মওলানা ভাসানী, তার ফারাক্কা মার্চ, তার লিগ্যাসি
যেভাবে তিনি ভাসানী হলেন
হারুন উর রশিদ
প্রকাশ: ১৮ মে ২০২৪, ০২:০৬ পিএম
সাদা পাঞ্জাবি, সিগনেচার লুঙ্গি ও টুপি পরতেন। বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির ব্যক্তিত্বের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। কখনও ক্ষমতার রাজনীতি করেননি। তিনি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (১২ ডিসেম্বর ১৮৮০—১৭ নভেম্বর ১৯৭৬)। সংক্ষেপে মওলানা ভাসানী।
একজন ব্যক্তিকে কল্পনা করুন যিনি ভাগচাষী, জেলে, রিকশাচালক, পাট ও চিনি উৎপাদনকারী, কারখানার শ্রমিক, খামারের শ্রমিক। ভাসানী ছিলেন ‘পৃথিবীর হতভাগাদের’ কণ্ঠস্বর। তিনি শুধু অগ্নিঝরা বক্তব্যই দিতেন না, প্রতিনিয়ত উপস্থিতি থাকতে নিপীড়িতদের পাশে। তাদের পরামর্শ দিতেন অক্লান্তভাবে। কালে কালে তিনি কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। মজলুম জননেতা হয়ে ওঠেন। তিনি নির্যাতিতদের নেতা। বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় বিপ্লবী কৃষকনেতা তিনি।
ভাসানীর বিপ্লবী চেতনার জন্ম রাজনৈতিক সমাবেশে হয়নি। সংগ্রামের উর্বর জমিন থেকে অঙ্কুরিত হয়েছে। তিনি শুধু একজন নেতা ছিলেন না। তিনি সেই হতভাগ্যদের একজন ছিলেন। এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যখন তিনি পূর্ব বাংলার দরিদ্র কৃষকদের সংগঠিত করেন এবং ঔপনিবেশিক আসামের একটি নদীর চরে (ভাসান চরে) তাদের নিয়ে যান। তাদের নেতৃত্ব দেন। সেখানে ভাসানীকে আদর করে ডাকা হত ‘লাল মওলানা’। সেখানে যাদের সঙ্গে তিনি থাকতেন তারা তাকে ‘ভাসানী’ উপাধি দেন।
ঐতিহাসিক ফারাক্কা মার্চ
উন্নত জীবনের জন্য বাংলাদেশের লড়াইকে ভাসানী অভ্যন্তরীণ গণ্ডির বাইরে নিয়ে গেছেন। স্বাধীনতার পরপরই ভারতের ফারাক্কা বাঁধ প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ ব্যাহত করতে শুরু করে। বাংলাদেশের ওপর যা গভীর প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশী কৃষি, মৎস্য ও জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়ে। ভারতের সাথে পানি বণ্টনের বিরোধ নিরসন অধরা রয়ে যায়।
আজকের আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে, এটি একটি পরিচিত সত্য যে, একটি অঞ্চলের পরিবেশগত ক্ষতি পুরো গ্রহের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে নদীর মতো যৌথ সম্পদের ক্ষেত্রে সত্য। ঔপনিবেশিক শাসকশ্রেণি নবগঠিত জাতিগুলোর জন্য যেমন করে সীমানা নির্ধারণ করে, তাতে প্রায়ই নদীর মতো জলাধারগুলো বিভক্ত হয়ে যায়। সম্মিলিত দায়িত্বের পরিবর্তে সেখানে ব্যক্তিগত (রাষ্ট্রগত) খবরদারি প্রতিষ্ঠিত হয়। নদীর উজানে অবস্থিত রাষ্ট্র জলাধারের নিয়ন্ত্রণসুবিধা হাতে পেয়ে নিজস্ব প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়। যা ভাটির দেশগুলোকে বিপদে ফেলে। উত্তেজনা দেখা দেয়। সংঘর্ষের দিকে পরিচালিত করে। বাংলাদেশ তার একটি বড় উদাহরণ।
১০৭৫ সালে ফারাক্কা ব্যারাজ নির্মাণ করে ভারত গঙ্গার পানি ব্যাপকভাবে প্রত্যাহার করে, তুলে নেয়, যা বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, মৎস্য ও জনস্বাস্থ্যকে বিপদগ্রস্তু করে। প্রাকৃতিক প্রবাহে এই ব্যাঘাত নদী ব্যবস্থাকে মৌলিকভাবে পরিবর্তিত করে ফেলে, যা সমগ্র পরিবেশগত ভারসাম্যকে বিপর্যস্ত করেছে।
বিশেষ করে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এর পরিণতি মারাত্মক। মানুষ আপাতত জীবিকা হারিয়েছে। বস্তুত তাদের ভবিষ্যৎ জীবনও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম হুমকি/বিপদগুলোর মধ্যে এটি রয়েছে৷
ভাসানী গঙ্গা থেকে ভারতের অযাচিত পানি সরানোর প্রতিবাদ করেন। ঐতিহাসিক ‘ফারাক্কা লং মার্চ’ তার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের একটি শক্তিশালী প্রতীক। ভাসানীর লিগ্যাসি আমাদের মনে করিয়ে দেয় কো-অপারেশনের জরুরি প্রয়োজনীয়তার কথা। নদীমাতৃক দেশগুলোকে অবশ্যই জাতীয় স্বার্থের বাইরে যেতে হবে এবং গঙ্গার মতো একটি প্রাণদায়ী সম্পদকে যৌথ লাইফলাইন হিসাবে স্বীকৃতি দিতে হবে। কেবল পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমেই এই গুরুত্বপূর্ণ নদীর অববাহিকায় বসবাস করা মানুষ ও প্রকৃতির জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যত নিশ্চিত করা সম্ভব।
লাল মওলানা লিগ্যাসি
বাংলাদেশের ইতিহাসে মওলানা ভাসানীর স্থান পাথরে খোদাই করা। ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের পতন ঘটানো ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তার নেতৃত্ব একজন জননায়ক হিসেবে তার মর্যাদা/লিগ্যাসি আরও দৃঢ় করেছিল। সে সময় যখন সারাদেশে শিক্ষার্থী ও নাগরিকদের প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে, তাদের দাবি ছিল স্পষ্ট, শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বানোয়াট আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন। ভাসানী তার অটল চেতনার অনুঘটক হয়ে সেই আন্দোলনকে এগিয়ে নেন।
ভাসানীর নির্দেশনায় পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনগণ ক্রমাগত মুজিব ও তার সহযোদ্ধাদের মুক্তি দাবি করেন। তারা আইয়ুবি শাসনের পতনের ডাক দেন। বন্দী মুজিবকে (তখনও বঙ্গবন্ধু উপাধি পাননি) আইয়ুব খানের একটি গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের শর্তসাপেক্ষে মুক্তির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন ভাসানী। ভাসানী বলেন, আগে নিঃশর্ত মুক্তি। যা একটি সাহসী পদক্ষেপে। আগরতলা মামলা প্রত্যাহার না হলে ভাসানী ঢাকা সেনানিবাসে মার্চ করার হুমকি দেন। এই সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ কার্যকর প্রমাণিত হয়। ওই বছরই ২২ ফেব্রুয়ারি চাপের মুখে মাথা নত করেন আইয়ুব খান, যা আজ ইতিহাস।
বাঙালি জাতীয়তাবাদের অগ্রগণ্য নেতা হওয়া সত্ত্বেও, তিনি ‘মুসলিম বাংলা’ গঠনের আহ্বান জানান, যা নবগঠিত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টির আশঙ্কা জাগিয়েছিল। এই বৈপরীত্য সত্ত্বেও ভাসানী বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন প্রসিদ্ধ, বিশেষভাবে চিহ্নিত নেতা হিসেবে রয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যার অটল অঙ্গীকার ছিল। তিনি কখনোই ক্ষমতার পেছনে ছোটেননি। বরং প্রকৃত নেতার মতো প্রবল প্রভাব বিস্তার করেছিলেন।