Logo
Logo
×

অভিমত

বিরোধীদল নিধনের ‘পুরস্কার’ এবং আগাম দায়মুক্তির জনতুষ্টিবাদী ‘হ্যান্ডওয়াশ’ প্রোগ্রাম!

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব

প্রকাশ: ০৪ জুন ২০২৪, ০৫:৩৫ এএম

বিরোধীদল নিধনের ‘পুরস্কার’ এবং আগাম দায়মুক্তির জনতুষ্টিবাদী ‘হ্যান্ডওয়াশ’ প্রোগ্রাম!

বেনজীর আহমেদ। পুরনো ছবি

বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পত্তি নিয়ে আলাপ হচ্ছে, কিন্তু যেসব দায়িত্ব এবং অপরাধের বিপরীতে তার সম্পদ অর্জিত হয়েছে, সেসবের আলাপ অনুপস্থিত। অর্থাৎ তার দায়িত্বকালে বাংলাদেশের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং অপরাপর হতাহতের ঘটনাগুলো নিয়ে আলাপ দেখছি না।  হংকং ভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের তথ্যমতে, ২০০৯ সাল থেকে ২০২২ সালেল জুন পর্যন্ত ৬২৩ জন মানুষ গুমের শিকার হয়েছন। একই সময়ে কমপক্ষে ২৬৫৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। (ভয়েস অব আমেরিকা, ৮ অক্টোবর ২০২২)।  এই ঘটনাগুলোর উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই বাংলাদেশ পুলিশে বেনজীর আহমেদের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালনের সময়েই  হয়েছে।

‘বিশ্ব মানবাধিকার দিবস’ উপলক্ষ্যে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) যেসব প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, সেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বেনজীরের বিভিন্ন বড় বড় দায়িত্বে থাকাকালে গুমের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত ‘ক্রসফায়ার’, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘এনকাউন্টারের’ ঘটনাতেও নিহতের সংখ্যা দুই হাজারেরও বেশি। এসব মৃত্যুর ঘটনাকে বিচারবহির্ভূত হত্যা হিসেবে উল্লেখ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

বাংলাদেশে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েমের মূল পরিকল্পনা বাস্তবায়নকারীদের মধ্যে অন্যতম বেনজীর আহমেদ। কৌশলগত দায়িত্ব বাস্তবায়নের বিপরীতে বেনজীর আহমেদ পুলিশ প্রশাসন ব্যবহার করে অবৈধ অর্থ আয়ের সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করেছেন।    

২০১৪ সাল ৫ জানুয়ারি একতরফা নির্বাচনের আগে থেকেই ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ছিলেন। র‍্যাবের মহাপরিচালক পদে থেকে ২০১৮ সাল ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতের  নির্বাচন বাস্তবায়নকারীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। পুরস্কার হিসেবে তাকে পুলিশ মহাপরিদর্শক করা হয় এবং ২০২১ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও তাকে পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরানো হয়নি। এতে বেনজিরের প্রতি সরকারের শতভাগ সমর্থনের প্রমাণ মিলে।

বিগত এক দশকে দেশে হরতাল-আন্দোলন সহ আগের বছরগুলোর মতো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল না। তারপরও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি উদ্বেগজনক ছিল। গুম-খুন ও নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা ছিল বিরোধী দল নিধনের পরিকল্পিত অ্যাজেন্ডা। বেনজীর আহমদের বিপুল সম্পত্তি এসেছে নৃশংসভাবে বিরোধী নিধন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের 'কোল্যাটারাল গেইন' হিসেবে।  

রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগগুলো ক্রমাগত অস্বীকারের মাধ্যমে বেনজিরের অপরাধকে প্রশ্রয় দেয়া হয়। নাগরিকদের মত প্রকাশ ও সভা-সমাবেশের স্বাধীনতা সংকুচিত করতে বেনজিরের সক্ষমতাকে পুরস্কৃত করা হয়েছে বারংবার, ডিএমপি কমিশনার বানিয়ে, র‍্যাব প্রধান বানিয়ে, পুলিশ প্রধান বানিয়ে এবং জাতীয় শুদ্ধাচার সহ ৪/৫ বার পুরস্কার দিয়ে।

এমন ন্যারেটিভ উঠেছে যে, পর্যাপ্ত খাওয়া দাওয়ার সুযোগ দিয়ে এখন পালানোর সচেতন পথ দেয়া হল। সমকাল বলছে, ‘গত ২৩শে মে আদালত বেনজির আহমেদ ও তার পরিবারের সব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের আদেশ দিলেও আগেই টাকা সরিয়ে ফেলেন তিনি’। বেনজীরের সম্পদ তল্লাশির মাধ্যমে কিছু পপুলিস্ট ক্রেডিট বা জন্তুষ্টিবাদী বাহবা আসছে সরকারের পক্ষ।  

প্রকারান্তরে দেখা যাচ্ছে, সাবেক এই ডিএমপি কমিশনার, সাবেক এই র‍্যাব  প্রধান, সাবেক এই পুলিশ প্রধানের বিরুদ্ধে লোকরঞ্জনবাদী (পপুলিস্ট) উদ্যোগ নিয়ে সরকার আসলে গুম খুনসহ গুরুতর অপরাধ এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়মুক্তির পথ খুঁজছে। নিজেদের অ্যাজেন্ডা সফলভাবে বাস্তবায়ন শেষে তারা বেনজির প্রশ্নে 'হ্যান্ডওয়াশ' করছে। সরকার প্রয়োজনে কিংবা আমেরিকার চাপে বিভিন্ন বাহিনীর অফিসারদের বলির পাঠা করবে, এই আভাস এসে গেছে।

যৌক্তিকভাবেই মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়মুক্তির আগাম সতর্কতা হিসেবে এই 'হাত ধোয়া কর্মসূচি' বর্তমান পুলিশ বা প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের পথে বা লয়ালটি নষ্টের পথে ঝুঁকি তৈরি করছে কিনা এমন প্রশ্ন উঠেছে। 

বিরোধী দলের সামাজিক কর্মসূচি এবং কার্যকর আন্দোলনের অনুপস্থিতিতে সরকার প্রধান হয়ত মনে করছেন যে, উনার সরকারের চেইন অব কমান্ড এতই নিয়ন্ত্রিত যে এরকম দু-চার জনকে 'হ্যান্ডওয়াশ' প্রোগ্রামে ফেললে উনার অনুগত লোক খুঁজে পেতে সমস্যা হবে না। অর্থাৎ পাইপ লাইনে খরচের মত পর্যাপ্ত অফিসার আছে। তাই আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, সরকারের প্রধানের রক্তচাপ হয়ত তেমন উল্লেখযোগ্য বাড়াচ্ছে না। যেহেতু বিরোধীরা ঘটনাগুলোকে জনপরিসরে এবং সামাজিক আন্দোলনে নিয়ে পর্যাপ্ত 'এনক্যাশ' করতে পারছে না। বিরোধীরা জনস্বার্থ বিষয়ক রাজনৈতিক আন্দোলন করে না বলে, গণ অসন্তোষ ও দুর্নীতিবিরোধী সামাজিক আন্দোলন তৈরির সামর্থ্য রাখে না বলে এবং সামাজিক ইস্যুকে রাজনৈতিক আন্দোলনে কনভার্ট করার মোট মেধাবী নয় বলেই-  এসব থেকে ক্যাশ করতে পারে না। এতে সরকার অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ভঙ্গের মত পরিস্থিতিগুলো খুব ভালোভাবেই ম্যানেজ করতে পারে। ঠিক এ কারণে, বেনজীরদেরকে 'হ্যান্ডওয়াশ' প্রোগ্রামে ফেলার মাধ্যমে বর্তমান অফিসারদের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বেপরোয়া প্রসেসে কোন প্রভাব পড়বে না এবং সেটাও নতুন নতুন অপরাধের চক্র সচল রাখবে বলেই প্রতীয়মান।

১৫ বছরের মত একটা দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকার কারণে সরকারের ভেতরে বিভিন্ন স্বার্থের বলয় তৈরি হয়েছে, বলয়গুলো একে অপরের সাথে আর্থিক দ্বন্দ্ব, প্রভাব ও ক্ষমতা ভাগাভাগি এবং সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। সম্প্রতি এসব ঘটনায় এমপিও মারা গেছে। গৃহবিবাদ থামানোর জন্য কঠোর পদক্ষেপ আসবে এটা অনুমান করেছি যা প্রমাণিত হয়েছে। 

তথাপি মনে হয়, গুম খুন ও লেজিটিমেট রাজনৈতিক দল নির্মূলের মূল অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে কৃত অপরাধের বিপরীতে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিচার থেকে 'আগাম দায়মুক্তির হ্যান্ডওয়াশ প্রোগ্রাম' চলছে। এতে আরও কিছু অফিসারকে খরচের খাতায় ফেলে দেওয়া হতে পারে। আশা করি অপরাধগুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অফিসারগণ বিষয়টি অনুধাবন করবেন সময়মতো! বেনজীরদের বিপুল অবৈধ সম্পত্তি নৃশংসভাবে বিরোধীদল নিধনের 'কোল্যাটারাল গেইন', তাদের জনতু‌ষ্টিবাদী শাস্তি গুম-খুনের দায়মুক্তির ‘হ্যান্ডওয়াশ’ প্রোগ্রাম! দুর্নীতি দমন কিংবা সুশাসনের রাজনৈতিক সদিচ্ছাটা এখানে অসহায় নিরব দর্শক মাত্র!      

ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব : টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক এবং জননীতি বিশ্লেষক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য; উন্নয়নের নীতি ও দর্শন; ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, বেকারত্ব ও বিসিএস। ই-মেইল: [email protected]


Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন