Logo
Logo
×

অভিমত

দ‌্য ডি‌প্লো‌মেটের নিবন্ধ

কী কারণে বাংলাদেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ল?

মোবাশ্বার হাসান

মোবাশ্বার হাসান

প্রকাশ: ৩০ মে ২০২৪, ০৩:০১ এএম

কী কারণে বাংলাদেশ ছাড়ার হিড়িক পড়ল?

ছবি: সংগৃহীত

চলতি মাসের শুরুতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাজ্য একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির উদ্দেশ্য হলো, যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন খারিজ হয়েছে এমন বাংলাদেশিদের সহজে ফাস্ট- ট্র্যাক’(দ্রুত) পদ্ধতিতে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো। 

গত বছরে প্রায় ১১ হাজার বাংলাদেশি বিভিন্ন ধরনের ভিসায় যুক্তরাজ্যে প্রবেশ করেছেন এবং দেশটিতে যাওয়ার ১২ মাসের মধ্যে তারা রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেন। যা ব্রিটিশ অভিবাসন ব্যবস্থার ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করে। 

বাংলাদেশের সঙ্গে ওই চুক্তি স্বাক্ষরের পর দুই দেশের সম্পর্ককে ইতিবাচক উল্লেখ করে যুক্তরাজ্যের অবৈধ অভিবাসনবিষয়ক মন্ত্রী মাইকেল টমলিনসন বলেন, বাংলাদেশ একটি মূল্যবান অংশীদার এবং এটা চমৎকার যে, এই বিষয়সহ অন্যান্য ইস্যুতে আমরা আমাদের সম্পর্ক জোরদার করছি। 

শুধু যুক্তরাজ্যেই নয়, ২০২৩ সালে ইউরোপের অন্যান্য দেশে রেকর্ড ৪০ হাজার বাংলাদেশি আশ্রয় চেয়েছেন। অতীতে বাংলাদেশিরা অবৈধভাবে নৌকায় করে অস্ট্রেলিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো সীমান্ত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশের চেষ্টার জন্য খবরের শিরোনাম হয়েছে। ২০১৫ সালে বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গাদের নড়বড়ে নৌকায় করে সাগর পাড়ির ঘটনা দেশের বাইরের মানবিক সংকট হিসেবে সামনে আসে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশ যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যাপকভাবে প্রশংসিত সেখানে বিদেশে বৈধ এবং অবৈধ উপায়ে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশির সংখ্যা বৃদ্ধির খবর প্রকৃতই বিভ্রান্তিকর। 

কৌশিক বসুর মতো অর্থনীতিবিদদের দাবি, বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপক উন্নতি করছে। নামকরা অর্থনীতিবিদ জেফরি শ্যাক্সের পর্যবেক্ষণ হলো, শেখ হাসিনার শাসনের অধীনে বিভিন্ন টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছে।  এমনকি নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনও বলেছেন, অনেক সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে। মূলত, ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের তলিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বাংলাদেশের। 

সংক্ষিপ্ত করে বললে, এই বয়ান দেওয়া অধিকাংশ প্রভাবশালী বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশি নন এবং বাংলাদেশে বসবাসের অভিজ্ঞাতাও নেই—তারাই বাংলাদেশ অসাধারণ উন্নতি করছে বলে উল্লেখ করছেন।  

তাহলে কেন লাখ লাখ বাংলাদেশি বিদেশে আশ্রয় চাচ্ছেন? কোনো ধরনের যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাত না থাকায় তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল দেশ। তারপরও বাংলাদেশিরা রাজনৈতিক আশ্রয় চাইতে উত্তাল সাগর দিয়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নেয়। নৌকায় করে ইউরোপে আসা মানুষের তালিকায় বাংলাদেশিরা শীর্ষে। 

অন্য দেশে অবৈধভাবে অভিবাসী হওয়ার লক্ষ্যে নৌকায় করে যাওয়া বাংলাদেশিদের ওপর করা এক সমীক্ষায় মানবপাচার নেটওয়ার্ক, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং রাজনৈতিক দমন-পীড়নকে তাদের এই ধরনের বিদেশ যাত্রার মূল চালিকা শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলিতে অর্থনৈতিক অসমতা এবং রাজনৈতিক নিপীড়নই বিদেশে আশ্রয় চাওয়ার পেছনে মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে।

যদিও অনেক গবেষক একমত যে, বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়া বাংলাদেশিদের সব ঘটনা সত্য নয়। তথ্যসূত্র দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বলেছে, বাংলাদেশি অনেক বিরোধী দলীয় নেতা, ভিন্নমত পোষণকারী, সরকারের সমালোচক এবং অ্যাক্টিভিস্টরা দেশে নিপীড়ন থেকে বাঁচতে কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছিলেন। একইসঙ্গে, বাংলাদেশি প্রবাসীদের সংবাদমাধ্যম এবং বিরোধীদের সক্রিয়তা কয়েক বছর ধরে মনোযোগ পেয়েছে। 

২০০৮ সালের পর থেকে বাংলাদেশে কোনো অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেখা যায়নি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনে ২০১৩, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনগুলি ব্যাপক ত্রুটিপূর্ণ ছিল এবং উদার গণতান্ত্রিকব দেশে সমালোচিত হয়েছিল। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবক্ষয় মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং বিরোধীদের ওপর রাজনৈতিক দমন-পীড়নে প্রভাব ফেলেছে।

বাংলাদেশের প্রায় ২৫ লাখ বিরোধী দলীয় নেতাকর্মী একাধিক মামলার আসামি। বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠীর অভিযোগ, ২০০৯-২০২২ সালের মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ২৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করেছে এবং ৬০০ জনেরও বেশি মানুষকে গুম করেছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫ নম্বরে। এমনকি ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়ার গণমাধ্যমও ওই সূচকে ১৬৩ তম এবং বাংলাদেশের তুলনায় স্বাধীন।

এসব পরিপ্রেক্ষিতে ২০২১ সালে গুরুতর মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র ম্যাগনিটস্কি আইন ব্যবহার করে বাংলাদেশি এলিট ফোর্স র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এবং এর ছয় কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এই ছয় ব্যক্তির মধ্যে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ এবং বর্তমান আইজিপিও ছিলেন। আর সম্প্রতি গুরুতর দুর্নীতি এবং বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ণের অভিযোগে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল আজিজ ও তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।

ব্রাসেলসের ভ্রিজ ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিজ্ঞানে মেরি কুরি ফেলো সাইমুম পারভেজ নিজের গবেষণা প্রকল্পের অংশ হিসেবে লন্ডন, ব্র্যাডফোর্ড, রোম, বন এবং বার্লিনসহ ইউরোপীয় ও ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে আসা বাংলাদেশি অভিবাসীদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। একই গবেষণার অংশ হিসেবে বাংলাদেশিরা কেন ইউরোপে আসে সেই প্রশ্নের উত্তরও খুঁজছেন তিনি। 

দ্য ডিপ্লোম্যাটকে সাইমুম বলেছেন, তিনি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এমন অনেক অভিবাসী তাকে বলেছেন বাংলাদেশে বিরোধীদের ওপর চলমান রাজনৈতিক নিপীড়নের কারণে তারা পালিয়ে এসেছেন। 

সাইমুম বলেন, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার অনেক সদস্য তাদেরকে (আমি যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছি) নির্যাতন, জেলে দেওয়া এবং তাদের নামে মিথ্যা মামলা দায়েরের হুমকি দিয়েছিল।

দেশে থেকে ক্রমাগত রাজনৈতিক নিপীড়নের মুখোমুখি হবেন, নাকি বিদেশে পাড়ি জমাবেন—কোনটা ভালো হবে সেই লাভ-অলাভের হিসাব করেই অনেকে অবৈধ অভিবাসী হওয়ার পথ বেছে নেন। তবে এটাও উল্লেখ্য যে, অনেক বাংলাদেশি দেশের রাজনৈতিক নিপীড়ন থেকে পালিয়ে বাঁচার জন্য রাজনৈতিক আশ্রয় চাইলেও, আশ্রয়প্রার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ কিন্তু অর্থনৈতিক অভিবাসী। যারা বাংলাদেশের মানবাধিকার এবং গণতন্ত্রের অবস্থা খারাপ উল্লেখ্য করে অন্য দেশের রাজনৈতিক আশ্রয় ব্যবস্থার সুযোগ কাজে লাগাতে চাইছে।

এসব সত্ত্বেও বাংলাদেশি এই অর্থনৈতিক অভিবাসীদের ভাগ্যও বাংলাদেশের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কারণ দেশের অর্থনীতিতে কর্তৃত্ববাদী স্টাইলের শাসনের ফলে একটি নতুন ধনীক শ্রেণি তৈরি হয়েছে—যেমন ব্যবসায়ী রাজনীতিক, রাজনীতিবিদ ও সরকারি কর্মচারী। অথচ দেশের অধিকাংশ নাগরিক দৈনন্দিন চাহিদা মেটাতেই সংগ্রাম করছে।

অন্যভাবে বললে, কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি লাখ লাখ মানুষকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বাবল থেকে দূরে ঠেলে দিয়ে কিছু গোষ্ঠীর কাছে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হয়ে উঠেছে এবং বৈষম্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। সেসব পিছিয়ে পড়া মানুষদের অনেকে যারা দেশে কোনো আশা দেখতে পান না, তারাই বৈধ কিংবা অবৈধভাবে বিদেশে কাজ এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের পথ বেছে নিচ্ছেন। 

বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্যের মধ্যকার ওই চুক্তি সেই সত্যকেই সামনে আনে যে, বাংলাদেশে স্বৈরাচারী রাজনীতি উন্নত দেশগুলির জন্যও উদ্বেগজনক প্রভাব ছাড়া অন্য কিছু নয়।

(দ‌্য  ডি‌প্লো‌মেট থে‌কে অনূ‌দিত)

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন