Logo
Logo
×

অভিমত

বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের বিতর্কিত ভূমিকা ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে

সাইমুম পারভেজ

সাইমুম পারভেজ

প্রকাশ: ০৬ জুন ২০২৪, ০২:৪০ এএম

বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের বিতর্কিত ভূমিকা ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে

২০২৪ সালে বাংলাদেশে একটি ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা দেখা যাচ্ছে, যার উদ্ভব হয়েছে দেশের সংসদ নির্বাচনে ভারতীয় হস্তক্ষেপকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া ব্যাপক ক্ষোভ থেকে। সমালোচকরা দাবি করেছেন, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ক্ষমতাসীন দলের জয় নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচনী কারচুপিতে সহযোগিতা করেছিল। কেউ কেউ মনে করেন যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিতর্কিত চতুর্থ টানা জয়ের পর ভারতীয় হস্তক্ষেপ আরো তীব্র হয়েছে, যার ফলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে অসন্তোষ বেড়েছে।

বাংলাদেশ ২০২৪ সালে একটি 'ইন্ডিয়া আউট' বয়কট আন্দোলন প্রত্যক্ষ করছে। এ বছরের ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভারতীয় হস্তক্ষেপের অভিযোগে এই আন্দোলন শুরু হয়, পরবর্তীতে যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হয়। এই আন্দোলনে বাংলাদেশিদের আমদানিকৃত ভারতীয় পণ্যর বদলে স্থানীয় পণ্য বেছে নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের টানা চতুর্থ জয়ের পর ভারতের প্রতি অসন্তোষ তীব্র হয়েছে। কম ভোটার উপস্থিতি, বিরোধী দলের বয়কট এবং 'ডামি প্রার্থীদের' উপস্থিতি (ক্ষমতাসীন দলের সমর্থিত স্বতন্ত্রদের উপস্থিতি) ছিল এই নির্বাচনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক সবসময় যে খারাপ ছিল তা নয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতীয় সমর্থন উল্লেখযোগ্য ছিল, তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং অনিয়মিত অভিবাসীদের সাথে আচরণ থেকে শুরু করে বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা এবং তীব্র ক্রিকেট প্রতিদ্বন্দ্বিতার মতো ব্যাপারে মাঝে মাঝে উত্তেজনাও দেখা দিয়েছে।

উত্তেজনার আরেকটি উৎস-বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত, যা বিশ্বের অন্যতম প্রাণঘাতী সীমান্ত। ২০০০ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে, ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে জড়িত ঘটনার কারণে কমপক্ষে ১ হাজার ২৫৩ বাংলাদেশি প্রাণ হারিয়েছেন এবং ১১৫৭ জন আহত হয়েছেন।

২০২৪ সালের মতো, নির্বাচনের আগে একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়োগের প্রথা প্রত্যাহার করার আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে প্রধান বিরোধী দলগুলো ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল। বিরোধী দলের বয়কট সমসাময়িক বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক, যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এক দশক ধরে চলা গণতন্ত্রকে পশ্চাৎপদ করার প্রক্রিয়াকে চিহ্নিত করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ব্যতীত সমস্ত দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণকারীরা ২০১৪ সালের নির্বাচন প্রক্রিয়ার বিষয়ে একমত হওয়ার চেষ্টা করছিল। এ সময় ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং বাংলাদেশ সফর করেন এবং বিরোধী জাতীয় পার্টিকে (জাপা) নির্বাচন বয়কট থেকে বিরত থাকার জন্য চাপ দেন। জাপার অনিচ্ছুক অংশগ্রহণ নির্বাচনকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বিরোধিতা এবং বৈধতা প্রদান করেছিল।

এরপরে ২০১৮ সালের নির্বাচনে, বর্তমান আওয়ামী লীগ একটি 'সুষ্ঠু' নির্বাচনী প্রক্রিয়ার আশ্বাস দিয়েছিল, যাতে আশ্বস্ত হয়ে বিরোধী দলগুলো এতে অংশ নেয়। এই প্রতিজ্ঞা লঙ্ঘন করে, ভয়ভীতি, গ্রেপ্তার, নির্যাতন, জোরপূর্বক গুম এবং বিরোধী ব্যক্তিদের ওপর করা হামলা নির্বাচনকে কলুষিত করে। কোনো কোনো সরকারের সমালোচক দাবি করেছেন যে, একটি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ২০১৮ সালের নির্বাচনী কারচুপির কৌশলগুলোকে সহায়তা করার ক্ষেত্রে ভূমিকা পালন করেছিল। তৃতীয় বারের মতো ২০২৪ সালের নির্বাচনে ভারতীয় হস্তক্ষেপ নিয়ে সন্দেহ ও অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে বিরোধীদের ব্যাপক আন্দোলন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখার জন্য পশ্চিমা চাপ (যার মধ্যে আছে মার্কিন ভিসা বিধিনিষেধ) ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের আগে চাপে ফেলে।

ভারতীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতীয় নীতিনির্ধারকরা নির্বাচনের আগে ওয়াশিংটনের অবস্থানে অসন্তুষ্ট ছিলেন। এসব প্রতিবেদনে দাবি করা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শেখ হাসিনার শাসনকে অস্থিতিশীল করে তুলবে এবং ভারত ও দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের মতে, ভারত তাই মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এড়াতে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ‘আন্ডারহ্যান্ড আলোচনায়’ লিপ্ত হয়েছিল। নির্বাচনের পর কাদের মন্তব্য করেন, ‘বিএনপি যখন অন্য দেশের সহায়তায় জাতীয় নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করেছে, তখন ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং ভালো প্রতিবেশীর মতো আচরণ করেছে।’

গত তিনটি কারচুপির নির্বাচনে ভারতের ভূমিকা প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, "২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে ‘ষড়যন্ত্র’ হয়েছিল, কিন্তু ভারত বাংলাদেশের পক্ষে ছিল।" ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রচার চলাকালে একজন প্রার্থী সরাসরি মন্তব্য করে বসেন যে, "আমি শেখ হাসিনার প্রার্থী, আমি ভারতের প্রার্থী।"

অন্য কোনো দেশের নির্বাচনকে প্রভাবিত করা সবসময় একটি গোপন কারবার। বিশেষ করে যদি এই কাজে বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা জড়িত থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারতীয় মিডিয়ার রাজনৈতিক নেতা, বিশেষজ্ঞ এবং সাংবাদিকদের বাংলাদেশে ভারতীয় হস্তক্ষেপের খোলাখুলি আলোচনা বাংলাদেশে ভারতবিরোধী তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়। প্রথমে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা শুরু হয়। প্রধান বিরোধী দল, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের অনেক নেতা-কর্মী এটিকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেও দলটি আনুষ্ঠানিকভাবে এটিকে এখনো সমর্থন দেয়নি। তা সত্ত্বেও, এএফপি পরিচালিত এক ফ্যাক্ট চেকার এর দেওয়া হিসাবে পাওয়া গেছে, ১০টিরও বেশি ভারতীয় মিডিয়া আউটলেট দাবি করেছে যে, বিরোধীরা দল বিএনপি বয়কট আন্দোলন শুরু করেছে। এর সাথে সাথে ভারতের কিছু প্রচারমাধ্যমে 'ইন্ডিয়া আউট' প্রচারণার বিশ্লেষণে দেখা যায় যে এই বয়কটকে "উগ্র ইসলামপন্থি", "পাকিস্তানপন্থি এবং ভারত-বিরোধী" বিএনপির উদ্যোগ হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে।

ভারতীয় ভাষ্যকার এবং নীতিনির্ধারকরা বিশ্বাস করেন যে বাংলাদেশে ভারত বয়কট মালদ্বীপের অনুরূপ আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে, এবং তারা সন্দেহ করেন এর পেছনে চীনের পৃষ্ঠপোষকতা আছে। এই জল্পনা-কল্পনাগুলো কখনো চীন, কখনো পাকিস্তান, কখনো উগ্রবাদীদের দোষারোপ করলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার উল্লেখ করতে ভুলে যায়। আর তা হলো বাংলাদেশের জনগণ। বাংলাদেশের জনগণ গত তিনটি নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এই ক্ষোভ থেকেই যে ভারতের প্রতি অসন্তোষ তৈরি হতে পারে সে বিষয়ে বিশ্লেষণ ভারতের মিডিয়ার দেখা যায় না।

আদতে ইন্ডিয়া বয়কটের এই আন্দোলনটি তরুণ, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট, সুশীল সমাজ এবং বামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। বিপরীতে, কিছু প্রভাবশালী ইসলামপন্থি দলগুলো আসলে ‘ইন্ডিয়া আউট’ নিয়ে নীরব রয়েছে। এমনকি একটি রক্ষণশীল ইসলামপন্থি দল, বাংলাদেশ ইসলামি ফ্রন্ট, ইন্ডিয়া বয়কটের প্রচারণা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দিয়েছে। প্রধান ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীও এই আন্দোলন নিয়ে নীরবতা লক্ষণীয়।

যথাযথ ম্যান্ডেট ছাড়াই ক্ষমতায় থাকা সরকারের প্রতি ভারতের সমর্থন এবং ভূ-রাজনৈতিক ইস্যুগুলি ভারতের প্রতি বাংলাদেশের জনগণের অসন্তোষকে বাড়িয়ে তুলেছে। তাই এই ক্ষোভকে শুধু "কট্টরপন্থি ইসলামপন্থিদের" আন্দোলন হিসেবে চিত্রিত করা হলে, তা সংকটের মূলকে চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হবে। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে এই ক্ষোভকে সঠিকভাবে বুঝতে না পারলে তা ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও খারাপ করবে।

ভারতীয় আমদানির ওপর বাংলাদেশের নির্ভরশীলতার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই ভারত বিরোধী প্রচারণার সম্ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ২০২২ সালে এই আমদানির পরিমাণ ছিল ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি। ভারতীয় পণ্য বয়কট অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের প্রাপ্যতা এবং মূল্যের পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পর্যটন খাতকে প্রভাবিত করবে। ভারতের রপ্তানি বাজারের মাত্র ৩.৫ শতাংশই বাংলাদেশের। ভারতীয় ভোক্তা পণ্য এবং পর্যটনকে কার্যকরভাবে বয়কট করলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পর্যটন, বিনোদন এবং ভোগ্যপণ্যের খাত গতিশীল হবে। 

বাংলাদেশে ইন্ডিয়া আউট প্রচারণার মূল তাৎপর্য তাই অর্থনৈতিক নয়, রাজনৈতিক। 'ইন্ডিয়া আউট' ক্যাম্পেইনটি ভারত এবং সারা বিশ্বে বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান ভারত-বিরোধী মনোভাবের বার্তাটি স্পষ্টভাবে পৌঁছে দিয়েছে- আর এটিই এই ক্যাম্পেইনের অন্যতম সফলতা। 

সাইমুম পারভেজ, পিএইচডি, বেলজিয়ামের ফ্রাই ইউনিভার্সিটি ব্রাসেলস এর রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের গবেষক। 

(অস্ট্রেলিয়ান থিংক-ট্যাঙ্ক ইস্ট এশিয়া ফোরামে প্রকাশিত নিবন্ধের ভাষান্তর)

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন