ধোঁয়া ও ধুলো : বৈরুত থেকে ঢাকা কত দূর
আমাদের উপলব্ধির ক্ষমতা আসবে কি
তুহিন খান
প্রকাশ: ৩১ মে ২০২৪, ১২:১০ পিএম
বৈরুত, লেবানন
‘মনে হচ্ছে বিশাল একখণ্ড বাদামি মেঘ শহরের মাথার ওপর গম্বুজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দিনের বেলাও শহরটাকে প্রায় অন্ধকার করে রেখেছে সেই মেঘ। বৈরুতে বেশির ভাগ দিন এমনই থাকে।’ দ্য গার্ডিয়ান ডটকমে লিখেছেন লেবাননের সাংবাদিক অ্যাবি চিজম্যান।
প্রায় চার হাজার ডিজেল-জেনারেটর লেবাননের শহরগুলিকে শক্তি জোগাচ্ছে৷ জেনারেটরগুলি সারাক্ষণ রাস্তার পাশ দিয়ে গো গো করে ধোঁয়া ছাড়ে। একই সঙ্গে শব্দ ও বায়ু দুটোকেই বিষাক্ত করে তোলে। সেই বাতাসে শ্বাস নিতে বাধ্য শহরের বাসিন্দারা।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ বৈরুতের বিজ্ঞানীদের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, লেবাননের এই রাজধানী শহরে গত পাঁচ বছরে ক্যান্সারের ঝুঁকি দ্বিগুণ বেড়েছে। কারণ এই সময়ের মধ্যে মানুষ ডিজেল জেনারেটরের উপর অত্যধিক নির্ভরশীল হয়েছে। এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন নাজাত সালিবা।
নাজাত সালিবা বলছেন, ‘বৈরুতের ক্যান্সার বিশেষজ্ঞরা এখন অনুমান করছেন যে ২০২০ সাল থেকে সাধারণ ক্যান্সারের হার বছরে ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছে। যাদের বয়স কম এবং যাদের টিউমার আছে তাদের ঝুঁকি বেশি। টিউমারগুলো আরও আক্রমণাত্মক হচ্ছে। ডিজেলের ধোঁয়ায় এমন হচ্ছে।’
২০১৯ সালে লেবাননের অর্থনীতিতে ধস নামে। দেশটির অস্থিতিশীল রাজনীতি সেই অর্থনীতি আরও পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। ফলে মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে সুখের সন্ধান করতে হচ্ছে, যা তাদের নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর দিকে, কিন্তু তাদের কিছু করার নেই যেন। বিশ্বব্যাংক বলছে, ১৮৫০ সালের পর থেকে সবচেয়ে বড় তিনটি বৈশ্বিক-সংকটের একটি লেবাননের অর্থনৈতিক সংকট, যা ২০১৯ সালের অক্টোবর আকার নিতে শুরু করে। এর পরের বছর দেশটির প্রধান গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে বিস্ফোরণ সেই সংকট আরও তরান্বিত করে এবং কোভিড মহামারি তাকে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে।
বাংলাদেশ ওই ধরনের সংকট দেখেনি। কোভিড সংকট সহজেই কাটিয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। এখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢালছে। তবু শহর থেকে ডিজেল জেনারেটর বিদায় হচ্ছে না। কোথায় সংকট?
ঢাকা
দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশের এসব বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত কথা বলছেন। শাসকশ্রেণির উদাসীনতা সরকারের কর্মকর্তাদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতাকে তারা দায়ী করছেন।
এখন দেখুন লেবাননের সাংবাদিক অ্যাবি চিজম্যান তার দেশ সম্পর্কে কী বলছেন। তার ভাষায়, ‘সরকার দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপগুলি কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। বাজেট হিমায়িত করেছে। বাজেট তছরুফ করেছে।’ এই কথা বাংলাদেশ সম্পর্কেও খাটে তা সবাই জানেন।
ঢাকার আবহাওয়া একসময় শুধু শীতকালে খারাপ থাকত। সম্প্রতি সারা বছরই খারাপ থাকছে। বেশির ভাগ এলাকায় জানালা-দরজা বন্ধ না করে ঘরে থাকা যায় না। ধুলো, ধোঁয়া, শব্দ—তিনটিই সমানে বেড়েছে, যা মানুষকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
গতকালও (৩০ মে) বায়ুদূষণে বিশ্বের ১০০টি শহরের মধ্যে ঢাকা ছিল দশম স্থানে। তার আগের দিন বিশ্বের ১১৮টি শহরের মধ্যে ঢাকা ছিল ষষ্ঠ অবস্থানে।
বায়ুদূষণে ক্যান্সার ছাড়াও আর কী হতে পারে?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ আতিকুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘মানসিক চাপ বা উচ্চরক্তচাপসহ মানবদেহের বহুমাত্রিক সমস্যার কারণ হিসাবেও বায়ুদূষণকে চিহ্নিত করে থাকেন অনেকে।’
তিনি বলেন, বায়ুদূষণের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে সর্দি, কাশি, মাথাব্যথা, অ্যালার্জি, বমি, শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানিসহ শ্বাসযন্ত্রের অন্যান্য রোগ। এর কারণে ফুসফুসের ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে। ঢাকা শহরের বায়ুদূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেশি বয়স্ক ও শিশুরা। বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর পদার্থ আছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিসা। এটা শিশুর মানসিক বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের শিশুরোগীদের রক্ত পরীক্ষায় ৮০ এমজি/ডিএল থেকে ১৮০ এমজি/ডিএল সিসা পাওয়া গেছে, যা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে ১৬ গুণ পর্যন্ত বেশি। আর ঢাকা শহরে পরিবহন খাতের শ্রমিকদের রক্তে প্রায় ২০০ এমজি/ডিএল সিসার উপস্থিতি বিদ্যমান।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি গবেষণার বরাতে বলেন, বায়ুদূষণে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। ক্রমবর্ধমান সিসাদূষণ মানবদেহের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রান্ত করে। কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্ট করে। সিসাদূষণের কারণে শিশুরা বড়দের তুলনায় তিন গুণ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঢাকার বাতাসের মাধ্যমে বিভিন্ন অণুজীব/ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ছে জানিয়ে তিনি বলেন, এ কারণে অ্যালার্জি, গলায় ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, চোখের রোগসহ প্রতিনিয়ত নানান রোগ ছড়াচ্ছে। ডায়রিয়া ও কলেরার মতো পানিবাহিত কিছু রোগও বায়ুদূষণের কারণে হয়ে থাকে বলে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজীনীতিক যারা মানুষের জীবনযাপন নিয়ন্ত্রণ করেন, তার ঢাকার বায়ুদূষণ সম্পর্কে কী ভাবছেন? আদৌ কি কিছু ভাবছেন?
বৈরুতের সমস্যা বাড়ছে পাঁচ বছর ধরে। ঢাকার সমস্যা কত দিন আগে শুরু হয়েছে?
প্রায় দুই যুগ আগে ঢাকায় সিএনজি ব্যবহারের ওপর জোর দেয় সরকার। উদ্দেশ্য ছিল রাজধানীর বাতাস পরিষ্কার রাখা। কিন্তু সেই উদ্যোগ যতটা কাজে লেগেছে, তার চেয়ে অনেকগুণ বেশি দূষণ বেড়েছে অন্যান্য খাতে। সরকার সেদিকে নজর দেয়নি। এখানকার রাজনীতিকদের নজর দেওয়ার ক্ষমতাই দেখা যাচ্ছে না। বহু শোরগোল, ঝগড়া, কান্নকাটির পর তাদের কানে পানি যাবে হয়ত।