Logo
Logo
×

অভিমত

ভারতের নির্বাচন: ধর্মান্ধতার অন্ধকার ও আশার আলো

কাকন রেজা

কাকন রেজা

প্রকাশ: ০৫ জুন ২০২৪, ১১:৪৯ পিএম

ভারতের নির্বাচন: ধর্মান্ধতার অন্ধকার ও আশার আলো

বিজেপি অর্থাৎ হিন্দুত্ববাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে এবং দুর্নীতি নির্মূলের কথা বলে। মানুষও তাদের কথা বিশ্বাস করেছিল। তার সাথে যোগ হয়েছিল ভারতের বিশাল অংশের মানুষের সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা। ভারতের নির্বাচন ও রাজনীতি নিয়ে কথা বলার আগে সাম্প্রদায়িকতার কথাটা সেরে নেই। আমি সামাজিক মাধ্যমে ‘ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশ ও ধর্মান্ধ ভারত’ কথাটি লিখেছিলাম। 

তাতে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিলেন ভারতের পশ্চিমবাংলার এক কবি বন্ধুসহ অনেকে। আমি সেই তাদের পার্থক্যটা দেখিয়েছিলাম এভাবে যে, আমাদের দেশে সকল ধর্মীয় দল মিলেও ত্রিশটি আসনে জিতে আসা সম্ভব নয়। অপরদিকে ভারতে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি দল হিসেবে সবচেয়ে বড়। বিজেপি এককভাবে পেয়েছে ২৪০টি আসন। বিপরীতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ২৩৩ আসন। হিসেবটা কী দাঁড়ালো, বিজেপি একাই একটা জোটের চেয়ে বেশি আসন পেয়েছে। বিজেপি ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে সিদ্ধহস্ত, এ বিষয়টা আমরা, অর্থাৎ বাংলাদেশের মানুষেরা সবচেয়ে ভালো উপলব্ধি করতে পারি। কারণ মোদির প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড কোনটা ছিল, সেটা সারাবিশ্ব জানে। 

প্র্যাকটিস গ্রাউন্ডের কথা থাক, প্লে গ্রাউন্ডের কথা বলি। মূলকথা হলো, পুরো ইন্ডিয়া জোট একক বিজেপিকে ধরতে পারছে না। বাংলাদেশের সাথে ভারতের পার্থক্যটা মূলত এখানেই। সে কারণেই মোটা দাগে বলেছিলাম, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ এবং ভারতের ধর্মান্ধ। না, হলে যে ব্যক্তি নিজেকে ঈশ্বরের প্রেরিত ভাবেন। বায়োলজিক্যাল মনে করেন না, এমন একটি মানুষকে এবং এমন মানুষের দলকে এত ভোট দেয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। 

আমরা জানি, ভারতেও শুদ্ধজন রয়েছেন, যারা বিভাজনের পুরোপুরি বিপক্ষে, তারাও ব্যর্থ হয়েছেন বিজেপির প্রথম হওয়াকে ঠেকিয়ে দিতে। পশ্চিমবঙ্গে হয়তো বিজেপি খারাপ করেছে, কিন্তু দ্বিতীয় অবস্থানটা কিন্তু তাদেরই। শাসক দল হিসেবে ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যর্থতম দল বিজেপি। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সবদিক থেকেই ব্যর্থ, কিন্তু তারপরেও সারাদেশে একক বৃহত্তম এবং পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয়। সুতরাং হিসেবে পশ্চিমবঙ্গেরও বিশাল সংখ্যক মানুষ ধর্মান্ধ এবং এই সত্যকে অস্বীকার করার কোনো জো নেই। 

এখন আসি এবারের ভোটের কথায়। যে বিজেপি ২০১৪ সালে দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলে, মানুষকে চাকরি দেবার ভরসা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিল, সে বিজেপির প্রতি আশাভঙ্গ হয়েছে অনেকের। বিশেষ করে তরুণরা বিমুখ হয়েছে বিজেপির প্রতি। এই বিমুখ ভোট, যাকে আমরা ফ্লোটিং তথা ভাসমান ভোট বলতে পারি, তাদের সবাই যে সাম্প্রদায়িক নন সে কথাও কিন্তু দিব্যি কেটে বলা যায় না। তাদের ভোট এসেছে হতাশা থেকে, কিন্তু তারাও মনেপ্রাণে হিন্দুত্ববাদী। 

সুতরাং ভারতে হিন্দুত্ববাদ ঠেকানো ভীষণ কঠিনএকটা ব্যাপার। সে কারণেই মোদির জয় ঠেকাতে সব দলকে জোট বাঁধতে হয়। বিপরীতে বাংলাদেশের কথা বলি, এখানে সব ধর্মীয় দল যদি মিলেও যায়, তবু ভোটের হিসেবে প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়া তাদের পক্ষে পুরোপুরি অসম্ভব। এখানে মুসলিমরা ধর্মের ভিত্তিতে ভোট দেয় না। তারা হয়তো পীরের ওরসে শরিক হয়, ওয়াজে যায় বিপুল সংখ্যায় কিন্তু ভোটের বেলায় তাদের এই ধর্ম অনুরাগের প্রকাশ ঘটে না। 

অর্থাৎ তারা ধর্মকে ভোটের হিসেবের অনেকটাই বাইরে রাখেন। এখানেই বাংলাদেশের সাথে ভারতের দৃশ্যমান পার্থক্য। অবশ্য এখানে হিজাব, বোরকার সাথে অনেকেই ধর্মান্ধতাকে মিলিয়ে ফেলেন। এ নিয়ে উচ্চকিত হন। আমাদের এখানে মিলিয়ে ফেলার এই ক্ষুদ্র অংশটি মূলত নামে প্রগতিশীল। এরা সংখ্যায় কম কিন্তু গলার আওয়াজে রীতিমতো মাইকের সমতুল্য। সুতরাং এদের আওয়াজে মনে হয় দেশটা বোধহয় ধর্মান্ধতে ভরে গেছে। এরা এমনি প্রগতিশীল, হিজাব যে ইসলাম আসার আগেই অন্য নামে এ উপমহাদেশেই প্রচলিত ছিল এ কথাটা জানেন না। স্কার্ফ আর হিজাব যে প্রায় পাশাপাশি এ ব্যাপারটিও তাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। 

প্রগতিশীল নামক এসব অর্বাচীনদের কথা থাক। ফিরি ভারতের ভোট ও ভোটের রাজনীতিতে। ভারতে এবারের নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট পেয়েছে মোট ২৯৩টি আসন। আর কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়া জোট পেয়েছে ২৩৩টি আসন। ফারাক হলো ৬০ আসনের। 

আগেই বলেছি, বিজেপির ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং এর কথা। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ। সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো দাঁড়িয়ে গেছে। আমাদের মতন হাঁটুভাঙ্গা অবস্থা নয়। সুতরাং সেখানে শতভাগ ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং সম্ভব নয়। তবে মোদিজি একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে যতটা স্বৈরতান্ত্রিক হওয়া সম্ভব তা করতে কোনো কসুর করেননি। দুই মুখ্যমন্ত্রী গ্রেপ্তার তারই নমুনা। কংগ্রেসের ব্যাংক হিসাব জব্দ তারই নজির। 

কিন্তু তারপরেও ভারতে নির্বাচন হয়েছে, মানুষ আগ্রহ করে ভোট দিতে গিয়েছে। যা আমাদের এখানে প্রায় অসম্ভব একটা ব্যাপার। যেদিন লিখছি সেদিনও দেশে উপজেলা নির্বাচন হচ্ছে। গণমাধ্যমে খবর দেখলাম, একটি কেন্দ্রে দুই ঘন্টায় পড়েছে পাঁচ ভোট। অতএব ভারতের নির্বাচনে যতই ইঞ্জিনিয়ারিং হোক, ভোটটা অন্তত হয়েছে, মানুষ ভোট দিতে গেছে এবং দিতে পেরেছে। অতএব ভারতের নির্বাচনী ফলাফলকে নজর আন্দাজ করার মতন কোনো কারণ নেই। এ ফলাফল ভারতের ধর্মান্ধতার দৃশ্যমানতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করতে পারেনি। 

তবে এটাও অস্বীকার করার জো নেই, এ নির্বাচন নতুন এক ভারতের জেগে উঠার সম্ভাবনা জানান দিচ্ছে। বিশেষ করে ভারতের তরুণ প্রজন্ম ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। রাহুল গান্ধী কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত যে পঁয়তাল্লিশ হাজার কিলোমিটারের পথযাত্রা করেছিলেন, তার ফল ফলেছে কিছুটা হলেও। ভারতের বিশাল জনগোষ্ঠী যারা মোদির স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে ভীত ও পর্যুদস্ত ছিল তাদের ঘুরে দাঁড়াবার আশাটা জাগিয়ে তুলেছে এই পথযাত্রা। ভারতের এই নির্বাচন তাই ঘুরে দাঁড়ানোর নির্বাচন। এই নির্বাচন শুধু ভারতের জন্য আশা জাগায়নি, আশা জাগিয়েছে প্রতিবেশী দেশগুলোর মানুষের মনেও। সে আশা ঘুরে দাঁড়ানোর আশা। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন