‘তুই ডান্ডি, মালাউনের বাচ্চা! তুই কেন বিএনপি করিস? তোর তো আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার কথা। বল, আর বিএনপি করবি না। আমরাই তোকে আওয়ামী লীগে পদ-পদবি দেয়ার ব্যবস্থা করব। না হলে তোকে মেরেই ফেলব।’ এসব বলেই সৌরভের অণ্ডকোষ চেপে ধরেন পুলিশ সদস্য। প্রচণ্ড ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলেন সৌরভ। কোনো কথাই বলতে পারছিলেন না। অচেতন হয়ে পড়লেন। নাকে-মুখে পানি ছিটিয়ে আবারো পেটানো শুরু করলেন পুলিশ সদস্যরা।
কিন্তু না, নাছোড়বান্দা সৌরভ পুলিশকে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন। বললেন, ‘আমি তো কোনো ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করি না। বিএনপি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের রাজনীতি করে। আমি সেই রাজনীতি করি। আমাকে মেরে ফেললেও আমি আদর্শ থেকে সরব না।’ বলেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন সৌরভ প্রীয় পাল।
সৌরভ প্রীয় পাল চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে কমিটি না থাকায় দলে এই মুহূর্তে তার কোনো পদ-পদবি নেই। তবে বিএনপির হয়ে চট্টগ্রামের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে যাচ্ছেন তিনি।
৭ অক্টোবর ১৯৮৭ সালে কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া উপজেলায় সৌরভের জন্ম। টেলি যোগাযোগ বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সুরেন পাল ও শিলু পাল দম্পতির ছয় সন্তানের মধ্যে পঞ্চম সৌরভ। বাবা সরকারি চাকরিজীবী হওয়ায় খাগড়াছড়িতেই কাটে শৈশব-কৈশোর। ২০০৫ সালে খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি উপজেলার রানী নিহার দেবী সরকারি উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও মানিকছড়ি সরকারি কলেজ থেকে ২০০৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন তিনি।
২০১২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাসায়ন বিষয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন সৌরভ প্রীয় পাল। রাজনৈতিক হয়রানির কারণে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করতে পারেননি। পরে ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের ল’ টেম্পল থেকে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন সৌরভ।
ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভাল ছিলেন সৌরভ। সমানতালে চালিয়েছেন রাজনীতিও। খাগড়াছড়ির বিএনপি নেতা ওয়াদুদ ভূঁইয়ার হাত ধরে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজের প্রথম বর্ষেই ছাত্রদলের রাজনীতিতে যুক্ত হন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই আরো বেশি সক্রিয় হন ছাত্রদলে। ওই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের নেতা তৌহিদ ও মিঠুর হাত ধরে রাজনৈতিতে আরো পাকাপোক্ত অবস্থান গড়েন সৌরভ। ২০১৩ সালে ঘোষিত চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের আংশিক কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হলে সৌরভ প্রীয় পাল নগর ছাত্রদলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
সৌরভের রাজনৈতিক জীবনের পুরোটাই একপ্রকার বৈরী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে পাড়ি দিতে হয়েছে। এ সময়ের মধ্যে অন্তত চারবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও পুলিশের নির্মম হামলার শিকার হয়েছেন। করেছেন কারাবরণ। বর্তমানে ৭টি রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বয়ে বেড়াচ্ছেন সৌরভ। তিনি তার ওপর নানান নির্যাতন-নিপীড়নের কথা জানিয়েছেন বাংলা আউটলুককে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বাংলা আউটলুকের ঢাকা প্রতিনিধি।
বাংলা আউটলুক: রাজনীতিতে জড়ানোর গল্পটি বলুন।
সৌরভ: আমার সৌভাগ্য, আমি যেখানে পড়াশোনা করতাম, পার্বত্য অঞ্চলে, তখনকার এমপি ছিলেন ওয়াদুদ ভূঁইয়া। এসএসসি পাশ করার পরই ছাত্রদলে সক্রিয় হই। ২০০৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর সংগঠনের প্রতি আগ্রহ-ভালবাসা আরো বেড়ে যায়।
বাংলা আউটলুক: রাজনীতিতে সামনের সারিতে চলে আসলেন কিভাবে?
সৌরভ: ২০০৯ সালে আমি যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তখন জাতীয় নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। সরকার গঠনের কিছুদিন পরই ক্যম্পাসে ছাত্রলীগ একধরনের ত্রাসের রাজনীতি শুরু করে। ২০১০ সালের শেষ দিকে, তারিখটা ঠিক মনে নেই, ক্যম্পাসের কাটা পাহাড় এলাকায় ৮ থেকে ১০ জন ছাত্রলীগের ক্যাডার আমার ওপর হামলা করে। প্রচণ্ড মারধর করে। আমার ঊরুতে ছুরিকাঘাত করে ফেলে রেখে যায়। আমার সহপাঠীরা উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যায়। সেখান থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর আর ক্যম্পসে সক্রিয়ভাবে আর রাজনীতি করতে পারিনি।
বাংলা আউটলুক: তাহলে রাজনীতি চালিয়ে গেলেন কিভাবে?
সৌরভ: চট্টগ্রাম মহানগর রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়ি। মহানগর রাজনীতি করতে গিয়ে আমি বেশ কয়েকবার পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছি। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের হামলার শিকার হয়েছি। কিন্তু রাজনীতি থেকে আর দূরে সরিনি। প্রতিটি হামলার পর সাহস এবং সক্ষমতা বেড়েছে। সাহস নিয়ে এখনো চলিয়ে যাচ্ছি।
বাংলা আউটলুক: মারাত্মক আহত হয়েছেন এমন হামলা কতবার হয়েছে?
সৌরভ: অন্তত চারবার। এর বাইরেও বহুবার হামলা হয়েছে। তবে চারবার মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। ২০১৪ সালের শেষের দিকে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি অফিসে একবার হামলা হয়েছিল। দলীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে মিছিল করি আমরা। পুলিশ মিছিলে হামলা করে। আমরা কয়েকজন নসিমন ভবন পার্টি অফিসে আটকে পড়ি। মহিলা দলের অনেক কর্মীও আমাদের সাথে আটকে পড়েন। পুলিশ আমাদের বেধড়ক পিটিয়ে আহত করে। নারী-পুরুষ কোনো বাছবিচার ছিল না। নারীদেরও পুরুষ পুলিশ সদস্যরা এলাপাতাড়ি পিটিয়েছে। আমাদের পিটিয়ে বেহুঁশ করে ফেলেছিল। মহিলা দলের কর্মীরা পুলিশ সদস্যদের পায়ে ধরেছে, তাও শোনেনি। ওইবার আটক করেনি আমাকে। ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল পুলিশ। ২০১৯ সালে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে একটি মিথ্য মামলার ফরমায়েশি রায়ের প্রতিবাদে মহানগর ছাত্রদল বিক্ষোভ মিছিল করার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু পুলিশ আমাদের বের হতে দেয়নি। আমরা চলে যাচ্ছিলাম পার্টি অফিস থেকে। পেছন থেকে আমাদের ওপর হামলে পড়ে পুলিশ। ওদের হাতে কালো লঠি ছিল। আমি রাস্তায় পড়ে যাই। পুলিশ আমার মেরুদণ্ডের ওপর প্রচণ্ড আঘাত করে। হাড় ফ্রাকচার হয়ে যায়। দীর্ঘ চিকিৎসা নিয়েও আমি সুস্থ হতে পারিনি। এখনো আমার নেক কলার পরে থাকতে হয়। মেরুদণ্ডের হাড় আর ঠিক হয়নি।
বাংলা আউটলুক: গ্রেফতার হয়েছেন কতবার বা আটক হয়ে পুলিশি নির্যাতনের মুখে পড়েছেন?
সৌরভ: অনেকবারই আটক হয়েছি, আবার রাস্তায়ই ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু ২০২৩ সালের ২৯ নভেম্বর আমার সাথে যা হয়েছে আমি কোনো দিন ভুলব না। ভুলতে পারব না।
বাংলা আউটলুক: কি হয়েছিল ওই দিন?
সৌরভ: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে, সারা দেশের মতো চট্টগ্রামেও আমরা সরকারের পদত্যাগ ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে অবরোধ কর্মসূচি পালন করছিলাম। সকালবেলা আমার নেতৃত্বে নগরীর কাজীরদেউরি থেকে লালখান বাজার পর্যন্ত ছাত্রদলের একটি মিছিল করি। মিছিল শেষে কর্মীরা চলে যাচ্ছিল। এমন সময় ৮ থেকে ১০টি মোটরসাইকেলে সাদা পোশাকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা আমাকে ঘিরে ফেলে। আমার সাথে আরো চারজন দলীয় ছোট ভাই ছিল। আমাদের ওরা অ্যারেস্ট করে ফেলে। ধরেই রাস্তায় ফেলে আমাকে এলাপাতাড়ি ভাবে মারতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশের কয়েকটি জিপ চলে আসে। আমাদের একটি ভ্যানে তোলে। একজন অফিসার আমাকে আলাদা একটা প্রিজন ভ্যনে তুলতে বলেন। বাকি চারজনকে পুলিশের পিকআপ ভ্যনেই রেখে দেয়।
বাংলা আউটলুক: এর পর কি থানায় নিয়ে গেল?
সৌরভ: না। আমাকে প্রিজন ভ্যনে নিতে নিতেই দুই হাতের পেছন দিক দিয়ে হাতকড়া পরিয়ে ফেলে। বুঝতে পারছিলাম না আমাকে কেন আলাদাভাবে নেওয়া হচ্ছে। প্রিজন ভ্যনে তুলেই আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিতে থাকে। পেটাতে শুরু করে। গাড়ির মধ্যেই অনেকগুলো কাঠের চওড়া ফলা ছিল। ওই ফলা দিয়ে আমার শরীরের যতগুলো মাংসল জায়গা ছিল, সবখানে পেটায়। প্রিজন ভ্যানে তোলার পর যারা আমাকে মেরেছে, সবার পরনে পুলিশের পোশাক ছিল। ওদের মধ্যে দুইজন অফিসার আর তিনজন কনস্টেবল ছিলেন। ওদের কোনো নেইম প্লেট ছিল না। প্রচণ্ড পিটুনিতে আমি যখন চিল্লাচিল্লি করছিলাম, ওদের মধ্যে একজন আমার মুখ চেপে ধরে। দুই পাশ থেকে দুইজন আমাকে শক্ত করে ধরে রাখে। অন্য দুইজন আমার পায়ে মারতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ পিটানোর পর আমার শরীরে আর ব্যথা পাচ্ছিলাম না। কিছুই টের পাচ্ছিলাম না। সব অবশ হয়ে গেছিল। আমি পড়ে যাই।
বাংলা আউটলুক: এর পর কি করেছে?
সৌরভ: আমাকে খুবই অশ্লীল ভাষায় গালি দিচ্ছিল ওরা। আমি সনাতন ধর্মাবলম্বী। ওরা আমার ধর্ম নিয়ে গালি দিচ্ছিল। বলছিল, ‘তুই কেন আওয়ামী লীগ করিস না? ডান্ডির বাচ্চা হয়ে কেন তুই বিএনপি করিস? বিএনপি তোকে কি দেয়?’ আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করতাম। সে বিষয় উল্লেখ করে ওরা আমাকে বলে, ‘ফেসবুকে আর লিখবি? সরকারের বিরুদ্ধে আর বলবি? নওফেলের নামে আর কিছু লিখবি?’ আমাদের পার্টি অফিসে আওয়ামী লীগ এবং পুলিশ সর্বশেষ যে হামলাটি করেছে, সেই হামলার ঘটনায় আমি বাদি হয়ে আদালতে একটি মামলা করেছিলাম। সেই মামলার বিষয় উল্লেখ করে আমাকে পেটায়, আর বলে, ‘আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মামলা করবি?’
বাংলা আউটলুক: আপনার ধর্ম নিয়ে বাজে কথা বলার প্রতিবাদ করেছিলেন?
সৌরভ: না। প্রতিবাদ করার মতো কোনো সুযোগ ছিল না। মুখ খোলার সুযোগ কই? তারা আমার মা-বাবাকে নিয়েও গালি দিচ্ছিল। এগুলো মুখে উচ্চারণ করার মতো নয়। আমার প্রতিবাদের কোনো ভাষা ছিল না। এমনভাবে পিটিয়েছে, আমি অবশ হয়ে গিয়েছিলাম। এরই মধ্যে ওদের একজনের ফোন বেজে ওঠে। এপাশ থেকে বলছিল, ‘স্যার, ওকে পেয়েছি, কুত্তার মতো, কুকুরের বাচ্চার মতো পেটাচ্ছি, কোনো সমস্যা হবে না, দেখতেছি স্যার।’ দীর্ঘক্ষণ পেটানোর পর ওরা আমাকে ওই প্রিজন ভ্যানে রেখেই নেমে যায়।
বাংলা আউটলুক: তারপর কি হয়?
সৌরভ : তার পরপরই সাদা পোশাকের তিন-চার জন উঠে আসে। আমি গাড়ির ডেকের ওপর বসে ছিলাম। উঠে দাঁড়াবার শক্তি ছিল না। এসেই আমাকে এলাপাতাড়ি চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে। ওদের একজন আমার গোপনাঙ্গে লাথি মারে, চেপে ধরে। আমি কান্না করতে পারছিলাম না। কিন্তু আমার চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরছিল। এভাবে ঘণ্টা তিনেক আমার ওপর ওই প্রিজন ভ্যানের মধ্যেই নির্যাতন চালায়। আমি গাড়ির মেঝেতে পড়ে ছিলাম। ওরা আমাকে কোথায় নিয়ে গেছে তাও জানি না। কারণ দাঁড়িয়ে দেখার মতো শক্তি আমার ছিল না। আমার চোখ বাঁধেনি। শুধু হাতকড়া পরানো ছিল। দুপুরের পর আমাকে থানায় নিয়ে যায়।
বাংলা আউটলুক: থানায় নিয়ে কি করল?
সৌরভ: কোতোয়ালি থানায় নিয়ে আমার নাম এন্ট্রি করে। আমি হাঁটতে পারছিলাম না। দুই পুলিশ সদস্য ঘাড়ে ভর করে আমাকে নিয়ে যায়। লকাপে ঢুকায়। এর আগেই আমার সাথে যাদের ধরেছিল, তাদের আগেই লকাপে রেখেছিল। আরো অনেকেই আগে থেকে ছিল। কিছুক্ষণ পরপরই আমাকে ওরা বের করছিল। আমি হাঁটতে পারছিলাম না। আমাকে বলছিল, ‘অভিনয় করিস না।’ আমাকে টেনেহিঁচড়ে পাশের একটি কক্ষে নিয়ে গিয়েছিল কয়েকবার। আমার ছবি তুলেছিল। ওই অবস্থায়ও কয়েকবার আমাকে পিটিয়েছে থানার পুলিশ। আমি যখন আর দাঁড়াতে পারছিলাম না, একজন অফিসার এসে বললেন, ‘ওকে চিকিৎসা করাও। হাসপাতালে নিতে হবে।’ বিকেল ৪টার দিকে আমাকে চার-পাঁচজন পুলিশ সদস্য চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখনও আমার হাতে হাতকড়া পরানো ছিল। আমাকে ওরা ধরাধরি করে হাঁটছিল।
বাংলা আউটলুক: চিকিৎসক কি বলেছে?
সৌরভ: ডাক্তার বলছিল, কি হয়েছে? আমি বলছিলাম, আমাকে মারা হয়েছে। সামনে বসে থাকা পুলিশ সদস্যরা বলল, না স্যার। ধস্তাধস্তিতে কিছুটা আহত হয়েছে। কিন্তু ডাক্তার দেখলেন, আমার শরীরের বিভিন্ন স্থান থেঁতলে গেছে। আমার গোপনাঙ্গসহ বিভিন্ন স্থান ফুলে গেছে। ডাক্তার ইঞ্জেকশন দিলেন, বেশ কিছু ওষুধ দিলেন। আবারো আমাকে থানায় নিয়ে আসা হলো।
বাংলা আউটলুক: থানায় এনে কি আবারো নির্যাতন করা হয়েছিল?
সৌরভ: না। সন্ধ্যার দিকে আমাকে আদালতে তোলা হয়। আদালত আমাকে কারাগারে পাঠায়। পরের দিন আবারো আমাকে আদালতে তোলা হয়। পুলিশ পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে। আমার আইনজীবী আমার শরীরের আঘাতের চিহ্নগুলো আদালতকে দেখায়। তরতাজা আঘাতের চিহ্ন দেখে আদালতও বিস্মত হন এবং রিমান্ড নামঞ্জুর করেন। জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দেন। আদালত আমাকে চিকিৎসা দেয়ার জন্য লিখিতভাবে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন।
বাংলা আউটলুক: কারাগারে কি চিকিৎসা দিয়েছিল?
সৌরভ: প্রথম তিন দিন আমাকে কারাগারের হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। চতুর্থ দিন হঠাৎ জেল সুপার কারা হাসপাতালে আমার কাছে আসেন। আমার নাম জিজ্ঞেস করে কেস কার্ড দেখতে চান। আমি কেস কার্ড দিলে তিনি বলেন, ‘আপনাকে তো হাসপাতালে রাখা যাবে না। আপনি তো জ্বালাও-পোড়াও মামলার আসামি।’ আমি প্রচণ্ড অসুস্থ ছিলাম। আমার মুখ থেকে কোনো কথা বেরুচ্ছিল না। জেল সুপার আমার কেস কার্ড নিয়ে গেলেন, বললেন, ‘আগামী কাল সকালে কারা চিকিৎসক আপনার সাথে কথা বলবেন।’
বাংলা আউটলুক: পরের দিন কি হলো?
সৌরভ: পরের দিন সকালে কারা চিকিৎসক আমাকে ডেকে পাঠান। যে ডাক্তার আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করেছিলেন তিনি বললেন, ‘সরি, আপনাকে আমরা এখানে রাখতে পারছি না।’ ডা. রেজা নামের একজন আমার সামনে দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে বললেন, ‘সিটি এসবি এবং বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার চাপে আমরা আপনাকে হাসপাতালে রাখতে পারছি না। তখন আমি কাঁদছিলাম। ওদের সামনেই। আগে থেকেই আমার মেরুদণ্ডে সমস্যা থাকায় আমি মেঝেতে ঘুমাতে পারছিলাম না। এছাড়া বালিশ না থাকায় সমস্যা আরো প্রকট ছিল। পুলিশি নির্যাতনের ক্ষত চিকিৎসা না করিয়ে এবং মেরুদণ্ডের ফ্রাকচার নিয়ে এভাবেই ৫৯ দিন কাটিয়েছি। ফলে আমার মেরুদণ্ডের সমস্যা আরো রেড়ে গেছে। চিকিৎসা আমার মৌলিক অধিকার, সেটা থেকেও আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমার বহু সহকর্মীর সাথে এর চেয়ে বেশি নির্যাতন হতে দেখেছি।
বাংলা আউটলুক: পরিবার এসব বিষয় কিভাবে দেখছে?
সৌরভ: আমি যখন আটক হই, আমার বাবা-মা দেশে ছিলেন না। আমার পরিবারের অন্য সদস্যরা বা আত্মীয়স্বজন কেউই জানতেন না আমি কোথায় আছি। এই রাজনৈতিক কারণে আমার ভাই সরকারি চাকরির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরও যোগদান করতে পারেনি। আমার স্কুলশিক্ষিকা বোনকে এমপিওভুক্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমার বাবা সরকারি চাকরি করে আমাদের ছয় ভাইবোনকে মানুষ করেছেন, কিন্তু বাবা-মায়ের জন্য কিছুই করতে পারিনি আমি। মাঝেমধ্যে মনে হয়, ‘আমি বাবা-মায়ের অথর্ব সন্তান।’ কিন্তু আমার পরিবার মোটেই বিরক্ত নয়। বরং পরিবার থেকেই রাজনীতি করার জন্য উৎসাহ-অনুপ্রেরণা পচ্ছি। আমার পরিবারকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকেরা বলে, ‘হিন্দু রাজাকার পরিবার।‘
বাংলা আউটলুক: এত কিছুর পরও কি রাজনীতির সাথে থাকার আগ্রহ আছে?
সৌরভ: জাতীয়তাবাদী আদর্শ বা রাজনীতি আসলে একটি চেতনা। বিএনপি আসলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের দল। মুক্তিযোদ্ধার দল। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন, যুদ্ধ করেছেন। এটি একটি কারণ এই আদর্শের রাজনীতির সাথে থাকার। অপর একটি কারণ হচ্ছে, আমরা যারা বাংলাদেশে বসবাস করি, জাতি, ধর্ম, বর্ণ সবাই কিন্তু বাংলাদেশি। আর বিএনপি এই আদর্শকেই লালন করে। বিএনপি কোনো গোষ্ঠী বা ধর্মের জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে না। আমাদের আদর্শ, বিশ্বাস একটাই, সেটি হচ্ছে, ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’। সেখানে কোনো হিন্দু থাকবে না, বৌদ্ধ থাকবে না, খ্রিস্টান থাকবে না, কোনো মুসলিম থাকবে না, একটাই পরিচয়, আমরা সবাই বাংলাদেশি। এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়েই বিএনপি করি। এছাড়া স্বাধীনতার পর থেকেই বর্তমান এই ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ, আমাদের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিক্রি করে রাজনীতি করছে। আমাদের পূর্ববর্তীদের মুখে শুনেছি, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি হিন্দু নির্যাতন হয়েছে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালে। এরপর ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ নিয়ে যখন সমস্যা হয়েছিল, তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। বিএনপিকে বেকায়দায় ফেলতে ওই সময় বিভিন্ন স্থানে মন্দির ভাঙ্গার নেতৃত্ব যারা দিয়েছে, তারা সবাই আওয়ামী লীগেরই নেতা। ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত যতগুলো সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, সব ঘটনার সাথেই আওয়ামী লীগের লোকজনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। আমি আমার ধর্মের ভাই বোন সবাইকে অনুরোধ করব এসব বিষয় ভোবে দেখার জন্য। আমি বলতে চাই, আমরা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা আর কারো পণ্য হতে চাই না। কারো করুণা নিয়ে বাঁচতে চাই না। সম্প্রতি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে একটি মন্দির ভাঙ্গার মামলায় কামাক্ষা চন্দ্র দাস নামে একজন সনাতন ধর্মাবলম্বীকে আসামি করা হয়েছে শুধু বিএনপি নেতা বলে। সুতরাং সব ধর্মের মানুষের মুক্তির জন্য একটিই প্লাটফর্ম—বিএনপি।
বাংলা আউটলুক: আপনাকে ধন্যবাদ।
সৌরভ: বাংলা আউটলুককেও ধন্যবাদ।