Logo
Logo
×

অভিমত

ভারতের বিজ্ঞান চর্চাকে যেভাবে ধসিয়ে দিলেন মোদী

রামচন্দ্র গুহ

রামচন্দ্র গুহ

প্রকাশ: ০৯ মে ২০২৪, ১১:৩৭ পিএম

ভারতের বিজ্ঞান চর্চাকে যেভাবে ধসিয়ে দিলেন মোদী

২০০৯ সালে দেশের শীর্ষস্থানীয় বৈজ্ঞানিক গবেষণা কেন্দ্রের দুই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের সঙ্গে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। দুইজনই আমাকে বলেছিলেন, তারা বিদেশের গবেষণা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান থেকে ভালো চাকরির অফার পেয়েছেন। এটা খুবই দারুণ ঘটনা ছিল, কারণ ভারতীয় বিজ্ঞানীদের বিদেশে চাকরির জন্য দেশ ত্যাগের ঘটনা তারা খুব ভালো করেই জানতো। চাকরি নিয়ে বিদেশ চলে যাওয়ার ঘটনা তখন খুবই স্বাভাবিক এক ঘটনা ছিল। তারপরও তাদের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রের কিছু বিজ্ঞানী পশ্চিম থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরছিলেন। 

মেধা পাচারের ওইসব ঘটনার পেছনে নানা কারণ ছিল। ওই সময় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তহবিলকে সংকুচিত করে ফেলেছিল। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন কাউকে নিয়োগ দিতে পারছিল না। 

একই সময়ে গবেষণা ও মেধাবৃত্তিতে ভারত বেশি ব্যয় করছিল। কেন্দ্রীয় সরকার ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ’ শিরোনামের অধীনে উচ্চ মান সম্পন্ন অনেকগুলো গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। এ ছাড়া বেশকিছু নতুন আইআইটি শাখাও খোলে। এসবই প্রতিভাবানদের ফ্যাকাল্টি হিসেবে যোগদানে আকর্ষণ তৈরি করে। 

১৯৪০ ও ১৯৫০ এর দশকে বিদেশে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের পর অসম্ভব মেধাবী কিছু পণ্ডিত ভারতে ফিরে এসেছিলেন। এমনকি পশ্চিমে তারা মর্যাদাপূর্ণ চাকরির সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও দেশে চলে এসেছিলেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন বিশ্বমানের বিজ্ঞানী ইকে জানকি আম্মাল, হোমি জাহাঙ্গীর ভাভা, এমএস স্বামীনাথন, সতীশ ধওয়ান ও ওবায়েদ সিদ্দিকি। দেশে ফিরতে তাদের প্রাথমিক চালিকা শক্তি ছিল দেশপ্রেম। এসব প্রতিভাবান ব্যক্তি জাতীয় আন্দোলনের সময় ভারতে বেড়ে ওঠেন এবং সেই মূল্যবোধ দিয়ে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত ছিলেন। পরাধীন ভারত যখন স্বাধীন হলো তখন তারা দেশটির ভবিষ্যত গঠনে সাহায্য করতে ফিরতে চেয়েছিলেন। 

যদিও পরবর্তী দশগুলোতে বিদেশে পিএইচডি করা ব্যক্তিরা কাজের জন্য সেখানেই থাকতে চেয়েছেন। এর কারণ তখনকার বেশিরভাগ বিজ্ঞানীই প্রাথমিকভাবে দেশপ্রেম দিয়ে অনুপ্রাণিত ছিলেন না। তারা স্বাধীন গবেষণা চালাতে স্বাধীনতা চেয়েছিলেন। তারা জীবন যাপনের জন্য মোটামুটি ভালো একটা সামাজিক পরিবেশ চেয়েছিলেন, যে পরিবেশে তাদের পরিবার বেড়ে উঠতে পারবে। এসব মানদণ্ডগুলো পূরণ হলেই কেবল তারা নিজ দেশে কাজ করতে চাইতেন। 

২০০৯ সালে বেঙ্গালুরুর ওই রাতের খাবারের সময়কার আলাপচারিতায়, ভারতীয় বৈজ্ঞানিক বাস্তুতন্ত্রকে তার আগের সময়ের চেয়ে বেশ প্রতিশ্রুতিশীল মনে হয়েছিল। অর্থনীতি ভালোই চলছিল, ফলে অ্যাকাডেমিক বেতনও বেশ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এ ছাড়া সামাজিক বন্ধনও আগের দশকগুলোর তুলনায় অনেক বেশি সহনশীল ও মানানসই মনে হচ্ছিল। আগের দুই দশকের সাম্প্রদায়িক মেরুকরণও কমে গেছিল বলে মনে হয়েছিল। 

স্বাধীনভাবে গবেষণা করতে চাওয়া কোনো তরুণ বিজ্ঞানীর জন্য, যিনি একইসঙ্গে আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা চান, তার জন্য ১৯৯৯ বা ১৯৮৯ বা ১৯৭৯ এর তুলনায় ২০০৯ সালে ভারতে চাকরি খোঁজার একটা ভালো সময় ছিল। ওই সময় বিদেশে শিক্ষা নেওয়া অনেক বিজ্ঞানী পশ্চিমকে পেছনে ফেলে কাজ করতে দেশে ফিরছিলেন। 

১৫ বছর পর এখন অবস্থা কি একইরকম আকর্ষণীয় রয়েছে? বিদেশে পিএইচডি করা কোনো তরুণ বিজ্ঞানী এখন কি ভারতে ফিরে আসার চিন্তা করবে? এই ব্যাপারে আমি খুব সন্দিহান। এর বড় কারণ হলো নরেন্দ্র মোদী শাসিত বর্তমান সরকার। কারণ এই সরকার বৈজ্ঞানিক গবেষণার ক্ষেত্রে তৎকালীন মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকারে চেয়ে বেশি বৈরীভাবাপন্ন। মনমোহন নিজে একজন স্কলার ছিলেন। বিশ্বের বিখ্যাত দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। তিনি আধুনিক বিজ্ঞানের অবদানকে গভীরভাবে প্রশংসা করতেন। 

অন্যদিকে স্বশিক্ষিত মোদী মেধাবী উচ্চশিক্ষিতদের অবজ্ঞা করেন। এটা ঠিক যে মর্যাদাপূর্ণ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করা পুরুষ (নারী কিছুটা কম ) অহংকারী ও নাক উঁচু স্বভাবের হতে পারেন এবং আম আদমির (খেটে খাওয়া মানুষ) জীবন তাকে স্পর্শ নাও করতে পারে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণার শক্ত ভিত ছাড়া কোনো অর্থনীতি বা জাতিরই কখনো টেকসই অগ্রগতি হয় না। 

জওহরলাল নেহেরুরও এমনটা ভাবতেন। তাই তো তিনি আইআইটি স্থাপন করেছিলেন এবং টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছিলেন। একইভাবে মনমোহন সিংও আইআইএসইআর প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেছিলেন। নেহেরু এবং সিং—এই দুই প্রধানমন্ত্রীই মৌলিক গবেষণা প্রসার করেছেন। বিশেষ করে জীববিজ্ঞানে, যা এখন বিজ্ঞানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করা পদার্থবিদ্যার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। খুব আগে না হলেও গত শতাব্দির আশির দশকেও স্বদেশী প্রতিষ্ঠানগুলি নিজেরাই দারুণ সব পিএইচডি দেওয়ার ধারা তৈরি করেছিল। 

২০১৪ সালের পর থেকে এই সব পরিবর্তিত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদীর কাছে সেইসব প্রযুক্তিগত প্রয়োগই কিছুটা পাত্তা পেয়েছে, যেগুলো তাকে রাজনৈতিক সুবিধা দিতে পারে। আর এই কারণেই তিনি ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতা করেন। এ ছাড়া বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গবেষণার উৎকর্ষতায় তার তেমন আগ্রহ নেই। এইভাবেই তিনি হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শীদেরকে আইআইটির কার্যক্রমে ইচ্ছাকৃতভাবে হস্তক্ষেপের সুযোগ দিয়েছেন। যেখানে অতীতে এই ইনস্টিটিউটের পরিচালক নিয়োগ দিতেন কেবল তাদেরই একাডেমিক সহকর্মীরা। কিন্তু মোদীর শাসনামলে নিয়োগের সংক্ষিপ্ত তালিকা সক্রিয়ভাবে ডানপন্থী দলকানাদের দিয়ে যাচাই করা হয় এবং তাদের লাইন অনুসরণের সম্ভাবনা রয়েছে তাদেরেই কেবল নির্বাচিত করা হয়। একবার দেখলাম আইআইটির কিছু পরিচালক সাংঘি মতবাদের প্রতি বিস্তৃত ভক্তি শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন, মাংস খাওয়া ভারতীয়দের অবমাননা করছেন। তারা ক্যাম্পাসে গোশালা খুলেন এবং স্বাধীনচেতা পণ্ডিতদের সঙ্গে ছাত্রদের কথা বলা থেকে বিরত রাখেন।

হিন্দুত্ব দিয়ে ভারতীয় বিজ্ঞানে আদর্শগত অনুপ্রবেশের স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় গত মাসে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিভাগের সচিবের এক্সে (সাবেক টুইটার) করা ৯টি টুইট থেকে। টুইটগুলোতে বেঙ্গালুরুর ভারতীয় অ্যাস্ট্রোফিজিক্স ইনস্টিটিউটের প্রশংসা করা হয়। কারণ ওই ইনস্টিটিউট এমন এক সিস্টেম ডিজাইন করেছে যার মাধ্যমে  অযোধ্যায় নবনির্মিত রাম নবমীর মন্দিরের মূর্তির উপর সূর্যের আলো ফেলা হয়েছিল। 

সরকারের বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানের সচিব হিসেবে চাকরি নেওয়ার আগে এই টুইটকারী ব্যক্তি কানপুরে অবস্থিত দেশের অন্যতম সেরা আইআইটি প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন। তাই তার টুইটগুলো নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়। এমনকি কিছু সমালোচক এও বলেছিলেন, সেক্রেটারি যেটিকে ভারতীয় বিজ্ঞানের এক মহান অবদান হিসেবে প্রশংসা করছেন তা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়া কোনো চতুর শিক্ষার্থীই বানিয়ে দেখাতে পারবে। 

বিষয়টি নিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। আমার এই বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থের ওপর পিএইচডি করে ভারতে ফিরে কয়েক দশক ধরে অধ্যাপনা এবং গবেষণা করেছেন। বন্ধু আমাকে ধৈর্য সহকারে ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে শৈল্পিকভাবে লেন্স এবং আয়নাগুলি ডিজাইন করে এবং কৌশলগতভাবে উপযুক্ত স্থানে তা স্থাপন করে, সূর্য ও চন্দ্র চক্রের মধ্যে বিভক্তি/সংযোগ গণনা করে, নির্ধারিত দিনে অযোধ্যার ওই মূর্তির উপর সূযের আলো ফেলা হয়েছিল। এটা বিজ্ঞানের মাঝারি মানের কাজ। কোনোভাবেই যুগান্তকারী নয় এবং অবশ্যই দেশের শীর্ষ বৈজ্ঞানিক সংস্থার কর্তা ব্যক্তির এমন ঢালাও প্রশংসা পাওয়াও যোগ্য নয়।

সম্ভবত ওই সচিব একজন ধর্মপ্রাণ হিন্দু। তবুও সম্ভবত তিনি সচেতনভাবেই জানেন, তার এই প্রশংসা কোনো  আধ্যাত্মিক কারণে নয় বরং রাজনৈতিক কারণেই ছিল। কারণ সাধারণ নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে মন্দিরটি প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছিলেন এবং নিজেকে এর প্রধান উদ্যোগ গ্রহণ ও প্রেরণাকারী, এমনকি প্রধান পুরোহিত হিসেবেও উপস্থাপন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। ওই সচিবকে অবশ্যই জানতে হবে পাথরের মূর্তির উপর আলো জ্বালানোর চেয়ে আরও উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক কাজ করার জন্য ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্স প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।  

রাজনৈতিক কারণেই তিনি সম্ভবত এই মর্যাদাপূর্ণ ইনস্টিটিউটের করা সবচেয়ে তুচ্ছ বৈজ্ঞানিক কাজগুলির একটিকে মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বেছে নেন। এটি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক পোষ্য প্রকল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং দেশে ভোট শুরু হওয়ার মাত্র কয়েক দিন আগেই ঘটনাটি ঘটল। এই ঘটনা কাকতালীয় হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

সংবাদমাধ্যমের উপর মোদী সরকারের আক্রমণ, সিভিল সার্ভিস এবং কূটনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতিকরণ, সশস্ত্র বাহিনীকে সাম্প্রদায়িক করার প্রচেষ্টা এবং স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলি অধীনস্থ করার প্রচেষ্টা— এ সবই ব্যাপকভাবে মানুষের নজরে পড়েছে এবং নথিভুক্ত হয়েছে। কিন্তু মোদীর আমলে যে ভারতে বিজ্ঞান চর্চার অবমূল্যায়ন বা অবনমন হয়েছে সে বিষয়টিতে খুব একটা চোখ পড়েনি। তাই খুব সম্ভবত ওই সচিবের সেই আনাড়ি (একইসঙ্গে ভুল সময়ের) টুইটগুলি শেষ পর্যন্ত আমাদের এই শাসনের ক্ষতি সম্পর্কে আরও সচেতন করে তুলবে। 

নাৎসিদের জাতিতত্ত্ব জার্মানদের বিজ্ঞান ধ্বংস করে দিয়েছে। কয়েক দশক আগে মার্কসবাদী রাজনৈতিক মতবাদ দিয়ে রাশিয়ান বিজ্ঞান প্রতিষ্ঠিত হয়। এখন আমাদের দেশে আমাদের সেরা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের তাদের গবেষণা হিন্দু, হিন্দুত্ব ও নরেন্দ্র মোদীর বৃহৎ গৌরব নিয়ে করতে বলা হয়েছে। ভারতে বিজ্ঞান চর্চা এবং বিজ্ঞানীদের মনোবলে তা কেমন প্রভাব ফেলবে? যখন বিজ্ঞানের স্বার্থ রাজনীতি ও ধর্মের অধীন করা হয়, তখন কি সেখানে কাজ করা মেধাবী গবেষকরা বিদেশে কাজের সুযোগ ফিরিয়ে দেবেন? একইভাবে বিদেশে প্রশিক্ষণ নেওয়া বিজ্ঞানীরা দেশে ফিরতে চাইবেন? 

রামচন্দ্র গুহ : ভারতীয় ইতিহাস ও অর্থনীতিবিদ। 

নিবন্ধটি স্ক্রোল.ইনে প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা আউটলুক পাঠকদের জন্য ভাষান্তর করা হলো। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন