Logo
Logo
×

অভিমত

নবযুগের বীর আর ভবিষ্যৎ শহীদদের খোঁজে চীন

Icon

ভিনসেন্ট কে এল চ্যাং

প্রকাশ: ১০ জুন ২০২৪, ১১:২১ এএম

নবযুগের বীর আর ভবিষ্যৎ শহীদদের খোঁজে চীন

‘জনগণের বীরদের স্মৃতিস্তম্ভ’, তিয়ান আনমেন, বেইজিং

সম্প্রতি চীনে হয়ে গেল ঐতিহ্যবাহী ‘ড্রাগন বোট ফেস্টিভ্যাল’। দেশজুড়ে চীনারা তাতে অংশ নিলেন। আর বিশ্বজুড়ে চীনা নাগরিকেরা এই প্রতিযোগিতা উপভোগ করলেন। লম্বা কাঠের নৌকার দৌড় দেখতে দেখতে তারা বাঁশপাতায় মোড়ানো গোল গোল চালের পিঠা খেলেন আর স্থানীয় বীরদের স্মরণ করলেন। যা তারা প্রতি চন্দ্রবর্ষের পঞ্চম মাসের পঞ্চম দিনে করেন। তবে এ বছর তার তাৎপর্য ভিন্ন ছিল।

এই বীরদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলেন কু ইউয়ান। তিনি একজন কবি এবং প্রাচীন চু রাজ্যের মন্ত্রী ছিলেন। তিনি বিদ্রোহী কিন রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের কথা বলে রাজার বিরাগভাজন হন। তাকে নির্বাসনে যেতে হয়। ২৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে চুর রাজধানী দখলের খবর শুনে তিনি পানিতে ডুবে আত্মহত্যা করেন।

চীনের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম কু ইউয়ানকে একজন ‘অনুগত রাষ্ট্রনায়ক ও দেশপ্রেমিক কবি’ হিসাবে চিত্রিত করেছে, যার চেতনা চীনা কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) ও চীনা জনগণকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে।

চীনা নেতৃত্ব সম্প্রতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, প্রাচীন বীরদের শুধু স্মৃতি তর্পণ করবে না তারা। সিসিপি যদি জাতীয় পুনরুজ্জীবন চায় এবং ২০৪৯ সালের মধ্যে পৃথিবীর সমাজতান্ত্রিক সুপারপাওয়ার হতে চায়, সেই সংগ্রামে বিজয় নিশ্চিত করার জন্য ‘বীর ও শহীদদের একটি নতুন প্রজন্মের জরুরি প্রয়োজন’।

২০৪৯ সালে সিসিপির ১০০ বছর পূর্ণ হবে। সেটা হবে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনেরও শতবর্ষ।

সামনে বিপজ্জনক ঝড়ের জন্য প্রস্তুতি

বলা হচ্ছে, ক্রমবর্ধমান ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা চীনা অভিজাতদের অতীতের ব্যবহার উদ্ভাবন করতে বাধ্য করছে। গত অক্টোবর চীন-যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে চীন তার ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করে, যা ছিল পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতা, পশ্চিমের সাথে আদর্শিক উত্তেজনা ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৯ সালের পূর্ববর্তী বার্ষিকীতে বলেছিলেন, ‘কোনো শক্তিই চীনা জনগণ ও জাতিকে অগ্রসর হতে বাধা দিতে পারবে না।’ তার সেই ঘোষণা ক্রমবর্ধমান চাপের মধ্যে এসেছে।

চীনের নেতা সম্প্রতি যেমনটি বলেছেন, ‘তীব্র বাতাস, ঝড়ো জল ও বিপজ্জনক ঝড়ের’ মুখোমুখি হয়ে সিসিপি এই বার্তার উপর জোর দিচ্ছে যে, ‘চীনা জনগণকে এই জটিল চূড়ান্ত পর্যায়ে কেবল এক হয়ে দাঁড়াতে হবে না, বরং প্রস্তুত থাকতে হবে। সর্বদা জাতীয় আনুগত্য এবং ত্যাগের চেতনার আহ্বান জানাতে হবে জনগণকে।’

কিভাবে বীর ও শহীদদের নতুন প্রজন্ম সৃষ্টি হবে

শি বলেছেন, ‘একটি প্রতিশ্রুতিশীল জাতি বীর ছাড়া এগিয়ে যেতে পারে না’ এবং ‘কেবল বীরদের সম্মান করলেই অন্য বীররা আবির্ভূত হবেন।’

চীন সরকার ২০১৪ সালে শহীদ দিবস চালু করে। এমনকি ২০১৮ সালে ‘বীর ও শহীদ সুরক্ষা’ আইন জারি করে৷ এ বছর সরকার ঐতিহ্যবাহী ‘জনগণের বীরদের স্মৃতিস্তম্ভ’ (তিয়ান আনমেন, বেইজিংয়) নতুন করে সাজায় এবং একে ব্র্যান্ড হিসেবে ব্যাপক প্রচার চালায়।

বিভন্ন উপজাতিতে বিভক্ত চীনে গোত্রীয় নেতা ও পারিবারিকভাবে পূর্বপুরুষদের বংশানুক্রমে শ্রদ্ধা জানানোর সংস্কৃতি রয়েছে। কিন্তু এখন সরকার শুধু নিজের পূর্বপুরুষ ও বিদেহী আত্মীয়দেরই নয়, জাতীয় শহীদদের অনুগত আত্মা ও বীরত্বপূর্ণ আত্মাকেও সম্মান জানানোর প্রচার চালাচ্ছে। বেইজিং এই ধারণাটি প্রচার করছে যে, নিজের পূর্বপুরুষ ও জাতির মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।

কু ইউয়ান ২৭৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তার রাজার বিরোধিতা করে নির্বাসিত হয়েছিলেন। কিন্তু মাও সে তুং ১৯৪৯ সালে দমনমূলক শাসনকে উৎখাত করতে যুদ্ধ করেছিলেন। মাও বিপ্লবী উদ্যমে ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে শক্তি-সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন এবং গ্রামীণ গেরিলাদের কাজে লাগিয়েছিলেন।

বিপরীতে, শি জিনপিংয়ের চীন ক্রমবর্ধমান সচ্ছল, নগরায়ণ ও স্থিতাবস্থা-ভিত্তিক নাগরিকদের মধ্যে দেশপ্রেমিক বীর ও সম্ভাব্য শহীদদের লালন-পালন করে অস্তিত্ব সুরক্ষিত করতে চায়।

আধুনিক দিনের বীর ও শহীদরা হলেন সঠিক দিকনির্দেশনাকারী ও সুসমন্বয়কারী

২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চীনের নবম শহীদ দিবস উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানে স্বয়ং শি জিনপিং সিসিপির সিনিয়র নেতাদের জাতির শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নেতৃত্ব দেন। লাইভ টেলিভিশন সম্প্রচারের সময় শিকে উদ্ধৃত করে বলা হয়েছিল, শান্তির সময়ও একটি জাতির তার বীরদের প্রয়োজন হয় এবং ‘আধুনিক দিনের বীর ও শহীদরা হলেন সঠিক দিকনির্দেশনাকারী ও সুসমন্বয়কারী’। এই নতুন শহীদদের উদাহরণ হলো তরুণ স্বেচ্ছাসেবক, প্রথম প্রতিক্রিয়াশীল ও সৈন্য যারা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে লড়াই, দুর্যোগে উদ্ধার কাজ বা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের সময় তাদের জীবন দিয়েছেন।

গ্লোবাল চীন এবং বিদেশী বন্ধু

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিশ্বজুড়ে চীনা দূতাবাস ও কনস্যুলেটগুলি বিদেশে ঐতিহাসিক সংঘাতের সময় নিহত চীনাদের আনুষ্ঠানিকভাবে স্মরণ করছে, যার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে, কোরিয়া ও ভিয়েতনামে যুদ্ধের শহীদরা রয়েছেন। সার্বিয়ায় ১৯৯৯ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বোমা হামলার সময় শহীদদের মধ্যে চীনা প্রকৌশলী ও শ্রমিকরাও অন্তর্ভুক্ত যারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্য এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপে অবকাঠামো নির্মাণ বা সাহায্য করার সময় জীবন দিয়েছেন।

একই সঙ্গে বেইজিং চীনে বিদেশি বীর ও বন্ধুদের স্মৃতি পুনরুজ্জীবিত করে চলেছে। এমনকি চীনের প্রধান হুমকি ও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে বিবেচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা এর মধ্যে আছেন। গত বছর শি ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন সেনাবাহিনীর জেনারেল জোসেফ স্টিলওয়েলের বংশধরদের কাছে চিঠি লিখেছিলেন, যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন বাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার ও আমেরিকান স্বেচ্ছাসেবক গ্রুপের সদস্য ছিলেন। 

এসব চিঠির প্রধান বার্তা হলো, চীন শুধু নিজের জনগণের জন্য নয়, বরং বিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধিতেও সমান বিশ্বাসী।

ড. ভিনসেন্ট কে এল চ্যাং, সহকারী অধ্যাপক, আধুনিক চীনের ইতিহাস ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, লেইডেন ইউনিভার্সিটি।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: banglaoutlook@gmail.com

অনুসরণ করুন