সামাজিক
মনোবিজ্ঞানী জোনাথন হাইড্টের নতুন বই ‘দ্য অ্যাংশাস জেনারেশন’
একটি জরুরি পদক্ষেপের আহ্বান জানাচ্ছে। তিনি বলছেন, প্রমাণ রয়েছে যে, স্মার্ট ফোনের ব্যাপক ব্যবহার কিশোর-কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যে সংকট সৃষ্টি করছে।
তাদের
স্মার্ট ফোনের ব্যবহার
সীমিত করার জন্য ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত এমনি আইনি পদক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করেন হাইড্ট।
হাইড্ট তার
বইটি রূপক দিয়ে শুরু করেছেন: কল্পনা করুন যে, কেউ আপনাকে আপনার দশ বছর বয়সী
সন্তানকে মঙ্গল গ্রহে বড় হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। যদিও বিশ্বাস করার সমস্ত কারণ রয়েছে যে, বিকিরণ ও কম মাধ্যাকর্ষণ
কিশোর-কিশোরীদের বিকাশ ব্যাপকভাবে ব্যাহত করতে পারে, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদি দুর্দশার দিকে এগিয়ে দিতে পারে। নিশ্চয় আপনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করবেন।
এক
দশক আগে, চকচকে নতুন স্মার্ট ফোন হাতে পেয়ে কিশোর-কিশোরীরা যখন আনন্দে উত্তেজিত থাকত তখন সেই স্মার্ট ফোনের
হুমকিগুলি সম্পর্কে অভিভাবকরা কিছুই
জানত না। এখন দিনে দিনে প্রমাণের পাল্লা ভারী হচ্ছে যে, যেসব শিশু-কিশোর স্মার্ট ফোন নিয়ে বড় হয়েছে তাদের এক ধরনের মানসিক লড়াইয়ে নামতে হচ্ছে।
হাইডটের গবেষণা
অনুযায়ী, ২০১০-১৫ সময়কালে
যখন প্রায় সবার হাতে স্মার্ট ফোন পৌঁছে গেছে, ক্ষতির মাত্রাও এই সময় নাগাদ সর্বোচ্চ
পর্যায়ে পৌঁছায়। বয়ঃসন্ধিকালে
ব্যাপক পরিমাণে স্মার্ট ফোন ব্যবহারের ফলে তাদের স্নায়ুতন্ত্রে চাপ বাড়ে এবং মানসিক
বিষণ্ণতা জেঁকে বসতে থাকে।
শিশু-কিশোররা ভালো নেই
হাইড্ট বলছেন,
বিশ্বাস করার মতো যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, শিশু-কিশোররা মানসিক রোগের মহামারিতে ভুগছে। এর জন্য মূলত স্মার্ট
ফোনই দায়ী।
এর
অর্থ এই নয় যে, শিশু-কিশোরদের স্মার্ট ফোন থেকে
অবশ্যই বিচ্ছিন্ন করতে হবে। কিন্তু তাদের মাত্রা অনুযায়ী নিরুৎসাহিত করা দরকার।
অনেক বিশেষজ্ঞ
মেনে নেননি যে, শিশুদের মধ্যে উদ্বেগ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। হাইড্ট তাদের জন্য যুক্তি ও বিভিন্ন
উৎস তথ্য-প্রমাণ হাজির করেছেন। এসব তথ্য-প্রমাণের
মধ্যে রয়েছে আত্মহত্যার
হার, মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালে ভর্তির হার প্রভৃতি। সেগুলো বিশ্লেষণ
করে হাইড্ট বলছেন, তরুণ প্রজন্ম স্মার্ট ফোনের কারণে মানসিক রোগের মহামারিতে ভুগছে।
হাইড্ট মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য-উপাত্তকে
প্রাধ্যান্য দিয়েছেন, তবে
অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা অনেক দেশের শিশু-কিশোর ও তরুণ-যুবাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সমসাময়িক পরিবর্তনগুলি পর্যবেক্ষণ করেছেন।
সময়ের সাথে
সাথে সমস্যার ধরন-কারণ ধারাবাহিকভাবে
বৃদ্ধি পেয়েছে
বলে দেখিয়েছেন হাইড্ট। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের
পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তিনি দেখিয়েছেন,
২০১০ সালের আগের চেয়ে পরে কিশোর-কিশোরীদের
মানসিক স্বাস্থ্য-সমস্যাগুলি ৫ থেকে ১০ শতাংশ বেশি।
তবে ‘উদ্বিগ্ন
প্রজন্ম’ কিছুটা
বিভ্রান্তিকর। নতুন প্রজন্মের
সিংহ ভাগেরই উদ্বেগজনিত
ব্যাধি নেই বলে দেখিয়েছেন অনেকে। এক্ষেত্রে
হাইড্ট বলছেন, এমন তথ্যও
রয়েছে যে, যাদের মানসিক রোগ নেই তাদেরও অনেকে ক্রমবর্ধমান হারে একাকীত্ব ও অন্যান্য মানসিক
সংকটে ভুগছে। এই সমস্যা ব্যাপক হারে এসেছে স্মার্ট ফোনের কারণে।
হাইড্ট গ্রাফ
এঁকে দেখিয়েছেন যে, সবচেয়ে
উদ্বেগের বিষয়টি বর্তমান পরিসংখ্যান নয়; বর্তমান গতিপথ। অর্থাৎ পরিস্থিতি যেদিকে এগিয়ে
যাচ্ছে সেদিকে দৃষ্টিপাত করেন জোনাথন হাইড্ট। তিনি বলছেন, প্রায় সব ক্ষেত্রেই পরিস্থিতি
খারাপ হচ্ছে।
উদ্বেগের প্রধান অনুঘটক
স্মার্ট ফোন
প্রাথমিকভাবে বড় রকম উদ্বেগ বাড়ায়নি। সমস্যাগুলি ২০১০ সালের দিকে শুরু হয় যখন তারা
সোশ্যাল মিডিয়া, উচ্চগতির ইন্টারনেট, স্মার্ট ফোনে ক্যামেরা এবং সেলফি তোলাকে উৎসাহিত করা, আসক্তিমূলক গেমস, সহজপ্রাপ্য পর্নোগ্রাফি ও বিনামূল্যের অ্যাপ
অধিক হারে সংক্রামক হয়ে ওঠে।
এই
‘বিষাক্ত’ প্রযুক্তিগুলো শিশুদের জীবন দখল করে ফেলে। দিনে গড়ে সাত ঘণ্টার ব্যবহার করলেও ধীরে ধীরে তা পরেও গভীরভাবে তাদের মস্তিষ্ক পুনর্ব্যবহার করে। হাইড্ট মনে করেন, এই পুনর্ব্যবহার মূল
উদ্বেগের জন্ম দেয়।
একজন কিশোর
একাকী বোধ করতে পারে। সে সংযোগ চায়। তাই তারা ইনস্টাগ্রাম বা টিকটকে যোগ দেয়। সোশ্যাল
মিডিয়া এক ধরনের সংযোগ প্রদান করে। কিশোর-কিশোরীরা তাৎক্ষণিক প্রয়োজন এমনভাবে পূরণ
করে যাতে বাস্তব বিশ্বের সংযোগ এবং চ্যালেঞ্জ জড়িত নয়। এটি তাদের দীর্ঘমেয়াদে একাকী
এবং আরও বিচ্ছিন্ন করে তোলে।
স্মার্ট ফোন
বাস্তব অভিজ্ঞতা অবরোধ করে। তা না হলে শিশুরা
বন্ধু ও পরিবারের সাথে
মিশতে পারে। সামাজিক হয়ে উঠতে
পারে যা তাকে ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অভিজ্ঞতা দিতে পারে। স্মার্ট ফোন সেই পথ রুদ্ধ করছে।
অনেক
কিশোর-কিশোরী গভীর রাতে স্মার্ট ফোনে থাকে। অথচ তখন তাদের বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন।
স্মার্ট ফোন
ক্রমাগত কিশোর-কিশোরীদের বর্তমান মুহূর্ত থেকে দূরে টেনে নিয়ে যায়।
অ্যাপ
ও সোশ্যাল মিডিয়া তাদের মনকে দুর্বল করে। তাদের মনকে হ্যাক করার জন্যই এসব অ্যাপ ও সোশ্যাল মিডিয়া
তৈরি করা হয়েছে। এগুলো তাদের অন্য কিছু উপভোগ করতে দেয় না।
এখন তাহলে আমরা কী
করতে
পারি
এখনআমরা যদি
হাইড্টের দাবি মেনে নিই, তাহলে আমাদের কী করা উচিত তা পরিষ্কার নয়।
সম্ভবত মৌলিক কোনো সমাধান নেই। হয়ত সময়ের সাথে সাথে নতুন কোনো থিয়োরি উদ্ভাবনের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হবে।
তবে হাইড্ট
চারটি নির্দেশনা দিয়েছেন, যেখানে আইন প্রণয়ন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার
পাশাপাশি অভিভাবকের সম্মিলিত পদক্ষেপ কাজে লাগতে পারে।
১. উচ্চ
বিদ্যালয়ের আগে স্মার্ট ফোন নয়
২. বয়স ১৬
বছরের আগে সোশ্যাল মিডিয়া নয়
৩. ফোনবিহীন
বিদ্যালয়
৪. বাস্তব
জগতে যত দূর সম্ভব শিশু-কিশোরদের
ওপর কিছু দায়িত্ব আরোপ,
তাদের স্বাধীনতা দেওয়া এবং
খেলাধুলার সুব্যবস্থা।