Logo
Logo
×

অভিমত

ইহুদিরা ইসরা‌য়েল রাষ্ট্র যদি চীনে গড়ত, কী হ‌তো

১৯৩৯-৪০ সালে কী হয়েছিল চীন ও আমেরিকায়

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৪, ১১:১৪ এএম

ইহুদিরা ইসরা‌য়েল রাষ্ট্র যদি চীনে গড়ত, কী হ‌তো

৭ মার্চ, ৯৩৯। চীনের শীর্ষ আইন প্রণয়ন কর্মকর্তা সান কে সরকারের সিভিল অ্যাফেয়ার্স অফিসে একটি জরুরি বার্তা পাঠান। ন্যাশনাল ডিফেন্সের সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য হিসাবে তিনি আগ্রাসী জাপানিদের বিরুদ্ধে চীনকে যুদ্ধের সুযোগ দেওয়ার জন্য উপায় খুঁজতে এর আগে দুই বছর সময় ব্যয় করেন। এবার সান কে তার সহকর্মীদের একটি আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন বিষয়ে ব্রিফ করলেন। সেটা হল ‘ইহুদি জনগণের দুর্দশা’।

‘নিজেদের দেশ না থাকায় ইহুদিরা সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগের শিকার। ২৬০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তারা দেশহীন, গৃহহীন হয়ে আছে,’ সান কে লিখেছেন, হিটলারের ইহুদি নির্মূল পরিকল্পনা সামনে আসার আগে। সান লিখেছেন, ‘ব্রিটিশরা ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে একটি স্থায়ী বন্দোবস্ত চায়। এতে আরবরা তীব্র বিরোধিতা করেছে এবং সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে, যা এখনও কমেনি।’

সান কে বিশ্বাস করতেন যে, তার নিজের দেশে উপযুক্তভাবে আশ্রয় পেতে পারে ইহুদিরা। তবে তা সাংহাইতে নয়। কারণ সেখানে ইতোমধ্যেই ২০ হাজার ইহুদি পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে। চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় হিমালয় পাদদেশে সেটা হতে পারে। সেটা হচ্ছে ইউনান। একটি সীমান্ত প্রদেশ, যার দক্ষিণে লাওস এবং পশ্চিমে বার্মা। ইউনান একটি অস্বাভাবিক নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর দেশ, যেখানে আছে অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং পর্যাপ্ত অনাবাদি জমি। এটা হিটলারের নাৎসি অত্যাচার থেকে পালিয়ে আসা এক লাখ ইহুদির জন্য যথেষ্ট। তাহলে ইহুদিবিরোধী সহিংসতা থেকে মুক্ত হবে ইতিহাস।


গত ৮৫ বছরে সেই পরিকল্পনার কথা বেশির ভাগ মানুষই ভুলে গেছে। সে সময় জায়নবাদ (ইহুদিদের ইসরায়েলে ফেরার তত্ত্ব) বিষয়ে চীনের অবস্থান আজকের মতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। কিন্তু গত বছর ৭ অক্টোবর থেকে চলমান ইসরায়েল-হামাস যুদ্ধ বেইজিংকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। একটি উদীয়মান পরাশক্তি হিসাবে বেইজিং তার নতুন অবস্থান গণনায় নেবে তা স্বাভাবিক।

সে কালে কেমন ছিল চীনের অবস্থা ও অবস্থান? কেন সান কে এমন প্রস্তাব দেন?

সান কের যুক্তিটি খুব সহজ ছিল। যদি চীন ইউরোপের নির্যাতিত ইহুদিদের আশ্রয় দেয় তাহলে জাপানিদের বিরুদ্ধে চীনকে সমর্থন দেবে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র। সত্যিই কি চীনকে সহযোগিতা করবে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্র? সান কে লিখেছেন, ‘ব্রিটিশ অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে যে বণিক/ব্যাঙ্কারররা, তাদের অনেকেই ইহুদি। তাই এই প্রস্তাবটি ব্রিটিশদের আমাদের (চীনের) প্রতি অনুকূল মনোভাব পোষণ করতে প্রভাবিত করবে।’

সান কে বিশ্বাস করতেন যে, অর্থনৈকিভাবে পিছিয়ে থাকা ইউনানন প্রদেশে ইহুদিদের কাছ থেকে নেওয়ার মতো কিছু ছিল। তাছাড়া ইহুদিরা অল্প সময়ের মধ্যে জাপানের বিরুদ্ধে চীনকে যুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে উদ্বাস্তু ইহুদিরা তাদের ‘দৃঢ় আর্থিক পটভূমি এবং অনেক প্রতিভা’ দিয়ে চীনকে একটি মহান জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। 

সান কের যুক্তি আলবার্ট আইনস্টাইনের মতোই প্রতিধ্বনিত হয়েছিল। তার আগে, ১৯৩৪ সালের জানুয়ারিতে, মরিস উইলিয়াম নামে ব্রুকলিনের একজন দন্তচিকিৎসক (এবং পলিটিক্যাল থিংকার) একটি চিঠি লিখেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইনকে। চিঠিতে তিনি ইহুদিদের চীনে পুনর্বাসনের জন্য তার ধারণা উপস্থাপন করেন। তারপর আইনস্টাইন এক চিঠিতে মরিস উইলিয়ামকে বলেন, মরিসের বন্দোবস্ত প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পশ্চিমা দক্ষতা, জ্ঞান ও বিজ্ঞান চীনের উপকারে আসবে।

ঐতিহাসিক রেকর্ডে উইলিয়াম যে পরিকল্পনাটি ১৯৩৫ সালে আইনস্টাইনের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন এবং তার পাঁচ বছর পর ১৯৩৯ সালে সান কে যে প্রস্তাব করেছিলেন তাদের মধ্যে কোনো সরাসরি যোগসূত্র নেই। তবে মরিস উইলিয়ামের ধারণা ও সান কের প্রস্তাবে মধ্যে মিল রয়েছে অনেক। 

এটা কি কাকতালীয়?  মোটেই না। 

সান কের এই প্রস্তাবের পেছনে ছিল চীনের কুওমিনতাং পার্টির নেতাদের সঙ্গে আমেরিকান ইহুদিদের হৃদ্যতা (কুওমিনতাংয়ের বাংলা হতে পারে ‘চীনের ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, যারা চীনের মূল ভূখণ্ড ১৯২৭ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত শাসন করেছিল। মাও সে তুংয়ের কমিউনিস্ট পার্টির উত্থানের আগ পর্যন্ত)।

তাছাড়া মরিস উইলিয়ামের খ্যাতি ও আমেরিকায় চীনা রাষ্ট্রদূত সেজের (Szeming Sze) সাথে সান কের চিঠিপত্র—উভয়ই ইঙ্গিত করে যে, সান কে প্রভাবিত হয়েছিলেন। 


সে সময় চীন সরকারের কেউ কেউ সন্দেহ করেছিল যে, ইহুদি উদ্বাস্তু ইস্যুটা ঠিক কাঁটার মতো হতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক করেছিল যে, চীনে ইহুদিদের শাসন করা সম্ভব হতে পারে অল্পদিনের জন্য, দীর্ঘমেয়াদে নয় এবং ইহুদিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রতিহত করা খুব কঠিন হয়ে উঠবে। 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। ‘পশ্চিমা ফ্যাসিস্ট দেশগুলি ক্রমাগত অভিযোগ করছে যে, চীন একটি একটি কমিউনিস্ট রাষ্ট্র,’ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা লিখেছেন, ‘এই সময় বিপুলসংখ্যক ইহুদিকে গ্রহণ করলে পশ্চিমা শত্রুদের অপপ্রচার ঠেকানো কঠিন হয়ে যাবে৷।’ সাধারণভাবে, ফ্যাসিবাদী তত্ত্বে, কমিউনিজম ও ইহুদিদের প্রায়ই এক কাতারে উল্লেখ করা হয়।

মন্ত্রণালয়-কর্মকর্তাদের এই বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রমাণিত হয়েছিল যে, পশ্চিমা সামরিক সহায়তা পাওয়ার জন্য ইহুদিদের গ্রহণ করাই উত্তম। সুতরাং ওই বছরই, ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে, কুওমিনতাং পার্টি সান কের প্রস্তাব অনুমোদন করে এবং ইউনান পরিকল্পনাটি চীন ও মার্কিন প্রেসে প্রচারও শুরু হয়।

যেহেতু ইহুদি বন্দোবস্তের প্রাথমিক আবেদন তার প্রচারমূল্যের মধ্যে নিহিত ছিল, তাই এর প্রতি সমর্থন ঘোষণা করাই আমেরিকানদের সহানুভূতি অর্জনের জন্য যথেষ্ট হতে পারে বলে কুওমিনতাং পার্টি মনে করেছিল।

মরিস উইলিয়াম যখন সান কের প্রস্তাবের কথা শুনেছিলেন তখন তিনি উত্তেজনায় ফেটে পড়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মরিসকে তার সহকর্মীরাও ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। কুওমিনতাং বোর্ডে গিয়ে তার মনে হয়েছিল তার ধারণাটি অবশেষে বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। কিন্তু যে মুহূর্তে উইলিয়াম সরকারি অর্থ চাইতে শুরু করলেন তখন বিষয়টা অন্যরকম দেখাতে লাগল।

ওদিকে আমেরিকায় ১৯৪৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রুজভেল্ট প্রশাসনের বৈদেশিক নীতি অভিবাসনবিরোধী মোড় নেয়। ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে হিটলার অস্ট্রিয়া দখল করার পর আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট জার্মানদের জন্য ২৭ হাজার ৭৩০টি ভিসার কোটা বজায় রেখেছিলল, কিন্তু ১৯৩৯ সালের জুন নাগাদ ভিসাপ্রত্যাশীদের অপেক্ষমাণ তালিকায় তিন লাখ ছাড়িয়ে যায়। সেই মাসেই সেন্ট লুই নামক একটি জাহাজ হামবুর্গ থেকে ৯৩৭ জন ইহুদি উদ্বাস্তুকে বহন করে আমেরিকার মিয়ামি বন্দরে হাজির হয়। মার্কিন অভিবাসন কর্মকর্তারা জাহাজটি জার্মানে ফেরত পাঠায়, যেখানে শত শত যাত্রীকে হলোকাস্টে হত্যা করা হয়েছিল।

এই পটভূমিতে মরিস উইলিয়াম ১৯৩৯ সালের আগস্টে স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করেন। কিন্তু আমেরিকা তখন মধ্য ইউরোপ থেকে চীনে এক লাখ শরণার্থী পরিবহনে খরচ দিতে অস্বীকার করে। প্রকল্পটির মাঝপথে মৃত্যু হয়।

সে সময় কুওমিনতাং পার্টির অবস্থান ঠিক কেমন ছিল তা অস্পষ্ট। তবে এটা অনেকটাই পরিষ্কার যে, ১৯৩৯ সালের যেসব আর্কাইভ পাওয়া যাচ্ছে সেখানে দেছি, ইউনান বসতি পরিকল্পনাকে ঘিরে সেকালে বেশ আকেটি কোলাহলময় আলোচনার জন্ম হয়েছিল। সাংহাইয়ে প্রেস কনফারেন্স, চংকিং থেকে বার্তা প্রেরণ, ওয়াশিংটনে মিটিং, আপত্তি, মূল্যায়ন, প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি অনেক কিছুই হয় সে সময়। কিন্তু ১৯৪০ সাল নাগাদ তার কিছুই আর অবশিষ্ট থাকে না।

শেষ পর্যন্ত, জাপান আমেরিকার পার্ল হারবারে হামলা চালিয়ে মার্কিন নৌঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। ক্ষুব্ধ আমেরিকা আণবিক বোমা তৈরিতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে এবং জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও গ্রেট ব্রিটেনকে সহায়তা করে কুওমিনতাং পার্টি। এই সহযোগিতা বা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে নিজের মৃত্যু ঘটায় চীনা কুওমিনতাং পার্টি। একই সময়ে ফুঁসে উঠতে থাকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি। তারা পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৯৪৯ সালে মাও সেতুং বেইজিংয়ে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। তখন সান কে ও তার কমরেডরা তাইওয়ানে পালিয়ে যান।

(ফরেন পলিসি ডটকমে প্রকাশিত হ্যারি সন্ডার্সের বিশ্লেষণ থেকে)

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন