বাংলাদেশের জনগণ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের কর্মসূচিকে গ্রহণ করলেও তারা এখনও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মৌল দর্শনকে বুঝে উঠতে পারেনি। অপ্রিয় হলেও এটা সত্য যে, দেশের জনগণ এবং দলীয় কর্মীরা দূরে থাক, দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দও বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মৌল দর্শন ভালোভাবে বুঝে উঠতে পারেননি। এই বুঝতে না পারার পেছনেও অনেক কারণ রয়েছে। প্রধান কারণ হলো আমাদের দেশে কোনোদিন দর্শনভিত্তিক রাজনীতি হয়নি। আমাদের দেশে অতীতে যে রাজনীতি হয়েছে সেটা ছিল শুধু হুজুকভিত্তিক। যখন দেশে একটা ক্রাইসিস দেখা দিয়েছে, তখন বিভিন্ন পার্টির মধ্য থেকে কোন একটি পার্টি যার কিছু লিডারশিপ ছিল, কিছু সংগঠন ছিল এবং সাধারণত জনগণের মধ্যে সমর্থন ছিল সে পার্টি সে হুজুকে সকলকে টেক্কা দিয়ে সরকার গঠন করেছেন।
কিন্তু আজকে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন। আগের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। কারণ তখন আমরা স্বাধীন ছিলাম না। তাই স্বাধীনতার পরবর্তীতে আজকে আমাদের করণীয় কি? স্বাধীনতার পরবর্তী পর্যায়ে দুটো জিনিস জাতির পক্ষে অবশ্য করণীয় হয়ে পড়ে। প্রথমত, স্বাধীনতাকে সুদৃঢ় করা এবং দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলা। এখন এই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তুলতে হলে, একে জনগণের মাঝে পৌঁছে দিতে হলে, প্রয়োজন অর্থনৈতিক এবং সমাজ উন্নয়নমূলক কর্মসূচি প্রণয়ন এবং যথার্থভাবে এর বাস্তবায়ন। কিন্তু একটা দল গড়ে ওঠে একটি দর্শনকে ভিত্তি করে এবং সে আলোকেই গৃহীত হয় বিভিন্ন কর্মসূচি। সেই দর্শনকে যদি আমরা বুঝতে না পারি তবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন দূরে থাক সামান্য আঘাত আসলে তা সামলিয়ে উঠতে পারবো না। দলীয় দর্শন না বুঝবার যে দুর্বলতা তার ফলে আমরা অনেক জায়গায় মার খাচ্ছি এবং আপনাদের মধ্যে অনেকে বিপথগামী হয়ে লাইসেন্স-পারমিটের পেছনে দৌড়াচ্ছেন। কারণ আপনারা ভাবছেন এই তো সুযোগ কিছু করে নেই নইলে সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। বস্তুত আমাদের দেশে রাজনীতি ব্যক্তিস্বার্থ ভিত্তিকই ছিল এবং এখনও আছে। তাই আমরা পার্টির দর্শন ও দেশের স্বার্থকে ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে এখনও শিখিনি। দর্শন ব্যাপারটা আসলে কিন্তু অত্যন্ত সহজ। যদি মন পরিষ্কার থাকে এবং রাজনৈতিক নিয়ত ঠিক থাকে তাহলে এটা বুঝতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। এমনকি আধ ঘণ্টার মধ্যেই দলীয় দর্শন রপ্ত করা যেতে পারে। কিন্তু উদ্দেশ্যটা যদি ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের মতো অন্য কিছু হয় তবে যতই বুঝানো হোক না কেন দলীয় দর্শন কোনদিনই মজগে ঢুকবে না।
একটা কথা আমি পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই যে, আজ আমাদের পার্টি এমন অবস্থায় উপনীত হয়েছে যে, যদি দর্শন ঠিকভাবে বোঝে উঠতে না পারেন তবে আপনারা আগামী দিনে টিকতে পারবেন না। এতদিন যে টিকে গেছেন তা হুজুকের ফলেই সম্ভব হয়েছে। এখন সময় এসেছে ব্যক্তিগত কাজের মধ্যে দিয়ে আমাদের প্রত্যেককে দলে টিকে থাকতে হবে।... দলের যে কর্মসূচি রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়িত করতে হবে এবং পার্টিগতভাবে আমাদের জনগণের মধ্যে জাকিয়ে বসতে হবে। সুতরাং পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত বছর দুয়েক আমাদের অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হবে। আপনাদের অনেকে তাদের ওপর পার্টি যে বিশ্বাস স্থাপন করেছিলো তা অক্ষুণ্ন রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন।
বলা বাহুল্য, দেশের রাজনীতিতে এবং জনগণের মন-মানসিকতার অনেক পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তন আমরাই ঘটিয়েছি। আমাদের রাজনীতি ও রাজনীতির ধারাতে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। যেমন কেউ কেউ আপত্তি করলেও আমরা স্বনির্ভর গ্রাম সরকার গঠন করেছি। এর ফলে দেশ একটা রাজনৈতিক সিস্টেম লাভ করলো। এ সিসটেমের কারণে দেশ টিকে যাবে। আমি না থাকতে পারি, প্রেসিডেন্ট কে হলো না হলো তাতে কিছু যায় আসে না এবং আপনি এমপি না থাকলে তাতে বা কি হলো! পার্টি যেমন একটা সিস্টেম তেমনি সরকারও একটা সিস্টেম। স্বনির্ভর গ্রাম সরকারও তাই আমাদের সামাজিক জীবনের সবচেয়ে বড় সিস্টেম। “লা জেন লা কাজাদেক লাক”- এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহতা'লা এক দলকে দিয়ে আরেক দলকে ব্যালেন্স করেছেন। আর তা যদি না হতো তাহলে দুনিয়াতে ফ্যাসাদ সব সময় লেগেই থাকতো। এখান থেকেই আমাদের গণতন্ত্র শুরু হয়েছে। গণতন্ত্র হলো ব্যালেন্সের একটা প্রসেস। আরবিতে আর একটা কথা আছে, “হাম্বুল ওয়াতান মিন আল ইমান”— অর্থাৎ দেশপ্রেম জাগ্রত হয় ইমান থেকে। তাহলে কি দাঁড়ালো? ইমান মানে কীসের ইমান? অর্থাৎ আল্লাহতা'লার ওপর ইমান। আর তা করতে হলো দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হবে। আর সেটা হলো জাতীয়তাবাদ। সে জন্যেই বলা হয়ে থাকে যে, রাসূলুল্লাহই (সঃ) সবচেয়ে বড় দেশপ্রেমিক, বড় জাতীয়তাবাদী ছিলেন।
এখন প্রশ্ন হলো : “জাতীয়তাবাদ” কি? ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, এ বিশ্বে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের ‘জাতীয়তাবাদ'-এর উন্মেষ ঘটেছে। ‘রেসিয়াল’ বা জাতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা এ প্রসঙ্গে সর্বপ্রথমেই এসে যায়। আরব ও জার্মান জাতীয়তাবাদ-এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ‘এরিয়ান রেস’কে ভিত্তি করে জার্মান ন্যাশনালিজম গড়ে উঠেছিলো। হিটলার হয়তো বা জার্মান জাতীয়তাবাদের কথা বলতো না যদি প্রথম মহাযুদ্ধে জার্মানীর কতগুলো অংশ ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পোল্যান্ড নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে না নিতো। এই জন্যেই হিটলার ‘রেস’কে কেন্দ্র করে জার্মান জাতীয়তাবাদের সৃষ্টি করলো। আর ন্যাশনালিজমের কথা আজ সর্বজনবিদিত। এর ভিত্তিতে জন্ম নিয়েছে আরব লীগ। মিসরের পরলোকগত প্রেসিডেন্ট জামাল আব্দুল নাসের আরব জাতীয়তাবাদকে একটা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত রূপ দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আরব জাতীয়তাবাদ আজও আছে এবং সমগ্র বিশ্বে গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে আছে। এরপর আসে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা। বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্লোগান এ ধ্যান ধারণা থেকে উৎসারিত। এ কারণে আওয়ামী লীগররা বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্বপ্নে এখন বিভোর রয়েছে। আবার মুসলিম লীগ, আই ডি এল এবং জামাতিরা বলে থাকে ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কথা। এ শতকের গোড়ার দিকে জামাল উদ্দিন আফগানি প্যান ইসলামি ইজমের যে স্লোগান তোলেন ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার উৎস সেখান থেকেই। সত্য করে বলতে গেলে বলতে হয়, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ কায়েম করতে গিয়ে বাংলাদেশকে শোষণ ও শাসন চালানো হলো। কিন্তু ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের নাম ‘পলিটিক্স অব একপ্লয়টেশন' পাকিস্তানকে এক রাখতে পারলো না। প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। একটি অঞ্চলকে ভিত্তি করেও রাজনীতি চলতে পারে, গড়ে উঠতে পারে এক নতুন জাতীয়তাবাদ। এক্ষেত্রে ইইসি-এর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। ইইসি-এর রয়েছে পার্লামেন্ট অর্থাৎ ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট। এ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির কারো কারো সঙ্গে স্থল যোগাযোগ পর্যন্ত নেই। কিন্তু বিভিন্ন সূত্রে তারা নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রে নতুন চেতনা, নতুন ধ্যান-ধারণার উন্মেষ ঘটাতে সমর্থ হয়েছে। নিজেদের একটা স্বতন্ত্ররূপ গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। মোটামুটিভাবে একথা বলা যেতে পারে যে, তারা ‘জাতীয়তাবাদ'-এর পথে ধাবিত। তবে তা ‘কম্পলচারী' বা অত্যাবশ্যক নয়।
এসব উপাদানের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ' গড়ে উঠেছে। তাই আমরা বলি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ হলো সার্বিক জাতীয়তাবাদ। আমাদের আছে জাতিগত গৌরব, রয়েছে সমৃদ্ধিশালী ভাষা এবং আছে ধর্মীয় ঐতিহ্য। ভৌগোলিক অবস্থান হিসেবে এক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের বাসিন্দা। আমাদের আছে নতুন অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার স্বপ্ন। আর এসব রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় অবগাহিত। একটা জাতীয়তাবাদী চেতনার মধ্যে এত উপাদানের সমাবেশ ইতিপূর্বে আর দেখা যায় নি।
তাই কেউ বলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ধর্মকে অবলম্বন করে হচ্ছে না তবে ভুল হবে। ধর্ম বিশ্বাস বা ধর্মের প্রতি অনুরক্ত থাকা বাংলাদেশি জাতির এক মহান ও চিরঞ্জীব বৈশিষ্ট্য। সেই সঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলা আছে : ‘লা ইকরা ফিদ্বীনে”— অর্থাৎ ধর্মের ব্যাপারে কোন জোর জবরদস্তি নেই। সুতরাং ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ' একদিকে যেমন ধর্মভিত্তিক নয়, তেমনি আবার ধর্ম বিমুখও নয়। এ জাতীয়তাবাদ প্রত্যেকের ধর্মীয় বিশ্বাস ও ধর্মীয় অধিকারকে নিশ্চিত করে। একই সঙ্গে কেউ যদি বলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ কেবলমাত্র ভাষাভিত্তিক তবে সেটাও ভুল বলা হবে। আবার কেউ যদি বলে আমাদের কেবলমাত্র একটা অর্থনৈতিক কর্মসূচি রয়েছে কিন্তু কোন দর্শন নেই সেটাও ভুল। আমাদের বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ফিলসফিতে এবজরশন পাওয়ার আছে। এলবো রুমও রয়েছে। যদি কোথাও ঘাটতি থাকে অন্যটি থেকে এনে পুরো করে দিতে পারবেন। আমাদের অলটারনেটিভ আছে। সে কারণেই আমরা টিকে আছি, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ক্রমেই জনপ্রিয়তা লাভ করছে।
এবার কিছু সমস্যা, কিছু হুমকি প্রসঙ্গে আলোচনা করা যাক। দেশ ও জাতি মূলত সাম্রাজ্যবাদ, সম্প্রসারণবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ ও সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ প্রভৃতি দ্বারা আজও হুমকির সম্মুখীন! এসবের কারণেই দু'শ বছর আমরা পরাধীন ছিলাম। এ ম্যাশিনগুলিই আমার-আপনার ওপর চালানো হয়েছিলো। এ হুমকি এখনো আছে। কিন্তু যদি আপনারা গণপ্রতিনিধি হিসেবে পরিপূর্ণভাবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন, পার্লামেন্টের ভিতরে ও বাইরে যদি কর্তব্যনিষ্ঠ হোন তবে কেউ কিছুই করতে পারবে না। এ হুমকিগুলিকে যথার্থভাবে মোকাবিলা করতে হলে টার্গেট নিতে হবে জনগণকে সচেতন এবং সংগঠিত করে তোলার। জাতীয়তাবাদের টার্গেট হবে জনগণ। কারণ জনগণই সকল শক্তির উৎস। এ জন্যেই আমরা গ্রামে গ্রামে সংগঠন করছি। প্রতিষ্ঠা করছি সামাজিক, অর্থনৈতিক স্বনির্ভর গ্রাম সরকার।
প্রত্যেক দেশ, প্রত্যেক জাতির একটা স্বপ্ন থাকে। তেমনি আমাদের মনেও রয়েছে স্বপ্ন। সে স্বপ্নই হলো দর্শন। এ দর্শন দিয়েই বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ বাস্তবায়িত করতে হবে। এ স্বপ্ন আমরা কীসের স্বপ্ন দেখছি? আমরা স্বপ্ন দেখছি একটা শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের; সম্পদের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে সকলের অধিকার নিশ্চিত করার। তাই স্বপ্ন হচ্ছে আমাদের লক্ষ্য, চরম লক্ষ্যও বলতে পারেন। দলের চরম লক্ষ্য থাকবে কি থাকবে না এ প্রশ্নে মতভেদ কারো কারো মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য অত্যন্ত পরিষ্কার, চরম লক্ষ্য। অবশ্যই থাকতে হবে। তবে সেই চরম লক্ষ্য প্রয়োজনে রদবদল করতে হবে। ধরুন আজকে অর্গানাইজেশন চালাতে দশটা গাড়ি লাগবে কিন্তু এক বছর পর দশটা গাড়িতে হবে না তখন প্রয়োজন পড়বে পনেরোটা। উদ্দেশ্য ঠিক রয়ে গেছে কিন্তু সেই লক্ষ্য অর্জনে টার্গেট ফিগার ইন টাইমস্ অব ফিগারে রদবদল ঘটে গেছে। একইভাবে দর্শনের ক্ষেত্রেও মাঝে মধ্যে ফিগার চেঞ্জ করতে হবে। নতুবা আপনারা আমরা সবাই আউট অব টাইমস্ হয়ে যাবো। এ কারণেই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে বিশেষ করে রাশিয়ায় এখন উন্নয়ন তৎপরতায় ভাটার টান চলছে। কারণ তারা মানুষের এনার্জিকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করছে না। এখন তারা একটা সিলিং-এ পৌঁছে গেছে। ফলে হিউম্যান এনার্জি সেখানে স্টেইল হয়ে যাচ্ছে। চায়না সেটা বুঝতে পেরে তাদের বিভিন্ন ব্যবস্থায় রদবদল প্রত্যক্ষভাবে দেখার অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। বছর দুয়েকের মধ্যে তারা অজস্র রদবদল ঘটিয়ে ফেলেছে। তারা দর্শনটাকে ঠিক রেখে দর্শনের অ্যাপ্লিকেশন এবং একসটেন্ডগুলোতে রদবদল ঘটাচ্ছে।
দুনিয়া প্রত্যেকদিন একই থাকে না। এ মুহূর্তে দুনিয়াটা যে অবস্থায় আছে কালকে তা থাকবে না। প্রকৃতিতেও বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন সূচিত হয়। আল্লাহতালা যখন নেচারই চেঞ্জ করছে তখন আপনার টার্গেটগুলোকে চেঞ্জ করবেন না কেন? আপনার চাহিদার ক্ষেত্রেও তো রদবদল রয়েছে। দশবছর বয়সে আপনার যে চাহিদা ছিল ২০ বছর বয়সে তা নেই এবং ৪০ বছর বয়সে চাহিদার প্রেক্ষিতে তখন ভিন্নতর হয়ে যাবে। এ কারণে সোসিয়ালিজম বলতে আমরা বোঝাতে চাই সুষম বণ্টন অর্থাৎ আমাদের দেশে মানুষে মানুষে আয় এবং সম্পদের ক্ষেত্রে পার্থক্য আছে কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশে ম্যান টু ম্যান ডিসপ্যারিটি অন্তত বেতন কাঠামোর দিক দিয়ে অনেক বেশি। তাই আমাদের শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করতে হলে আমাদেরকে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে খালি পেটে দর্শন হয় না, কাজও করা যায় না। রাজনীতি তো করা যাই-ই না। তাই সর্বক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে।
আমাদের দর্শনের মধ্যে ধর্মীয় দর্শনও অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। খালি ইহজগতের কথা ভাবলেই চলবে না, পরলোকের কথাও ভাবতে হবে। সুতরাং আমরা মানুষকে যে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শন দিতে চাচ্ছি তাতে তিন ধরনের খোরাক আছে। যেমন :
১। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্যে অন্ন সংস্থানের জন্য উৎপাদন বৃদ্ধির আহ্বান।
২। স্বাবলম্বী জীবন-যাপনের জন্যে অনুপ্রেরণা এবং
৩। পারলৌকিক জগতের জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে আত্মার শান্তি অর্জনের প্রচেষ্টা।
এ কারণেই আমরা বলছি, ধর্মের এলিমেন্ট যদি রাজনীতিতে না থাকে তবে সেটাও ভুল হবে। ‘সেক্যুলার স্টেট' বলে অনেক দেশের পরিচয় দেয়া হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ ইংল্যান্ডের কথাই ধরা যাক। ‘৭৭ সনে গিয়েছিলাম কমনওয়েলথ সিলভার জুবিলি উৎসবে। কথায় কথায় বাইবেল। কোন কিছু শুরু হয় না বাইবেল ছাড়া। তারা সেক্যুলার হলো তাহলে কোথায়? এরপর আসুন প্রতিবেশী ভারতের কথায়। সারা দুনিয়ার ‘সেক্যুলার স্টেট' বলে সে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছে। কিন্তু আসলে কি তাই? না আমাদের মতে ভারত সেক্যুলার নয়। একজন ভারতীয় সাংবাদিককে বলেছিলাম এ কথা। বলেছিলাম— ভারতে উঠতে-বসতে, চলতে-ফিরতে সর্বক্ষেত্রেই হিন্দু ধর্মমত প্রতিপালন করা হচ্ছে। অন্য ধর্মাবলম্বীদের যথার্থ মর্যাদা দেয়া হয় না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রতিবছর কতশত সংখ্যালঘু মারা যায়। এতে উক্ত সাংবাদিক রুষ্ট হলেন। রুষ্ট হলে কি করা যাবে? আমাদের সাধারণ মানুষের চেয়ে ভারতীয়দের অবস্থা ভালো না হলেও তারা এটমবোম, ট্যাংক বানিয়ে চলেছে।
আমাদের কথা হলো, মানুষের হাত-পা বেঁধে কিছু করাতে চাই না। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির সঙ্গে এখানেও আমাদের পার্থক্য। তারা মানুষকে কাজ করতে বাধ্য করে আর আমরা জনগণকে, জনগণের শক্তিকে দেশ গঠনের কাজে স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবে লাগানোর জন্যে অনুপ্রাণিত করি, উদ্বুদ্ধ করি। এ জন্যে আমরা বলি সমগ্র স্বাধীনতার কথা। স্বাধীনতার অর্থ এই নয় যে, যার যা খুশি তাই করবে। স্বাধীনতা আছে অথচ দায়িত্বটা পালন করছেন না। আসল গলদ এখানেই। আপনাদের কেউ কেউ এথিক্স ফলো করছেন আবার কেউ কেউ করছেন না। তাই আমরা আমাদের জনশক্তিকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাতে পারছি না। কারণ আমাদের মানুষগুলি সংগঠিত নয়। আমরা বলি গ্রামে মাছ আছে, পানি আছে, সম্পদ আছে এবং মানুষও আছে। কিন্তু এগুলির মধ্যে সমন্বয় নেই। তাই আমরা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠন হিসেবে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার গঠন করেছি। গ্রামে সব কিছুই আছে, কিন্তু নেতৃত্ব নেই। সোসিও ইকোনমিক ফ্রিডম থাকতে হবে এবং এ জন্যে চাই সংগঠন। গ্রাম সরকার গঠনের পেছনে এ লক্ষ্যও ক্রিয়াশীল রয়েছে। স্বনির্ভর গ্রাম সরকার হলো বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শনের প্রোডাকশন। অবশ্য হালে এর দাবিদার দু-একজন বেরিয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ দাবি করছে যে, এটা নাকি তাদের কর্মসূচি ছিল। জাসদও বলছে, এটা নাকি তাদেরও লক্ষ্য। আমি কিন্তু এর আগে এদের মুখে এ ধরনের কোন কথা শুনিনি। সে যাই হোক, দেশের মানুষ জানে স্বনির্ভর গ্রাম সরকার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের দর্শনের প্রোডাকশন এবং এটাকে রূপ দিয়েছি।
দর্শন হলেই তো শুধু চলবে না। তা বাস্তবায়ন সংগঠন চাই। এ জন্যে রাজনৈতিক সংগঠনের পাশাপাশি স্বনির্ভর গ্রাম সরকার এবং তারই সঙ্গে গ্রাম প্রতিরক্ষা দল গঠন করা হয়েছে। আর এসব কিছু মিলেই আমরা শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের ডাক দিয়েছি। '৭১-এর মতো রক্তাক্ত বিপ্লবের প্রয়োজন নেই। আজ প্রয়োজন দেশ গঠন। আর তার জন্য চাই আভ্যন্তরীণ শান্তি, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের ধাঁচে দেশ গঠন তাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
শান্তিপূর্ণ বিপ্লবের রূপরেখা নিম্নরূপ :
১। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করা, ২। কৃষি সংস্কার;
৩। শিক্ষা সংস্কার;
৪। পরিবার পরিকল্পনা;
৫। শিল্প উৎপাদন এবং বিদ্যুতায়ন;
৬। সমাজ সংস্কার;
৭। প্রশাসনিক সংস্কার;
৮। ধর্ম;
৯। আইন সংস্কার;
১০। শ্রম আইন সংস্কার;
১১। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে জনশক্তি উন্নয়ন;
১২। খনিজ তথা সকল প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ;
১৩। সংস্কৃতির বিকাশ সাধন।
এগুলি হলো আমাদের বৈপ্লবিক কর্মসূচির মূল ব্যাপার। কোন স্বপ্নের, কোন লক্ষ্যের জন্যে এ বিপ্লব। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মানুষের এ পাঁচটি মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েমই হলো আমাদের স্বপ্ন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মৌল লক্ষ্য।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের লেখা। তাঁর শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে পুনপ্রকাশিত হলো।