Logo
Logo
×

সংবাদ

সুন্দরবনের আগুন: তদন্ত কমিটির ১৮ সুপারিশ

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৯:৪২ এএম

সুন্দরবনের আগুন: তদন্ত কমিটির  ১৮ সুপারিশ

সম্প্রতি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনে লাগা আগুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটির দাখিল করা প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ উল্লেখ না করলেও ১৮ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। তবে আগুন লাগার সম্ভাব্য সাতটি কারণ উল্লেখ করেছে কমিটি। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় দুটি পৃথক কমিটি গঠন করা হয়েছে। 

পৃথক প্রতিবেদনে সুন্দরবনের শাপলার বিল ও টেপার বিলে আগুনে মোট ৬ দশমিক ৬৩ একর বনভূমি পুড়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ওই দুইস্থানে আগুনে সুন্দরবনের গাছপালা পুড়ে এবং জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের আনুমানিক ১০ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭০ টাকা ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের পক্ষ থেকে রবিবার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়। তবে বন অধিদপ্তরের গঠিত উচ্চ পর্যায়ের পাঁচ সদস্যের কমিটি এখনও তদন্ত করছে।

তদন্ত কমিটির প্রধান সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) দ্বীপন চন্দ্র দাস জানান, সুন্দরবনের শাপলার বিল এবং টেপার বিলে আগুনের ঘটনায় ৩ সদস্য বিশিষ্ট পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তাকে ওই দুটি কমিটির প্রধান করা হয়েছে। পৃথক দুটি স্থানে আগুনের ঘটনায় তদন্ত করে সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তার দপ্তরে ৭ এপ্রিল প্রতিবেদন দাখিল করেছেন সেই কমিটির সদস্যরা।

আগুনে সুন্দরবনের শালপার বিলে ৪ দশমিক ৪৩ একর এবং টেপার বিলে ২ দশমিক ২০ একর বনভূমি পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। দুই স্থানে আগুনে সুন্দরবনের মোট গাছপালা পুড়ে এবং জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের আনুমানিক ১০ লাখ ৫৫ হাজার ৩৭০ টাকা ক্ষয়ক্ষতির কথাও উল্লেখ করা হয়।

দ্বীপন চন্দ্র দাস আরও জানান, তদন্ত প্রতিবেদনে তারা সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডের সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করতে না পারলেও সম্ভাব্য সাতটি কারণ চিহ্নিত করতে পেরেছেন তারা। সুন্দরবনে প্রায় প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ড ঠেকাতে তাদের পক্ষ থেকে ১৮টি সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের সুপারিশ বাস্তবায়ন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে সুন্দরবনে আগুন ঠেকানো সম্ভব হবে বলেও অভিমত দিয়েছে তদন্ত কমিটি।

সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম জানান, সুন্দরবনের শাপলার বিল এবং টেপার বিলে আগুনের ঘটনায় তিন সদস্য বিশিষ্ট দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির সদস্যরা তদন্ত শেষে পৃথক প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ওই প্রতিবেদন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পাঠানো হয়েছে।

নুরুল করিম আরও জানান, তদন্ত কমিটি সুন্দরবনে আগুন লাগার কারণ সুনিদিষ্ট করে বলতে পারেনি। আগুন লাগার সম্ভাব্য সাতটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। সুন্দরবনে ভবিষ্যতে আগুন লাগা প্রতিরোধে প্রতিবেদনে স্বল্প মেয়াদি, মধ্যম মেয়াদি এবং দীর্ঘ মেয়াদি করণীয় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।

পৃথক তদন্ত প্রতিবেদনে সুন্দরবনে আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ

তদন্ত প্রতিবেদনে শাপলার বিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪ দশমিক ৪৩ একর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ওই এলাকায় আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসেবে যা উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে, ৩ হাজার ৯০০ টাকা মূল্যের ১০ কুইন্টাল সুন্দরী গাছ, তিন লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্যের ২ হাজার কুইন্টাল বলা গাছ, ১ হাজার ৫০ টাকা মূল্যের পাঁচ কুইন্টাল গেওয়া গাছ এবং জীববৈচিত্র ও পরিবেশের আনুমানিক ক্ষতি ধরা হয়েছে ৩ লাখ টাকা।

এছাড়া তদন্ত প্রতিবেদনে টেপার বিলে আগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২ দশমিক ২০ একর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। ওই এলাকায় আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়, ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা মূল্যের ১ হাজার কুইন্টাল বলা গাছ, ৪২০ টাকা মূল্যের দুই কুইন্টাল গেওয়া গাছ এবং জীববৈচিত্র ও পরিবেশের আনুমানিক ক্ষতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ১০ হাজার টাকা।

সুন্দরবনে আগুন লাগার সম্ভাব্য কারণ

তদন্ত কমিটি সুন্দরবনে আগুন লাগার সম্ভাব্য যে সাতটি কারণ উল্লেখ করেছে তার মধ্যে রয়েছে—

১. অবৈধভাবে মৌয়াল বা জেলে, বাওয়ালী সুন্দরবনে প্রবেশ করে মধু সংগ্রহের জন্য ধোঁয়া তৈরির লোফা বা বিড়ি-সিগারেটের মোথার গোড়া থেকে অগ্নিকাণ্ড হতে পারে।

২. অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হিসেবে ঘটনাস্থলে একটি মৌচাকের মধু সংগ্রহের কাজে ব্যবহৃত লোফার কিছু অংশ এবং সংগ্রহকৃত অবশিষ্ট অংশ দেখা গেছে। ওই খান থেকে অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হওয়ার সম্ভবনা বেশি হতে পারে। 

৩. অবৈধভাবে সংরক্ষিত সুন্দরবনে গবাদি পশুচারণকারীদের ব্যবহৃত বিড়ি-সিগারেটের মোথার গোড়া থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে। 

৪. কলমতেজী টহল ফাঁড়ির টেপার বিল এলাকায় বর্ষাকালে প্রচুর জিওল মাছ (শিং, মাগুর, কই) পাওয়া যায়। জিওল মাছ আহরণের পূর্ব প্রস্ততি হিসেবে বিলের জায়গা পরিস্কার ও ছাই দিয়ে ভর্তি করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে দুস্কৃতিকারীরা আগুন লাগাতে পারে।

৫. বন বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার জন্য দুস্কৃতিকারীরা ইচ্ছাকৃতভাবে সংরক্ষতি সুন্দরবনে আগুন লাগাতে পারে। 

৬. চাঁদপাই রেঞ্জের বৈদ্যমারী টহল ফাঁড়ি থেকে শরণখোলা রেঞ্জের দাসেরভারানী টহল ফাঁড়ি এলাকার সীমানাপ্রাচীর সংলগ্ন খড়মা ও ভোলা নদী দুটি প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। ওই নদী দুটি ভরাট হওয়ার কারণে নদীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী ছোট-বড় খাল দিয়ে বনের মধ্যে জোয়ারের পানি প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে উক্ত বনাঞ্চলের ভূমি জোয়ার-ভাটার সময় নিমজ্জিত হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে নদী ও সংযোগ স্থাপনকারী ছোট-বড় খালগুলো সচল না থাকায় অগ্নিকাণ্ড হতে পারে। 

৭. ভোলা নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় মানুষ ও গবাবি পশু অতিসহজে সুন্দরবনে প্রবেশের সুযোগ পাচ্ছে। নদীর নাব্যতা হ্রাস না পেলে এবং ছোট-বড় সংযোগ খালগুলো সচল থাকলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিবদ্ধকতা হিসেবে কাজ করত। ভোলা নদী হতে সুন্দরবনের মাটিতে জোয়ারের পানি প্রবেশ বন্ধ রয়েছে। এতে শুকনো পাতা বনভূমিতে পড়ে থেকে উঁচু পাতার লেয়ার বা হিউমাস সৃষ্টি করেছে। চৈত্র মাসের তীব্র তাপপ্রবাহ এবং বৃষ্টিপাত না হওয়ায় শুকতো ডাল ও পাতায় ঘর্ষণের ফলে উৎপন্ন স্থির তড়িত আগুনের স্ফুলিংগ তৈরি করে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ড ঠেকাতে সুপারিশ

তদন্ত কমিটি যে ১৮টি সুপারিশ করেছে এরমধ্যে রযেছে, মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে সুন্দরবনের ২৪, ২৫ এবং ২৭ নম্বর কম্পারমেন্টে মধু আহরণ সম্পূর্ণ বন্ধ করা। অবৈধভাবে প্রবেশ করলে মৌয়ালদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া। ভোলা নদী এবং নদীর সঙ্গে সংযোগকারী সকল নদী-খাল পুনঃখনন করে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করা। ভোলা নদীর পাড়ে অবস্থিত উঁচু বাঁধ কেটে নদীর পানি সুন্দরবনে প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি করা। ভোলা নদী সংলগ্ন সংযোগ খালগুলো—বিশেষ করে কলমতেজি, কাটা ভারানী, ছোটভারানী খালসহ অনান্য ছোট খাল পুনঃখনন করে সুন্দরবনে পানি প্রবেশ নিশ্চিত করা। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধক করতে বনের সীমানা এলাকায় ব্যাপক সচেতনতামূলক সভার আয়োজন করা। লোকালয় সংলগ্ন সংরক্ষিত সুন্দরবনের ২৪, ২৫ এবং ২৭ নম্বর কম্পারমেন্টে মার্চ মাসের পূর্বে বলা ও নলখাগড়া সম্পূর্ণ রুপে অপসারণের জন্য পাস দেওয়া যেতে পারে। অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বনজীবী, দুস্কৃতিকারী এবং সকল প্রকার গবাদি পশু সুন্দরবনে প্রবেশ বন্ধ করা। সুন্দরবনের স্টেশন এবং ক্যাম্পে শ্যালো মেশিন এবং পর্যাপ্ত পাইপের মাধ্যমে ছোট ছোট অগ্নিনির্বাপন ইউনিট তৈরি করা। আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত সরঞ্জাম এবং বনের মধ্যে জলাধার তৈরি করে পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা। ওয়াচ টাওয়ার তৈরি করে নজরদারিসহ দ্রুত অগ্নিকাণ্ড শনাক্ত করার মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ করা যেতে পারে। এছাড়া যেসব স্থানে স্বাভাবিকভাবে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে না— সেসব স্থানে প্রস্তের ফায়ার লাইন তৈরি করতে হবে। অগ্নিনির্বাপণ বিষয়ে বনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং নিয়মিত ড্রোনের মাধ্যমে তদারকির ব্যবস্থা করা। দু’টি অগ্নি নির্বাপন ইউনিট স্থাপন করতে হবে। অগ্নিকাণ্ডপ্রবণ টহল ফাঁড়িগুলোতে শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত জনবল নিয়োগ করতে হবে। 

এছাড়া নদী ও খাল দ্রুত পুনঃখননের ব্যবস্থা নিতে হবে। মধুর পাশ দেওয়ার আগে ধোঁয়া দেওয়ার যন্ত্র (ধোঁয়াদানী বা স্নোকার) অথবা ধোঁয়া দেওয়ার মেশিনের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত বন বিভাগের সহায়ক প্রতিষ্ঠান সিপিজি ও ভিটিআরটি সদস্যদের মাসিক ভাতা দেওয়াসহ তাদের লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদানের বিবেচনা করা প্রয়োজন। সুন্দরবনে আগুন নেভানোর কাজে সহায়তাকারী বন বিভাগের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সদস্যদের আর্থিক সহায়তা দেওয়া এবং আনুষাঙ্গিক ব্যয় বহন করতে হবে।

প্রসঙ্গত, ২৩ মার্চ বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার সুন্দরবনের শাপলার বিল এলাকায় গহীন বনে আগুন দেখতে পায় বন বিভাগের কর্মকর্তারা। এরপর শুরু হয় আগুন নেভানোর কাজ। ৪ দিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে সুন্দরবনের আগুন সম্পূর্ণভাবে নেভানো হয়। 

এর আগে ২২ মার্চ সকাল ৭টার দিকে বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার সুন্দরবন পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের কলমতেজি ক্যাম্পের টেপার বিলে আগুন দেখতে পায় বন বিভাগ। একদিন পর ২৩ মার্চ দুপুরে টেপার বিলের আগুন সম্পূর্ণভাবে নেভানো হয়। 

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: banglaoutlook@gmail.com

অনুসরণ করুন