যন্ত্রচালিত রিকশার নিষেধাজ্ঞা এক স্বৈরাচারী সিদ্ধান্ত
আহমেদ খিজির
প্রকাশ: ১৬ মে ২০২৪, ০৯:৩৭ পিএম
ঢাকা শহর থেকে ব্যাটারিচালিত রিকশা উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের কড়া ভাষায় সমালোচনা করে দুর্ঘটনার জন্য এই রিকশাকে দায় দিয়েছেন।
সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে এক শ্রেণির মানুষ এই সিদ্ধান্তের খুব প্রশংসা করছেন। যুক্তি হিসেবে তাঁরা বলছেন, এই রিকশাগুলো যারা চালায় তাঁদের প্রশিক্ষণ নেই এবং রিকশাগুলো যান্ত্রিকভাবে ত্রুটিপূর্ণ বলে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, তাই দুর্ঘটনা বেশি হয়। আরো একধাপ এগিয়ে কেউ কেউ বলছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানো খুব আরামের বিধায় গরিব মানুষেরা গ্রামে কৃষিকাজ বাদ দিয়ে এই পেশায় নিযুক্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ আবার বলছেন, ব্যাটারিচালিত রিকশায় বিপুল বিদ্যুৎ অপচয় হচ্ছে।
কাদের সাহেবের আলাপ দিলে এই লেখা অনেক বড় হয়ে যাবে, বরং কাদের সাহেবের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানের কথা একটু বলা যাক। উনি ব্যাটারিচালিত রিকশার পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ সব বাস পুড়িয়ে দেওয়ার জন্য উত্তেজিত আহ্বান করেছেন।
আলাপটা শুনতে খুবই ভালো লাগার কথা। ফিটনেসবিহীন লক্কর-ঝক্কর গাড়ি রাস্তায় কোনোভাবেই চলতে দেওয়া উচিত না। কিন্তু, আমাদের মনে রাখা দরকার এই খান সাহেব একবার বলেছিলেন, গরু ছাগল চিনলেই বাস-ট্রাক চালানোর ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া যায়, ট্রেনিং বা শিক্ষার দরকার নাই। উনার দলের হেলমেট পরা ছেলেরা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে নামা শিশুদের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছিল। শহর কিংবা হাইওয়ের হিসাবে বাংলাদেশ দুনিয়ার মধ্যে অন্যতম দুর্ঘটনাপ্রবণ দেশ, অথচ খান সাহেবরা সব দায় চাপিয়ে দিলেন ব্যাটারিচালিত রিকশার ওপর।
কারণ, এর পিছনে স্বার্থ কোটি কোটি টাকার বাসমালিকদের। ড্রাইভিং লাইসেন্স যত সহজ হবে, ততো কম পয়সায় তাঁরা অদক্ষ ড্রাইভার পাবে। আর, এইসব ড্রাইভাররা নিজেদের অধিকার নিয়েও সচেতন হবে না। ফলে, এদের দিয়ে অমানুষের মতো গাড়ি চালানো যাবে। একেতো অদক্ষ চালক, তদুপরি বিশ্রাম ছাড়াই ঘণ্টার পর ঘণ্টা দিনের পর দিন গাড়ি চালানোর ফল নিয়মিত দুর্ঘটনা।
আমরা সাদা চোখে দুর্ঘটনায় ড্রাইভারদেরই দোষ দেখি, অথচ এর পেছনের কারণগুলো তলিয়ে দেখি না। আর শ্রমিকরা যাতে বিদ্রোহী না হয়, সেজন্য খান সাহেবরা তো আছেনই। শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলে, আসলে শ্রমিকদের মানবেতর, ইতরের জীবন যাপনে বাধ্য করেন তাঁরা। শহর এলাকায় ড্রাইভার আর হেল্পারদের বেলাতেও ব্যাপারটা সত্য।
এবার আসা যাক রিকশা নিয়ে। বহুবছর ধরে রিকশার বিপক্ষে আলাপ চলছে। শহরের গতি শ্লথ হয়ে যাবে, উন্নত দেশে রিকশা নাই এসব বলা হচ্ছে। কিন্তু, গণপরিবহনের যে অরাজকতা, তা ঠিক না হওয়া পর্যন্ত রিকশা চলতে দিতেই হবে। এই শহরে বাসে উঠার জো নেই, ফুটপাত দখলে থাকায় আর রাস্তার পরিকল্পনা যথাযথ না হওয়ায় হাঁটারও উপায় নেই।
ফলে, রিকশা ছাড়া কিছুক্ষেত্রে উপায় নেই। আর, গতির কথা বলা হলে, শহরের গড় গতি রিকশার গতির চেয়ে বেশি না। রিকশা অবশ্যই আদর্শ যানবাহন নয়, তবে বর্তমানে রাস্তার অবস্থা আর পরিবহনের সমস্যা ঠিক করলেই রিকশা উঠানো সম্ভব। আর,রিকশা যদি থাকেই, তবে যান্ত্রিক রিকশাই থাকা উচিত। একজন মানুষ প্রচণ্ড পরিশ্রম করে আরেকজন মানুষকে টেনে নিচ্ছে এই ব্যাপারটা যেমন নীতিগত ভাবে অমানবিক, দেশের মানুষের এই বিপুল শক্তিক্ষয়ও ঠিক না। প্রযুক্তির মূল কাজ মানুষকে আরাম দেওয়া। গরীব বলে রিকশাওয়ালারা সেই আরাম পাবে না এই চিন্তাটা অতি জঘন্য।
আর, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে লাখো লাখো রিকশাচালকদের হুট করেই বেকার করে দেওয়া অর্থনীতির জন্যও হুমকি। কৃষিকাজ এখন লোকসানিতে পরিণত হয়েছে, গ্রামে কর্মসংস্থান নেই, শহরেও যথেষ্ট চাকরি নেই। এই অবস্থায় লাখো লোককে বেকার করা মারাত্মক ব্যাপার হবে। এই রিকশাগুলো সব মিলিয়ে যেই পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ করে বড় বড় মার্কেটগুলোতে এর চেয়ে বেশী ব্যয় হয়। লাখো লাখো পরিবারের কর্মসংস্থানের কথা শহরের মানুষের সেবার কথা ভাবলে এই বিদ্যুৎ তেমন বড় সমস্যা না। ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা দেয়া আর বিদ্যুৎ খাতের দুর্নীতি কমানো গেলে রিকশার পেছনে ব্যয় হওয়া বিদ্যুৎ তেমন কোন বিষয়ই না।
শেষ প্রশ্নটা থাকে, ব্যাটারিচালিত রিকশার উন্নতি নিয়ে। কোনো সন্দেহ নাই, এই প্রযুক্তির উন্নতি দরকার। এর জন্য গবেষণা দরকার। বাংলাদেশের পক্ষে হয়তো এই মুহূর্তে গাড়ি উৎপাদন করা সম্ভব না, উন্নত বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দেয়াও সম্ভব না, কিন্তু ব্যাটারি বা যন্ত্রচালিত রিকশায় বিপুল উন্নয়ন করা সম্ভব। এইসব যানবাহনকে অনেক বেশি নিরাপদ ও কার্যকরী করে তোলা সম্ভব।
এতে, আরেকটা বড় লাভ হবে। সারা দুনিয়া এখন পরিবেশ নিয়ে সচেতন। তেলের গাড়ি তো বটেই, ইলেকট্রিক গাড়িতেও নানাভাবে পরিবেশের দূষণ হয়। রিকশার প্রযুক্তি যদি সত্যিই একটা পর্যায়ে নেয়া যায়, তবে এই যানটি উন্নত বিশ্বেও জনপ্রিয় হতে পারে। আমাদের লক্কর-ঝক্কর আর মান্ধাতার আমলের রিকশা দেখে কেউ কেউ হয়তো তা কল্পনাও করতে পারছেন না, তবে প্রযুক্তির ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এই স্বপ্ন দেখা অসম্ভব না।
কিন্তু, এইসব চিন্তা করতে হলে গণতান্ত্রিক হতে হয়। মানুষের কথা, দুনিয়ার কথা ভাবতে হয়। আমাদের ভোটবিহিনী নেতাদের থেকে এইসব চিন্তা আশা করা অবান্তর। উনারা, কোটি কোটি টাকার গাড়ি আর এদের যন্ত্রাংশের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। উনারা কীভাবে গরীব শ্রমিকদের আরো বেশি শোষণ করে পয়সা কামানো যায় সেই চিন্তার মত্ত। এমনকি ব্যাটারি রিকশা নিয়েও লাখো লাখো টাকার বাণিজ্য হবে। এইগুলো কাগজে কলমে নিষেধ হবে কিন্তু ট্রাফিকদের ঘুষ দিয়ে পাড়ায় পাড়ায় চলবে। বিভিন্ন নেতাদের ঘুষ দিয়ে ম্যানেজ করা হবে। একটা গণতন্ত্রহীন দেশে মাফিয়াদের সহজ টার্গেট হবে রিকশা।