প্রধানমন্ত্রী মহাদুর্যোগের মুহূর্তে হঠাৎ কেন তারেককে নিয়ে চিন্তিত হলেন
তুুুহিন খান
প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪, ১১:১৯ এএম
উপকূলজুড়ে মানুষ যখন প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের আতঙ্কে কাঁপছিল, পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় ২৪ বছর বয়সী শরীফ যখন রেমালের জলোচ্ছ্বাস থেকে বোন ও খালাকে বাঁচানো চেষ্টা করছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত পানিতে ভেসে মারা যাচ্ছিলেন, তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তারেক রহমানের ওপর তীব্র ক্ষোভ ঝাড়ছিলেন।
‘এখন একটাই কাজ। ওই কুলাঙ্গারটাকে ফেরত নিয়ে আসা। ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি, গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি, দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন তারেক জিয়া যেখানেই থাক, আমরা তাকে ফিরিয়ে আনব।’
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। ওই সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি তারেক জিয়াকে যেন বাংলাদেশে ফেরত দেয়। আমরা তাকে নিয়ে এসে সাজা কার্যকর করব।’
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন গণভবনে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া উপজেলার নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান, কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়কালে এসব কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী দেশের নির্বাহী প্রধান। তিনি অপরাধীর সাজা কার্যকর করতে দায়বদ্ধ। তারেক রহমান কেমন কেমন মামলায় কেমন বিচার পেয়েছেন সেই প্রশ্ন আরেক গল্প। সেটা আপাতত থাক।
দেশ যখন মহাদুর্যোগের মধ্যে ঢুকছিল, রবিবার (২৬ মে), উপকূল জুড়ে ছিল জীবন-মৃত্যু নিয়ে আতঙ্ক, সেই সময় প্রধানমন্ত্রী তার দলীয় নেতাকর্মী ও জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দুর্যোগ মোকাবিলার নির্দেশ না দিয়ে কেন তারেক রহমানকে টানলেন? তারেক রহমান তো হঠাৎ করে এসে পড়া কোনো ইস্যু না।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘ভাবুন, দেশ যখন দুর্যোগের মুখে তখন দেশের মানুষকে বাঁচানো প্রধান কাজ নয়, জনগণের সম্পদ রক্ষা প্রধান কাজ নয়।’ তিনি বলেন।’
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে গেছে উল্লেখ করে বিএনপিনেতা বলেন, ‘জনগণকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দুর্ভোগ থেকে বাঁচানো সরকারের প্রধান কাজ না। কারণ সরকারের প্রশ্রয়ভুক্ত সিন্ডিকেট ও দুর্নীতিবাজরা দ্রব্যমূল্য বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটছে। এটা তাদের (সরকার) জন্য সমস্যা না। আপনি (জনগণ) অসন্তুষ্ট হবেন, তাতে সরকারের কিচ্ছু আসে-যায় না। এই সরকারের ভোটের কোনো প্রয়োজন নাই।’
প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে সোমবার ঢাকায় ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টির মধ্যে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মেট্রো স্টেশনের নিচে মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে নজরুল ইসলাম এসব কথা বলেন। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, সাবেক সভাপতি সাইফুল আলম নিরবসহ নেতা-কর্মীদের মুক্তির দাবিতে জেলা বিএনপির উদ্যোগে এই কর্মসূচি আয়োজন করা হয়।
মূল্যস্ফীতি, ডলার সংকট এবং ঘূর্ণিঝড় রেমালের কথা তুলে ধরে নজরুল ইসলাম খান বলেন, “যখন উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেওয়া হয়েছে, আমরা পত্রিকায় দেখলাম, তখন দেশের প্রধানমন্ত্রীর আসনে যিনি বসে আছেন, তাকে আমরা বলতে শুনলাম, ‘এখন আমাদের একমাত্র কাজ হল তারেককে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসব’।”
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি। বিএনপিনেতারা ক্ষোভ ঝাড়বেন সেটা স্বাভাবিক। কিন্তু দেশের বুদ্ধিজীবীরা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের কী প্রতিক্রিয়া দেখালেন?
বস্তুত, বুদ্ধিজীবীরা আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের কথাই বলেন না। তারা ভয়ে স্তব্ধ হয়ে আছেন। কারণ কথা বললেই গুম-খুন নিশ্চিত।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ২০০৮ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যে যান। দেড় দশক পেরিয়ে গেলেও তিনি ফেরেননি। এর মধ্যে বিদেশে অর্থপাচার মামলায় সাত বছর, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ১০ বছর, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন, বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তির মামলায় দুই বছর, অবৈধ সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের মামলায় নয় বছরের সাজা হয়েছে তার।
২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় পাঁচ বছরের সাজা নিয়ে খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার রাতেই তারেক রহমানকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে বিএনপি। এরপর থেকে দল চালাচ্ছেন তিনিই। আইনের চোখে তিনি পলাতক। পলাতক থাকায় তিনি কোনো মামলায় আপিল করতে পারেননি।
নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মূল রাগের কারণটা এই যে, তারেক রহমান গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনকে বেগবান করেছেন, জোরদার করেছেন। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডানপন্থি, বামপন্থি, সমাজতন্ত্রী, ইসলামি দল—সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে সরকারের বিরুদ্ধে এমন এক আন্দোলন গড়ে তুলেছেন যে আন্দোলনের ফলে ১০ শতাংশ লোকও ভোট দিতে যায়নি। এই হলো রাগ।’
তিনি বলেন, ‘এ জন্যই ঘূর্ণিঝড় বা জলোচ্ছ্বাস, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, টাকার অবমূল্যায়ন, ব্যাংক লুট, রাষ্ট্রীয় দেনা বৃদ্ধি, দুর্নীতি, অনাচার, মানবাধিকার হরণের কারণে দেশের সাবেক সেনাপ্রধান, সাবেক পুলিশপ্রধান আন্তর্জাতিক স্যাংশনের মুখে পড়ার পরও সেগুলোর কোনোটাই প্রধান কাজ নয়। একমাত্র কাজ তারেক রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে শাস্তি দেওয়া।’
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আওয়ামী লীগ কি তার ইতিহাস ভুলে গেছে?’ বিএনপির আন্দোলন ব্যর্থ হবে না দাবি করে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের উদাহরণ টানেন নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের সময়ে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাকেই পাকিস্তানিরা বন্দি করে রেখেছিল, কিন্তু গণঅভ্যুত্থান ঠেকানো যায় নাই।’
কেমন ছিল রেমালের তাণ্ডব
রেমালে ক্ষতির সম্পূর্ণ চিত্র এখনও পাওয়া যায়নি। তবে শুধু পটুয়াখালীতে মোট ক্ষতির পরিমাণ শত কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করছেন জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সুমন চন্দ্র দেবনাথ।
তিনি বলেছেন, জেলায় ৭৭৮টি মাছের ঘের ও ১২০টি কাঁকড়া ও কুচিয়ার খামার তলিয়ে গেছে। এতে ২৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ২৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের কোথাও সম্পূর্ণ, কোথাও আংশিক ক্ষতি হয়েছে, ৫৮ হাজার ৩০৪ কৃষকের ৭৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ছয় হাজার ৮২টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ৩১ হাজার ৬৯৪টি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি মিলে অন্তত ২৯ হাজার ২৪০টি মারা গেছে, ৩৬১ হেক্টর জমির গাছপালার ক্ষতি হয়েছে, এক হাজার ২২৪টি গভীর নলকূপ ও ছয় হাজার ৬৮১টি স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার আংশিক ক্ষতি হয়েছে।
ঘূর্নিঝড় রেমালে মোট ৮৪ হাজার ৫০০ পরিবারের তিন লাখ ৩৮ হাজার মানুষ ক্ষতির শিকার হয়েছেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।