চ করা হয়েছিল।

সেই লং মার্চে সমবেত জনতার উদ্দেশে সমাপনী বক্তৃতায় ভাসানী ভারতকে কড়া হুঁশিয়ারি দেন: যদি বাংলাদেশ তার ন্যায্য অংশ না পায় তাহলে তিনি দেশব্যাপী এবং আন্তর্জাতিকভাবে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেবেন। ১৯৭৬ সালের ১৮ মে আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত ভাসানীর ওই সাহসী ঘোষণা তৎকালে ভারতীয় নীতির বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র মনোভাবকেই তুলে ধরে। 

১৯৭৬ সালের ১৮ মে প্রকাশিত আজাদ। 

১৯৭৬ সালের ১৮ মে আজাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভাসানী বলেছেন,  ‘গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য বণ্টন নিশ্চিত করতে আট কোটি বাংলাদেশি তার শেষ রক্ত বিন্দু পর্যন্ত লড়বে। ’

লং মার্চটির বিরুদ্ধে ভারতের সতর্কতা সত্ত্বেও ভাসানী তার জায়গায় অটল ছিলেন এবং ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমরা কোনো শক্তির হুমকিকে ভয় করি না...এটি বড় শক্তির বিরুদ্ধে ছোট শক্তির প্রতিরোধ।’ যদিও সেই প্রতিবাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের পানির অধিকার নিশ্চিতের। তবে সেটি ভারতীয় জনসাধারণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে চেয়েছিল।

বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা এবং রেডিও অস্ট্রেলিয়ার মতো বিশ্বের প্রধান সংবাদমাধ্যমগুলোর কভারেজের ফলে লং মার্চটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মনোযোগ পেয়েছিল। চীন বাংলাদেশে দূতাবাস স্থাপনকারী প্রথম দেশ যারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় সেসময় জনগণের প্রচেষ্টার প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছিল। এছাড়া প্যারিসে ভারতীয় দূতাবাসের সামনেও বাংলাদেশি নাগরিক ও শিক্ষার্থীরা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করেছিল।

১৯৭৬ সালের মে মাসে তুরস্কে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সপ্তম ইসলামিক সম্মেলনেও বিষয়টি উল্লেখ হয়েছিল এবং ফারাক্কা ইস্যুটি গভীর উদ্বেগের বিষয় হিসেবে উত্থাপিত হয়। আর এসবই ফারাক্কা ইস্যুকে বিশ্বব্যাপী নজরে আনতে এবং বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে ভাসানীর প্রচেষ্টার সফলতা প্রমাণ করে। 

চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইকে চীন দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।’

ভারত বিরোধিতার বাস্তবতা মজ্জাগত

বাংলাদেশে চলমান ভারতবিরোধী মনোভাব এবং ঐতিহাসিক প্রতিরোধ আন্দোলন থেকে বর্তমান ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা বাংলাদেশি জনগণের সঙ্গে ভারতীয় নেতাদের সংযোগ স্থাপনের ধারাবাহিক ব্যর্থতাকেই সামনে নিয়ে আসে। 

বর্তমান বৈশ্বিক রাজনৈতিক দৃশ্যপটে আঞ্চলিক শক্তি হওয়ার আকাঙ্ক্ষার বোধগম্য। কিন্তু যখন এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা সাধারণ মানুষের জীবনকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করে এবং অযাচিত কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন প্রতিরোধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। তাই বাংলাদেশের মানুষের ভারত বিরোধিতা মজ্জাগত বাস্তবতা: এই জাতি তার কষ্টার্জিত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

সাম্রাজ্যবাদী বা একটি নব্য-ঔপনিবেশিক শক্তি হিসেবে ভারতের নেওয়া ভূমিকা বাংলাদেশে যে প্রতিরোধের মুখে পড়েছে সে সম্পর্কে দেশটির বোঝাপড়াকে জটিল করে তোলে। বাংলাদেশের জনগণের স্বতন্ত্র বিশ্বদৃষ্টি ও আকাঙ্ক্ষাকে স্বীকৃতি ও স্বীকার না করে ভারত এই প্রতিরোধের মূলে কি আছে তা বোঝার আশা করতে পারে না। এই প্রতিরোধের সারমর্ম উপলব্ধির জন্য, তাকে অবশ্যই এটি যে প্রেক্ষাপট থেকে তৈরি হয়েছে তার সন্ধান করতে হবে।

ইতিহাস জুড়েই বাংলাদেশের জনগণ মুক্তি, স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের জন্য তাদের কণ্ঠকে সব সবময় সোচ্চার করেছে এবং তাদেরকে নব্য-ঔপনিবেশিক বা বগলদাবা করার যেকোনো প্রচেষ্টাকে তারা দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ধারাবাহিকভাবে এই বার্তা তারা দিলেও ভারতের ক্ষমতার করিডোরের বধির কানে এটি ঢুকেছে বলে মনে হচ্ছে না। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন