বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ধ্বংসের মুখে। রিজার্ভ প্রতিনিয়ত হুহু করে কমছে। অবস্থা এতোটাই খারাপ যে, জরুরি আমদানিসহ অনেক কার্যক্রমই ডলারের অভাবে বন্ধ হয়ে আছে। রাজস্ব আদায়ের অবস্থাও সুবিধাজনক না। এ কারণে সরকার বিদ্যুৎ ও সারের ভর্তুকির টাকা দিতে না পেরে ৮ থেকে ১০ বছর মেয়াদি বন্ড ছেড়েছে, যাতে আপাতত নগদ টাকা দিতে না হয়। সরকারের তরফ থেকে কৃচ্ছতা সাধনের আদেশ দেওয়া হচ্ছে। অথচ এই অবস্থাতেই ডিসি-ইউএনওদের জন্য নতুন করে ৩৮২ কোটি টাকা দিয়ে গাড়ি কেনার প্রস্তাব পাশ হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ডিসি ও ইউএনওদের জন্য ২৬১টি নতুন গাড়ি কেনার প্রস্তাব করেছে। গাড়িগুলোর ধরন হচ্ছে, স্পোর্টস ইউটিলিটি ভেহিকেল (এসইউভি), যেগুলো ২ হাজার ৪৭৭ সিসির মিতসুবিশি পাজেরো জিপ নামে পরিচিত। এগুলোর মডেল হচ্ছে মিতসুবিশি পাজেরো স্পোর্টস কিউ এক্স। ডিসিদের জন্য এমন গাড়ি কেনা হবে ৬১টি ও ইউএনওদের জন্য ২০০টি। কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, একেকটি গাড়ির দাম ১ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ফলে গাড়ি কেনায় মোট খরচ পড়বে ৩৮২ কোটি টাকা।
শুধু তাই নয়, এই গাড়ি কেনায় এতো তাড়াহুড়া যে, উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই গাড়িগুলো কেনা হবে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে। জনপ্রশাসন সচিবের যুক্তি হচ্ছে, উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে কেনার প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ হওয়ায় রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনে ও জনস্বার্থে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে দরপত্র ছাড়াই গাড়িগুলো কেনা দরকার। বলাই বাহুল্য, এই প্রক্রিয়াতেও দুর্নীতির সন্দেহ থাকবে।
কিন্তু, সর্বত্র কৃচ্ছতা সাধন করেও ডিসি-ইউএনওদের ব্যাপারে এইরকম বিপুল খরচ কেন? এদেরকে জনগণের সেবক বলা হলেও কেন এদের ‘জাত’ রক্ষার জন্য জনগণের কষ্টের উপার্জনের এতো অপচয়? কেন রীতিমতো লুকোচুরি করে এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রকল্প পাস?
কারণ, গত তিন তিনটা নির্বাচন এই স্যারেরাই ইঞ্জিনিয়ারিং করেছেন। আওয়ামী আমলে শিল্প ধ্বংস করে দিয়ে বেসরকারি চাকরি খাতের বারোটা বাজানো হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এন্তার পরীক্ষানিরীক্ষার ফল, এ দেশের সেরা মেধাবীরা বিদেশ চলে যায় আর বিভিন্ন সেক্টরে ভারতীয়সহ বিদেশিদের দাপট। এসবের মধ্যে একমাত্র লোভনীয় চাকরি বিসিএস।
কয়েক কোটি তরুণের জন্য মাত্র কয়েকশো চাকরির সোনার হরিণ। যেকোনো ভাবে বিসিএস হতে পারলেই জমিদার। অর্থবিত্ত, সম্মান আর অসীম ক্ষমতা। তবে, এই বিসিএস কেবল মেধা থাকলেই হবে না, এর ভাইবা পাস করতে লাগবে আওয়ামী সার্টিফিকেট। তবেই নিয়োগ।
তাতেই শেষ না, পদে পদে দলীয় লেজুড়বৃত্তি এবং সরকারের তোষামোদ করলেই মিলবে পদোন্নতি। ফলে, যিনি ইউএনও বা ডিসি হবেন তিনি কতটা দক্ষ এর চেয়ে অনেক বেশি জরুরি তিনি কতটা তোষামুদি। জনগণের সেবা-টেবা এগুলো একেবারেই হাস্যকর। আর হবেই না বা কেন? যদিও জনগণের টাকায় কোটি টাকার গাড়ি, দামি বাংলো আর সমস্ত সুবিধা, কিন্তু এর জন্য জনগণের কাছে তো কোনো জবাবদিহিতা করতে হয় না।
রাজনীতিবিদদের নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের নিয়ে আলাপ হয়। কিন্তু, দেশের ক্রান্তিলগ্নে এসব ডিসি ইউএনওরা যেই ভূমিকা রাখছেন, তা নিয়ে জনতার মধ্যে তুলনামূলক কম ক্ষোভ দেখা যায়। হয়তোবা ক্ষমতার ভয়ে কিংবা এমনকি মোহে।
কিন্তু, রাজনীতিবিদরা সরকার পাল্টালে মার খায়, ব্যবসায়ীরাও ধরা খায়। শুধু ইউএনও ডিসিরা জনগণের বেতনে সব সুবিধা নিয়ে জনগণকে অব্যাহতভাবে শোষণ করে যায়। এদের শোষণ হয়তো অচিরেই থামানো যাবে না, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় এই প্রবল ভোগবিলাস, এই বিপুল তোষামোদের গল্প লেখা থাকবে।