Logo
Logo
×

অভিমত

নোনা পানিতে গর্ভবতী

পরিণতি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি এমনকি মৃত্যু

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৪, ০২:১৪ পিএম

নোনা পানিতে গর্ভবতী

খুলনার দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ছোট, জনাকীর্ণ ওয়ার্ড। গর্ভবতী নারীরা ঘড়ঘড় ফ্যানের নিচে ক্লান্ত হয়ে পড়ে আছেন। ২০ জনের বেশি নারী। সবার জন্য এক রুমের ওয়ার্ড। কোনো বিভাজক নেই। তাই কোনো পুরুষ অতিথি এলে গর্ভবতী রোগীকে বাইরে পাঠিয়ে দেন এখানকার নার্সরা।

একটি বিছানায় শুয়ে আছেন ২৩ বছরের সাপ্রিয়া রায়। তিনি বলেন, ‘আমার প্রথম গর্ভধারণ কঠিন ছিল। শিশুটি দুই মাস আগেই জন্মগ্রহণ করেছিল। তাই দ্বিতীয়বার গর্ভধারণের পর পুরোটা সময় চিন্তিত থাকি।’ তার উচ্চ রক্তচাপ আছে এবং ডাক্তার তার প্রস্রাবে প্রোটিন পেয়েছেন, যে কারণে তাকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। তার সিজারিয়ান করা লাগতে পারে।

সাপ্রিয়ার প্রি-এক্লাম্পসিয়া আছে। এক্লাম্পসিয়া হল গর্ভকালীন একটি জটিলতা, যা মা ও শিশুকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে। প্রসবের কিছুকাল আগে বা প্রসবের সময় এক্লাম্পসিয়া হতে পারে।

শুধু সাপ্রিয়া না, বাংলাদেশের উপকূলীয় উপজেলা দাকোপে উদ্বেগজনক সংখ্যক গর্ভবতী মহিলা প্রি-এক্লাম্পসিয়া, একলাম্পসিয়া ও উচ্চ রক্তচাপের শিকার হচ্ছেন। বিজ্ঞানীদের ধারণা, পানিতে ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততার কারণে এমন হচ্ছে।

‘উন্নয়নশীল দেশগুলিতে মাতৃমৃত্যুর প্রধান কারণ উচ্চ রক্তচাপ,’ বলছেন পরিবেশ মহামারীবিদ্যার গবেষক আনিরে খান। তিনি ২০০৮ সালে তাদের নিয়ে গবেষণা করেন যারা গর্ভবতী, তাদের মধ্যে যাদের উচ্চরক্তচাপ আছে এবং তাদের মধ্যে যাদের শরীরে পানির সঙ্গে অতিরিক্ত লবণ প্রবেশ করছে।

যেসব গর্ভবতী নারীর শরীরে পানির সাথে লবণ প্রবেশ করছে তাদের গুরুতর মাথাব্যথা হয়ে, অঙ্গের ক্ষতি হয়, এমনকি মৃত্যু হতে পারে।

আনিরে খান ২০১১ সালে ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন ও বাংলাদেশ সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিজের সাথে একটি গবেষণা করেন। সেখানে তিনি দেখেছেন, দাকোপে মহিলাদের মধ্যে লবণ গ্রহণের পরিমাণ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। বেশি লবণ গ্রহণ ও প্রি-এক্লাম্পসিয়া ও উচ্চরক্তচাপ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। অর্থাৎ বেশি লবণ গ্রহণের ফলে উচ্চরক্তচাপ দেখা দিচ্ছে। প্রি-এক্লাম্পসিয়ার মতো জটিলতা দেখা দিচ্ছে। অন্য অনেক কারণেও প্রি-এক্লাম্পসিয়া দেখা দিতে পারে। বিজ্ঞানীরা এখনও জানতে পারেননি, ঠিক কোন সুনিশ্চি কারণে প্রি-এক্লাম্পসিয়া দেখা দেয়।

দাকোপ দীর্ঘদিন ধরে জলবায়ু সংকটের প্রথম সারিতে রয়েছে। গ্রামীণ জনগণ রান্না, পানীয় ও গোসলের জন্য নদী, পুকুর ও ভূগর্ভস্থ পানির উপর নির্ভর করে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় থেকে লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে এই প্রাকৃতিক পানির উৎসগুলো বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততার কারণে দূষিত হয়েছে।

‘২০০৯ সালে যখন ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানে তখন এটি ধ্বংসের পথ রেখে যায়, বাঁধ ভেঙে পুরো অঞ্চলকে নোনা জলে ডুবিয়ে দেয়,’ বলেছেন ওই হাসপাতালের গাইনোকোলজিস্ট সন্তোষ কুমার। তার ভাষায়, ‘বেশির ভাগ স্বাদু পানির অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় উপকূলীয় অঞ্চল তীব্র পানীয় জলের সংকটের সম্মুখীন হয়েছে। আইলা জনস্বাস্থ্যের উপর কতটা প্রভাব ফেলেছে তা বোঝা যাচ্ছে।’

খানের গবেষণার ফলস্বরূপ, এনজিও ও বাংলাদেশ সরকার দাকোপের জলে লবণাক্ততা হ্রাস করার জন্য বেশ কয়েকটি উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে নোনা জল সরানো, বৃষ্টির জল ভূগর্ভে পাঠানোর ব্যবস্থা ও সংগৃহীত জল পরিশোধন ও সংরক্ষণ।

এই পদক্ষেপগুলি কাজ করেছে কিনা তা দেখার জন্য আনিরে খান দাকোপে ফিরে আসেন ২০১৯ সালে। তিনি ৭৪০ জন মহিলার সাক্ষাৎকার নেন এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে রক্তচাপের মাত্রা তখনও বেশি কিনা তা পরীক্ষা করেন। কিন্তু কোভিড বিধিনিষেধের কারণে তিনি তার বিশ্লেষণ সম্পূর্ণ করতে পারেননি। খান এখন ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের সাথে একটি নতুন গবেষণার পরিকল্পনা করছেন, সেই পদক্ষেপগুলি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে কিনা তা মূল্যায়ন করার জন্য।

বস্তুত, দাকোপে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে বলে গাইনোকোলজিস্ট সন্তোষ কুমার পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ভবিষ্যতে এখানে লবণাক্ততার সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। এলাকার সমস্ত মহিলা ও মেয়েরা হুমকির মুখে রয়েছে। নিরাপদ পানীয় জলের সহজ প্রবেশাধিকার ছাড়া তাদের প্রজনন স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটবে।

স্বাস্থ্যকর্মী নির্মাল্য সরকার, যার বয়স এখন ৫৬ বছর। তিনি ২০ বছরের বেশি সময় ধরে একজন স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করছেন। প্রতিদিন তিনি দাকোপের আশপাশের গ্রামে ভ্রমণ করেন, ঘরে ঘরে গিয়ে পরিবারের সাথে বিশুদ্ধ পানীয় জলের গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এত উদ্বেগ সত্ত্বেও এখানে বেশির ভাগ লোকই ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা এবং এর প্রভাব সম্পর্কে অবগত নয়।’

নির্মাল্য সরকার দাকোপে পাঁচ হাজারের বেশি গর্ভবতী নারীর সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি তাদের নিয়মিত চেক-আপ করতে যান এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তথ্য সেশনের আয়োজন করেন, যেখানে মহিলা ও মেয়েরা তাদের যেকোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।

‘মূল সমস্যা হল সচেতনতার অভাব,’ সরকার বলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যভাণ্ডার তৈরিতে কাজ করছেন যা গ্রামের নারীদে সহজে সহযোগিতা করতে পারে। তিনি বলেন, ‘গর্ভাবস্থার সঠিক যত্ন ও নিরাপদ পানীয় জলের প্রয়োজনয়ীতা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করা সম্ভব হলে মাতৃস্বাস্থ্য সরাসরি উন্নত করা যাবে।’

প্রি-এক্লাম্পসিয়া অনাগত শিশুকেও প্রভাবিত করে। মাতৃগর্ভে মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে এই শিশু। পুষ্টির অভাবে ওজন কম হয় বা আকারে ছোট হয়। প্রাথমিক অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। তারা শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, নিউমোনিয়া ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়ে।

কিন্তু সচেতনতা যথেষ্ট নয়। কারণ বৃষ্টির জল ধরে রাখা বা পুকুরের জল পরিশোধনের ক্ষমতা আছে একেবারেই সীমিতসংখ্যক, মাত্র কয়েক শতাংশ, মানুষের। দাকোপে মহিলারা তাদের কোমরে বা মাথায় ভারী কলস নিয়ে দূর-দূরান্ত থেকে সামান্য পানি সংগ্রহ করতে পারেন, যা তাদের পরিবারের জন্য মোটেও যথেষ্ট না।

নির্মাল্য সরকারের ভাষায়, ‘আমরা প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে পারি না। আমাদের বেঁচে থাকার বিকল্প, আরও টেকসই উপায় খুঁজে বের করতে হবে।’

(খুলনার দাকোপ থেকে তাসলিমা বেগম লিখেছেন দ্য গার্ডিয়ান ডটকমে। সেখান থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ)

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন