ধ্রুব রাঠি। ছবি : সংগৃহীত
ধ্রুব রাঠি -২৯ বছরের এক সাধারন যুবক। ইউটিউবিং করেন ২০১৪ থেকে। গড়পড়তা ইউটিউব চ্যানেল থেকে তার মান অনেক উন্নত। ভারতীয় মান বিবেচনায় তার চ্যানেল সেরা বা ১ থেকে ৩-এর মধ্যেই থাকবে। তিনি যে শুধু রাজনীতি নিয়ে আলাপ করেন তা নয়। তার আলোচনার ডাইভার্স অনেক টপিক আছে। যেমন, তিনি বিবর্তনবাদ নিয়ে কনটেন্ট করেন; আবার মালয়েশিয়ান ফ্লাইট কেন কিভাবে হারায় গেলো সেটা নিয়েও ভিডিও করেন।
তিনি যতোটা শিক্ষিত আর স্পষ্টভাষী, তার চেয়ে বেশি হলো তার দূরদর্শী চিন্তা, তার দৃঢ়বিশ্বাস আর তার রিসার্চ বা সম্পাদকীয় টিম।
তার টিমে আইনজীবী পর্যন্ত আছে। কারণ তার প্রতিটি ভিডিওর চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়। ধ্রুব তার প্রতিটি কথার পেছনে প্রমাণ নিয়ে ব্যাখা বিশ্লেষণ করেন। তার সবচেয়ে বড় শক্তি, তিনি সাধারণ কথ্য হিন্দিতে অনেক জটিল ব্যাপার সরলভাবে বোঝাতে পারেন।
যাহোক, এই গেলো তার পরিচয়। তার অনেক সমালোচনা দেখছি ফেসবুকে, একে একে সেগুলো এড্রেস করছি। অবশ্য আমার নিজেরও তার ব্যাপারে কিছু সমালোচনা আছে। আর ভারতীয় রাজনীতি কাভার করা ভালো ইউটিউবার তিনিই একমাত্র নন। এইরকম বেশ কয়েকটা চ্যানেল আছে, যেগুলো আমি গত ১০ বছরে দেখেছি। আসেন আলোচনা শুরু করি -
১.
আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম এটা ভেবে যে, একটা ছেলে তার অনলাইন এক্টিভিজম দিয়ে ভারতের মতো বিশাল একটা দেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছেন। শত হাজার কোটি টাকার মিডিয়া সামাজ্যে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, ৮০ লাখ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা ছিড়ে ফেলে ভারতীয় মানুষকে তার দেশের সঠিক অবস্থা জানাতে পেরেছেন। অনেক সেন্সিবল মানুষকে দেখলাম বলতে রাঠি না কাঠি, সে কে ইত্যাদি ইত্যাদি। যদি প্রশংসা করতে না পারেন, অন্তত মুর্খের মতো মুখ না খুলে প্লিজ চুপ থাকেন বা অন্য কোন ইস্যু নিয়ে কথা বলেন। নিদেনপক্ষে জানার চেষ্টা করেন, ছেলেটা সত্য বলেছে না মিথ্যা বলেছে? বাংলাদেশের অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের এমন করুণ দশা দেখে আমার বিরক্তি তো লেগেছেই, কিছুটা বিস্মিতও আমি।
২. কথা হচ্ছে, ধ্রুব রাঠির অনলাইন ইনফ্লুয়েন্সের কারণেই কি মোদি ম্যাজিক খতম হয়েছে? কট্টর হিন্দুত্ববাদের জয়যাত্রা খতম হয়েছে?
উত্তর হচ্ছে না, এইরকম শত শত অ্যাক্টিভিস্ট আছে। তাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ভারতের বিরোধী জোটের একটা বড় ভূমিকাও আছে। তারা তাদের ভুলগুলো শুধরে নিয়েছে। নিজেদের স্ট্র্যাটেজি সাজিয়েছে। অনেক লিমেটেড রিসোর্স নিয়ে কাজ করেছে, কিন্তু আশা হারায়নি। এটা ভারতীয় জনতার জয়। ধ্রুব রাঠি একটা উল্লেখযোগ্য ভুমিকা পালন করছেন, যেটা যেকোন গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে প্রশংসনীয়।
৩. একটা ব্যাপারে সঠিক সমালোচনা হচ্ছে, যে পয়েন্টে আলোচনা করা দরকারি, সেটা হচ্ছে- বিরোধী জোট বাংলাদেশের ধ্রুব রাঠিদের ঠিকমত ব্যবহার করতে পারছে না। কিন্তু বাংলাদেশের ধ্রুব রাঠি থাকলে কিছুই করতে পারতেন না -এটা ডাহা মিথ্যা কথা। বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ নাকি আগেই কনভিন্সড, স্রেফ ভোট হচ্ছে না বলে বাংলাদেশের মানুষ দেখিয়ে দিতে পারছে না।
দেখেন, ভারতীয় জনগণ আর বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তফাত শুধু ধর্মে। বাকি সব এক। আপনি সারা ভারত ঘুরে দেখতে পারেন, আপনার মনে হবে আপনি বাংলাদেশেই আছেন। বাংলাদেশের মানুষ কেন নির্বাচন হচ্ছে না কেন সেটা নিয়ে মাঠে নামছে না, বা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তিত না কেন? বাংলাদেশের মানুষ যদি এতো কনভিন্সিড হয় তো ইলেকশন কমিশন, বিচার ব্যবস্থা ইত্যাদি ধ্বংস করার পরও কোন কাজ হয়নি কেন? ভারত তো একই পদ্ধতিতে হাটছিলো। এই ইলেকশনের আগের তাদের নেতাদের ধরপাকড় চলছে, কংগ্রেসে ব্যাংক একাউন্ট সিজ করা হয়েছে, ইলেকশন কমিশনে মোদির লোক নিয়োগ দেয়া হয়েছে, এমনকি ইলেকশনে ভোট চুরির চেষ্টা করেছে কিছু কিছু এলাকায়।
আমাকে ধ্রুব রাঠির মতো একটা ভিডিও দেখান যেখানে একজন তথ্যপ্রমাণসহ বিস্তারিত সবকিছু দেখাচ্ছে? যেটা দেখলে এটা মনে হবে এভিডেন্স হিসাবে ব্যবহার করা যায়? বাংলাদেশে কিছু কাজ যে হচ্ছে না এমন না, কিন্তু সবই খণ্ডিত। যেমন ধরেন- গুম হত্যা, ক্রসফায়ার, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মামলা হামলা ইত্যাদির ডকুমেন্টেড তালিকা নিয়ে একটা ভিডিও দেখান। আপনারা আমাকে এই আর্টিকেল সেই আর্টিকেল দিবেন। কিন্তু কোন ৩০ মিনিটের ভিডিওতে আপনি দেখাতে পারবেন না যেখানে প্রতিটা বিষয় নিখুঁতভাবে মেলানো হয়েছে।
প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের মানুষ যদি এতো কনভিন্সড হয়, তাহলে তারা গণতন্ত্রের জন্য মাঠে নামছে না কেন? উত্তর হচ্ছে, বাংলাদেশের মানুষ বিরোধী দল বা বিএনপি যে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য গণতন্ত্র চায়, সেটার জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত না। তারা কনভিন্সড না যে, বিএনপি এসে ভালো কিছু করতে পারবে। তো বাংলাদেশের মানুষের কনভিন্সড হওয়ার থিওরি ধোপে টেকে না।
৪. ধ্রুব রাঠি একজন সেক্যুলার মানুষ, সম্ভবত কালচারাল হিন্দু। তার ফ্যাক্টবেইজড তথ্যগুলো, তার কথা সাধারন মানুষ নিয়েছে। গ্রামীণ ভারতে বিজেপি পরাজিত হয়েছে। এখন কথা হলো ভারতের মানুষ বাংলাদেশের মানুষের মতোই ধার্মিক। তারপরও তাদের ভাষায় তাদের বুঝিয়েছে ধর্মকে ব্যবহার করার অসারতা। ধ্রুব রাঠিকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলা হয়েছে, তার পরিবারের নামে মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয়েছে, তাকে জার্মান শেফার্ড বলা হয়েছে। কিন্তু তিনি তাকে শাহবাগী ট্যাগ দিলো না দিলো এটা নিয়ে থেমে থাকেননি।
৫. কিছু ইসলামিস্ট জামাতি দেখলাম বলছে, ধ্রুব রাঠি কংগ্রেস, আম আদমি পার্টির লোক। তাকে বিশ্বাস করা যাবে না। ধ্রুব রাঠিকে বিশ্বাস করতে বলেছে কে? তার তথ্যগুলো সত্য না মিথ্যা এটা হলো আসল ব্যাপার। আর তিনি শত শত কনটেন্ট বানিয়েছেন, এর মধ্যে অনেক কনটেন্টের টপিক বা তার মতামত আপনার পছন্দ না-ই হতে পারে। সে কারণে তাকে পুরোপুরি বাতিল করে দিতে হবে? এটা চরম মুর্খামি।
আর কোনো হিন্দু বা সেক্যুলারকে অভিবাদন জানানো জামাতি/ইসলামিস্টদের কাছে কুফরির মতো একটা ব্যাপার। এরা এটা মানতেই পারে না। বিশ্বাস না হলে পরিচিত জামাতিদের জিজ্ঞেস করে দেখেন, কোন হিন্দু আছে যাকে তারা শ্রদ্ধা সম্মান করে, পছন্দ করে? দেখেন উত্তরটা কী পান।
আর আম আদমি পার্টি কোন পার্টি না, এটা তো এইরকম কথা যে বিএনপি করে তাই তাকে বিশ্বাস করা যাবে না। অদ্ভুতরে যুক্তি।
৬. ধ্রুব রাঠি অখন্ড ভারত চান, এটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। তিনি একটা ভিডিও করেছিলেন যদি সারা উপমহাদেশ এক থাকতো তাহলে কী হতো, তা নিয়ে। থট এক্সপেরিমেন্ট। আমার হিন্দুত্ববাদী, ভারতীয় অগ্রাসন নিয়ে এ্যালার্জি আছে, আমি খুব সহজেই এসব ফিল্টার করতে পারি। তার মধ্যে সুক্ষভাবে হলেও যদি দেখতাম ভারতীয় অগ্রাসন বা দখলদারী মনোভাব আছে, তাহলে সেটা আমি আরও আগেই পয়েন্ট আউট করতাম। ধ্রুব রাঠি ভারতীয় ইউনিয়নের কথা বলেছে, ইউরোপিয় ইউনিয়ন স্টাইলে।
জিয়াউর রহমান আঞ্চলিক উন্নতির জন্য সার্ক করেছিলেন। বাংলাদেশ আর পাকিস্তানে যদি গণতন্ত্র রিস্টোর হয়, আর ভারতীয় সদিচ্ছা থাকলে ভারতীয় ইউনিয়ন এই অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করে দিবে। তবে সেটা অনেক দূরের আলাপ।
৭. আগেই বলেছি, ধ্রুব রাঠিকে ফলো করার বা তাকে পীর মানার বা তাকে সত্যবাদী যুধিষ্ঠির ভাবার কোনো কারণ নেই। তাকে আমার একটা সাধারণ ছেলে বলে মনে হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তার খুব বেশি গভীর জ্ঞান নাই এমনও মনে হয়। আমি অনেক ব্যাপারে তার চেয়ে অনেক বেশি জানি, আবার অনেক ব্যাপারে তার চেয়ে কমও জানি। যে কারণেআমি লিখেছি, বাংলাদেশের ধ্রুব রাঠিরা চাইলে ধ্রুব রাঠির চেয়ে অনেক ভালো কনটেন্ট বানাতে পারেন। বাংলাদেশের ধ্রুব রাঠিরা চাইলে বাংলাদশের রাজনীতিতে আরো অনেক বেশী ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারেন।
কিন্তু আগেই বলেছি, আমাদের মধ্যে ইগো অনেক বেশি, আমরা অনেক বেশি বিভাজিত। আমরা এখনও বিগার পিকচার দেখতে অভ্যস্ত না। আমরা ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য বৃহৎ স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে একমুহূর্ত দ্বিধা করি না। আর এটা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কথা বলছি না। দীর্ঘদিনের অ্যাক্টিভিজমের কারণে আমার সহযোদ্ধাদের বেলায় বলছি।
৮. আগের মতো এ্যারোগেন্ট না বলে, নাম ডেকে ডেকে আমাদের অ্যাক্টিভিস্টগুলোর স্বরুপ আপনাদের দেখাতাম। টু লিটল টাইম টু ডু দোজ ফিউডস। এতো উৎসাহ আর সময় পাই না।
৯. সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তার কোনো ভিডিও না দেখে, তাকে না চিনে, তার সম্পর্কে না জেনে, তাকে বাতিল করে দিচ্ছে। মানে, জানে তো না-ই, জানার কোনো ইচ্ছাও নাই। আরও আজিব হচ্ছে, একটু যেন জেলাসিও দেখতে পেলাম। বাঙালী জাতির মন আমি আজো বুঝতে পারলাম না। ধিক্কার দিন আমাকে।
১০. ধ্রুব রাঠির বিষয়ে আমার সমালোচনা- ধ্রুব রাঠি বাংলাদেশ সীমান্ত বা পানি বন্টনের প্রসঙ্গ আসলে ভারতীয় গীতই গাইবেন। এটা অনেকটা পশ্চিমাদের মতো প্রগ্রেসিভ আনটিল ইসরায়েল। প্রগ্রেসিভ আনটিল ভারতীয় স্বার্থ। এটা মাইনর ইস্যু। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে আমি বাংলাদেশের স্বার্থই দেখবো সবার আগে।