অবিরাম লুটপাট, দুঃশাসন, গণতন্ত্রহীনতার চাপে পিষ্ট বাংলাদেশ। তবুও এই দেশ যে এখনো টিকে আছে এর একটা বড় কৃতিত্ব দেশের বাইরে অমানুষিক পরিশ্রম করে উপার্জন করা শ্রমজীবী মানুষদের। অথচ, সেইসব মানুষদের নিঃস্ব, প্রতারিত হওয়ার কান্নায় ভারী হয়ে উঠলো রাজধানী ঢাকা।
আবার বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য নিজেদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে মালয়েশিয়া। তবে, বন্ধ হওয়ার আগে শেষ দিন, ভিসা ও টিকেট থাকা সত্ত্বেও প্রায় ১৭ হাজার শ্রমিক সে দেশে যেতে পারেননি। আর এই ঘটনার দায় সরকারের ভুলনীতি ও দুর্নীতির।
মালয়েশিয়া ১৫টি দেশ থেকে শ্রমশক্তি নেয়। এর মধ্যে ১৪টি দেশ থেকে মালয়েশিয়া কর্মী নেওয়ার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট এজেন্সি বাছাইয়ের শর্ত দেয়নি। ওই সব দেশের সব এজেন্সি কর্মী পাঠাতে পারে। আর বাংলাদেশ থেকে কিছু এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর জন্য বাছাই করে দিয়েছে দেশটি। বাংলাদেশ এতে সায় দিয়েছে। আর সেই সুযোগেই দুই দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো মালয়েশিয়াগামী প্রত্যেক তরুণের কাছ থেকে পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। জমিজমা বিক্রি করে বিদেশ যাওয়ার আশায় থাকা এসব তরুণের অনেকে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে, কেউ বড়সড় ঋণের জালে আটকা পড়ে গেছে।
গত ১৫ বছর ধরেই বাংলাদেশের অন্যতম বড় শ্রমবাজার মালয়েশিয়া চারবার নানা অভিযোগে এদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করলো। মূলত প্রতিবারই শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে চক্র বা সিন্ডিকেটের অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
সর্বশেষ মালয়েশিয়া ২০২২ সালে শ্রমবাজার খোলার আগে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সমঝোতা স্মারক সই করে। তখন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় সব এজেন্সির জন্য কর্মী পাঠানোর সুযোগ উন্মুক্ত রাখার ওপর জোর দেয়নি; বরং তারা এজেন্সি নির্ধারণের দায়িত্ব দেয় মালয়েশিয়াকে। বাংলাদেশের এজেন্সি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনো মানদণ্ড ছিল না। সুযোগটি নিয়েছে মালয়েশিয়ার কর্মী নিয়োগের ফরেন ওয়ার্কার্স সেন্ট্রাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (এফডব্লিউসিএমএস) সফটওয়্যার মাইগ্রামের মালিক প্রতিষ্ঠান বেস্টিনেট। এটির মালিকানায় রয়েছেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমিনুল ইসলাম বিন আবদুল নূর। তিনি মালয়েশিয়ার নাগরিক, আমিন নূর নামে পরিচিত।
এই নূরের চক্রে জড়িত সরকারে ঘনিষ্ঠ কিছু মানুষ। অন্তত চারজন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে এই চক্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, যাদের মধ্যে আছেন সাবেক একজন অর্থমন্ত্রীও। এছাড়াও বহু আওয়ামী লীগ নেতা ও তাদের পরিবারের লোকজন এই চক্র থেকে বিপুল অর্থ উপার্জন করে আসছে। এদের প্রভাবেই এজেন্সি নির্ধারিত হয় কোনোরকম নীতিমালা ছাড়াই।
মালয়েশিয়া যে আবার শ্রমবাজার বন্ধ করলো তাই শুধু না, এইসব সিন্ডিকেটের প্রতারণার শিকার হয়ে অনেক বাংলাদেশিকে সে দেশে গিয়েও ভুয়া কাগজপত্রের কারণে স্বদেশে ফিরতে হয়েছে। এইভাবে সরকারি সিদ্ধান্তের অক্ষমতা এবং দুর্নীতি বাংলাদেশের একটি বড় শ্রমবাজারকে হুমকির মুখে ফেলে দিলো। যেসব মানুষ বিদেশে গিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে নিজেদের ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন দেখে তাঁদের আরো একটি রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হলো।
দেশে এখন বিনিয়োগের পরিবেশ নাই, অর্থনীতির অবস্থা ভঙ্গুর, এরমধ্যে এলো এই আঘাত। ক্ষমতাসীনদের সীমাহীন দুর্নীতির চাপ দিন দিন এদেশের জন্য অসম্ভব পর্যায়ে চলে যাচ্ছে।