সর্বগ্রাসী দুর্নীতির লাগাম বনাম লোকরঞ্জনবাদের থাবা!
১৯৭৩ সংসদে ব্যবসায়ী ছিলেন ১৮%, আইনজীবী ৩১%। ২০২৪ সংসদে ব্যবসায়ী ৬৭%, আইনজীবী ৮%। এই সংসদের ১৯৯ জন আইন প্রণেতা ব্যবসায়ী। ১৪ জন কৃষিজীবী, ২৪ জন আইনজীবী এবং মাত্র ২৬ জন রাজনীতিবিদ।
এগুলা পেপারওয়ার্কে দেখানো পরিসংখ্যান (সূত্র- প্রথম আলো, জানুয়ারি ২০২৪, এবং নির্বাচন কমিশনের গেজেট)। রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ আজ ব্যবসায়ীদের ‘দখলে’।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণ ও এর প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা যে বিপুল সংখ্যায় সংসদে যাচ্ছেন, তাতে ইতিবাচক কিছু দেখছি না। একটি সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যদি ব্যবসায়ীরা সংসদে যেতেন, তাহলে কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী অসম সুবিধা নিয়ে সরকারের কাছাকাছি গিয়ে নিজেদের স্বার্থ পূরণ করছেন। জনপ্রতিনিধি হয়ে এসব ব্যবসায়ী ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীগত সুবিধার লক্ষ্যে টাকাপয়সা বানাচ্ছেন। তাঁরা অন্যায় বিশেষাধিকার নিচ্ছেন এবং এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই।’
রওনক জাহান আরও বলেন, ‘রাজনীতি ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে যে যোগসূত্র গড়ে উঠেছে, সেটার সুবিধা নিচ্ছেন কিছু ব্যবসায়ী। রাজনীতি বা সংসদে ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে তাঁরা নিজেদের সুবিধার জন্য নীতি তৈরি করছেন। ফলে এখন যাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্যে সিন্ডিকেট করছেন, কিংবা ব্যাংকে অনিয়ম করছেন বা ব্যাংক দখল করছেন, তাঁদের ধরা যাচ্ছে না। তাঁরা রাজনীতিতে প্রভাবশালী হওয়ার কারণে তাঁদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোনো সংস্কার করা যাচ্ছে না।’
বর্তমান দ্বাদশ জাতীয় সংসদে সর্বোচ্চ ১০ জন বাদে সংসদের বাকি ২৯০ জন প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে আওয়ামী লীগ দলীয়। বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ এমপিদের কেউ সীমান্তে বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানকারী, কেউ স্বর্ণ চোরাচালানকারী, হুন্ডি ব্যবসায়ী, কেউ মাদক পাচারকারী, মানব পাচারকারী, অনেকেই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রক, বাকিদের অধিকাংশই ঋণ খেলাপি। এবং প্রায় সবাই চাঁদাবাজ।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক, নমিনেশন বঞ্চিত সাবেক শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বলেন, 'বর্তমানে শতকরা ৮০ ভাগ নির্বাচিত এমপিই চোরাকারবারের সঙ্গে জড়িত।' (দেশ রূপান্তর, ২৪ মে ২০২৪)
বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে ঠেঙানো, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির মাধ্যমে সরকারি দলের জন্য পর্যাপ্ত 'আয়' তৈরির দীর্ঘ পরীক্ষায় উতরে, রাজ পরিবারের প্রভাবশালীদের সাথে বড় বড় লেনদেনের মাধ্যমে এসব দাগী অপরাধী, বাটপার স্মাগলাররা সংসদের নমিনেশন বা টিকিট পেয়েছে। সব শীর্ষ চোর বাটপারকে সংসদে নিয়ে তাদের নাম দিয়েছে 'আইন প্রণেতা'! এই এক বিচিত্র সার্কাস।
আইন প্রণয়নে নেই আইনজীবীরা, বুদ্ধিজীবী গবেষক, বিভিন্ন পেশার সাব্জেক্ট ম্যাটার এক্সপার্ট, পলিসি এনালিস্ট কিংবা অর্থনিতিবিদরা। আইন প্রণয়ন করছে চোরাচালানকারীরা, ঋণ খেলাপিরা, চাঁদাবাজ, মজুতদার সিন্ডিকেটরা এবং পাচারকারীরা। এমন জঙ্গলের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে?
আওয়ামী লীগ আন্তর্জাতিক সীমান্তে চোরাচালানে যুক্ত অপরাধীদের এমপি মনোনয়ন দেয়, এই অভিযোগটি আনার হত্যার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। এর আগেও দলটি আন্তর্জাতিক সীমান্তে মানব পাচারকারী এবং মাদক চোরাচালানকারীদের এমপি মনোনয়ন দিয়েছিল। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘মাদক মামলার মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত (অর্থ পাচার) বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে টেকনাফের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির দুই ভাই আমিনুর রহমান ও আবদুস শুক্কুরের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি।' এর বাইরেও টাঙ্গাইলের সাবেক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান ওরফে রানার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা আছে। প্রথম আলোর যুগ্ম-সম্পাদক সোহরাব হাসান এসব উদাহরণ সামনে এনে আক্ষেপ করেছেন, 'এই হলেন আমাদের জনপ্রতিনিধি, যারা দেশ ও জনগণের ভাগ্যনিয়ন্তা। ' (আজিজ, বেনজীর ও আজিম—এই তিনে যোগসূত্র কী, ২৯ মে ২০২৪)।
আজকে সরকারের ওপর দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নেয়ার অভ্যন্তরীণ চাপ আছে। দীর্ঘসময় ক্ষমতায় থাকার কারণে সরকারের ভিতরে বিভিন্ন স্বার্থের বলয় তৈরি হয়েছে, বলয়গুলো একে অপরের সাথে আর্থিক দ্বন্দ, প্রভাব ও ক্ষমতা ভাগাভাগি এবং প্রাণঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে।
এর মধ্যেই নিজেদের ফায়দা হাসিলে এক হাত দিয়েছে আমেরিকা। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সর্বশেষ বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু জানান, ‘দুর্নীতিরোধে বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে চায় ওয়াশিংটন’।(১৫ মে ২০২৪, বিডিনিউজ২৪)।
অর্থাৎ সরকারের ওপর নিজের এমপিদের অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণে দেশের ভিতরে বাইরে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। এমতাবস্থায়, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা প্রাপ্ত বেনজীরকে কিছুটা শাস্তির আওতায় এনে সরকারের তাৎক্ষণিকভাবে দুর্নীতির প্রশ্নে তৈরি হওয়া প্রেসার রিলিজের আয়োজন হতে পারে। কিন্তু ক্ষমতা হারানো কিছু কর্মকর্তার আগের করা দুর্নীতির বিরুদ্ধে একশন নেয়া লোকরঞ্জনবাদী উদ্যোগ। এটা দেশের বিদ্যমান পদধারীদের দুর্নীতি কমাতে সাহায্য করে না৷
বাংলাদেশের সাবেক পুলিশ প্রধান এবং সেনাপ্রধান সহ হাজার হাজার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জবাবদিহিহীন ক্ষমতাকাঠমো ব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পত্তি অর্জন করেছেন- এমন সংবাদ পত্রিকায় নিয়মিত। তাদের অনেকেই আবার খোদ প্রধানমন্ত্রী থেকে পদক ও সম্মাননা প্রাপ্ত। দেশের শীর্ষ দুর্নিতিবাজকে দেয়া হচ্ছে জাতীয় শুদ্ধাচার পুরস্কার। সম্প্রতি সরকারের বিশ্বস্ত সাবেক সেনাপ্রধানের উপর নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এসেছে, আগে নিষেধাজ্ঞা এসেছিল পুলিশ প্রধান ও র্যাবের উপর। এর অর্থ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশ বিভাগ এবং সেনাবাহিনীর অপমান ও অধঃপতন। বর্তমান অফিসাররা একই কাজ করছেন না, তার নিশ্চয়তা নাই। অতি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোর অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা এবং প্রাতিষ্ঠানিক মোরাল সব ভেঙে গেছে দুর্নীতি ও লুটের কাজে অফিসারদের ব্যবহার করতে করতে।
ক্ষমতায় থাকার সময় দুর্নীতি বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের সব চর্চা শেষে, ক্ষমতা ভোগ শেষে, সম্পদ তৈরি ও হস্তান্তরের দীর্ঘ কাল পরের কিছু অপর্যাপ্ত শাস্তি জনতুষ্টিবাদী উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করে, বাহিনীগুলোর দ্বারা ক্ষমতার অপব্যবহারের, মানুষের ভোগান্তি হয়রানি কমার, সেবার মান উন্নত হবার নিশ্চয়তা আসে না। বাস্তবতা হচ্ছে গণতান্ত্রিক অধিকার, জবাবদিহিতার অনুপস্থিতিতে, সিভিক স্পেইস এবং মিডিয়া ফ্রিডমের ব্যাপক সংকোচনে কর্তৃত্ববাদী সরকারের পক্ষে লোকরঞ্জনবাদের বাইরে গিয়ে সুশাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব, টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক এবং জননীতি বিশ্লেষক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ; বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর; অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা; বাংলাদেশের পানি, পরিবেশ ও বর্জ্য; উন্নয়নের নীতি ও দর্শন; ক্ষুদ্রঋণ, শিক্ষা, বেকারত্ব ও বিসিএস।