Logo
Logo
×

সংবাদ

আয়নাঘর পরিদর্শন : ভুক্তভোগীদের ভয়ঙ্কর বর্ণনা শুনলেন প্রধান উপদেষ্টা

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:৩০ এএম

আয়নাঘর পরিদর্শন : ভুক্তভোগীদের ভয়ঙ্কর বর্ণনা শুনলেন প্রধান উপদেষ্টা

ছবি: সংগৃহীত

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গোপন বন্দিশালা ও টর্চার সেল (নির্যাতনকেন্দ্র) পরিদর্শন করেছেন। এই সেলটি ‘আয়নাঘর’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। মূলত রাজধানীর কচুক্ষেতে প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) যৌথ জিজ্ঞাসাবাদ সেলই  ‘আয়নাঘর’ হিসেব পরিচিত। এ ছাড়া র‌্যাব-২ এর সিপিসি-৩ এর ভেতরের সেলগুলোও পরিদর্শন করেন তিনি।

বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) প্রধান উপদেষ্টা আয়নাঘর পরিদর্শনে যান। এ সময় তার সঙ্গে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়াও দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী, আইসিটির চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম, গুম কমিশনের সদস্য ও গুমের শিকার ৮ জন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে পরিদর্শনে ছিলেন।

এদিকে, আয়নাঘর পরিদর্শনের সময় ভুক্তভোগী ও স্বজনরা তাদের দুর্বিষহ নানা অভিজ্ঞতার কথা প্রধান উপদেষ্টা, সাংবাদিক ও অন্যান্যদের সামনে তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টার আয়নাঘর পরিদর্শনের সময় তোলা ছবি ও ভিডিও থেকে যা জানা গেল তা বাংলা আউটলুক পাঠকদের জন্য সংক্ষেপে তুলে ধার হলো: 

 আবদুল্লাহ আজমী প্রধান উপদেষ্টার কাছে আয়নাঘরে নির্যাতনের কথা বলেন। 

অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুল্লাহ আজমী উপদেষ্টার কাছে তাকে নির্মম নির্যাতনের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, পুরো শরীরে রাস হয়ে যেত। হাঁটতে পারতাম না। চলতে পারতাম না। কিছু খেতেও পারতাম না। এদিকে বুধবার বিকালে এক ফেসবুক পোস্টে আবদুল্লাহ আজমী আয়নাঘর পরিদর্শনে তাকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা বহুল প্রতিক্ষিত আয়নাঘর পরিদর্শন করেন। আমাকে উনার সফরসঙ্গী হিসাবে নেওয়ায় আমি উনার প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। বলতে দ্বিধা নেই যে, বাংলাদেশে তো বটেই, সম্ভবত: গোটা পৃথিবীতে এ ধরনের ঘটনা নজিরবিহীন যে একজন সরকার প্রধান তার পূর্ববর্তী ফ্যাসিবাদ জালেম সরকারের জুলুমে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত মযলুমকে সঙ্গে নিয়ে নির্যাতনস্থল পরিদর্শনে গিয়েছেন। পৃথিবীর সব শাসকদের জন্য এটা একটা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।’

নির্যাতনের কথা প্রধান উপদেষ্টার কাছে বর্ণনা করেন ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম আরমান।

রাজধানীর উত্তরার র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-১ কম্পিউন্ডের ছোট্ট আয়নাঘরের ভেতরে নির্যাতনের কথা প্রধান উপদেষ্টার কাছে বর্ণনা করেন ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম আরমান। এখানে শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনী তাকে আট বছর গোপনে আটকে রেখেছিল। 

আয়নাঘরে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে ব্যারিস্টার আরমান বলেন, অনেক সময় ২৪ ঘণ্টা চোখ বেঁধে, হাত বেঁধে বসিয়ে রাখত। উঠতে দিত না, দাঁড়াতে দিত না। কেন, প্রশ্ন করলে বলত, স্যার আসবেন। চোখ বাঁধা অবস্থায় দেয়ালের দিকে ফিরে বসে থাকতাম।

তিনি বলেন, এখানে আমাকে আট বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল। দিনের বেলায় চোখ বেঁধে ও হাতকড়া পরিয়ে রাখত। রাতের বেলায় পিছমোড়া করে বেঁধে হাতকড়া পরিয়ে রাখত। কেন, জানতে চাইলে তারা কিছু বলত না। নামাজের সময় পর্যন্ত দিত না। আট বছর ধরে তারা আমাকে নারকীয় অভিজ্ঞতা দিয়েছে।

পরিদর্শনে থাকা প্রধান উপদেষ্টাকে অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি বলেন, আমি রোগা ছিলাম। মাঝেমধ্যে টাফ হয়ে যেত। এ রকম হতো যে ২৪ ঘণ্টা চোখ বেঁধে, হাত বেঁধে বসিয়ে রাখত। উঠতে দিত না, দাঁড়াতে দিত না। কেন, প্রশ্ন করলে বলত, স্যার আসবেন।

চোখ বাঁধা অবস্থায় দেয়ালের দিকে ফিরে বসে থাকতাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, বুঝতে পারতাম পেছন থেকে কেউ আসছে, মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজ হচ্ছে। দামি পারফিউমের ঘ্রাণ পেতাম...এখানে তো প্রস্রাব-পায়খানার গন্ধ নাকে আসত। বুঝতাম সিনিয়র কেউ পেছন থেকে দেখছে।

এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানতে চান, ‘ছাড়ল কখন?’

আরমান বলেন, আমি পরে যেটা বুঝতে পারলাম ৬ তারিখ (আগস্ট) ভোরে। ৫ তারিখ পালাল, ৬ তারিখ ভোরে আমাদের ছেড়ে দিল। যখন আমাকে বের করে, আমি মনে করেছিলাম আমাকে মেরে ফেলবে।

ঢাকার নর্থ-সাউথ ইউনিভার্সিটির (এনএসইউ) তৎকালীন শিক্ষক এবং বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়া ভিত্তিক ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও গবেষব মোবাশ্বার হাসানকে ২০১৭ সালে এই ছোট্ট (উপরের ছবি) বন্দিশালায় ৪৪ দিন রেখে নির্যাতন করা হয়।

যে  রুমে বন্দি ছিলেন নাহিদ।

আয়নাঘর পরিদর্শনের সময় তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম একটি কক্ষ শনাক্ত করেন, যেখানে জুলাই আন্দোলনের সময় তাকে আটকে রাখা হয়েছিল।

এসময় নাহিদ ইসলাম বলেন, আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে এসে ইন্টারোগেশন করা হয়েছে অনেক। যখন চোখ খোলা হয়েছিল, তখন এরকম একটা রুম দেখেছি। যতক্ষণ রুমে থাকতাম, ততক্ষণ চোখ খোলা থাকত, হাতকড়া খুলে দিত। রুম থেকে বের করার সময় চোখ বাঁধত, হাতকড়া বাঁধত।

তিনি আর বলেন, এখানে ছিল একটা কাঠের দরজা, তার সামনে একটা লোহার দরজা ছিল। দরজার নিচ দিয়ে খাবার দিত। রুমে গোল গোল হলুদ লাইট ছিল। প্রচুর সাউন্ড হতো বাইরে।

নাহিদ বলেন, একটা পাত্র ছিল, প্রস্রাব করতে হলে এখানেই করতে হতো। অন্যক্ষেত্রে  ওয়াশরুমে নিয়ে যেত।

তিনি জানান, ওই রুমের একপাশে টয়লেট হিসেবে একটি বেসিনজাতীয় কিছু ছিল। ৫ আগস্টের পর এই সেলগুলোর মাঝের দেয়াল ভেঙে ফেলা হয়, দেয়াল রং করা হয়।

আসিফ (বায়ে) ও তাকে যে কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল।

 আয়নাঘর পরিদর্শনের পর আসিফ জানান, তাকে যে কক্ষে আটকে রাখা হয়েছিল সেই কক্ষের দেয়ালের উপরের অংশের খোপগুলোতে এক্সস্ট ফ্যান ছিল, এখন নেই।

আসিফ আরও জানান, তিনি দেয়াল দেখে কক্ষটিকে চিনতে পেরেছেন। কক্ষটি আগে অনেক ছোট ছিল, এখন মাঝের দেয়াল ভেঙে বড় করা হয়েছে। ওই কক্ষে তাকে চারদিন আটকে রাখা হয়েছিল। এসময় বাইরের কারও সঙ্গে তাকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। টয়লেট ছিল কক্ষের বাইরে এবং তাকে চোখ বেঁধে টয়লেটে নিয়ে যাওয়া হতো।

পোশাক ব্যবসায়ী রাহাত আয়নাঘরে বন্দি জীবনের গল্প শোনান প্রধান উপদেষ্টাকে।

না যায়, পোশাক ব্যবসায়ী রাহাতকে র‍্যাব অপহরণ করেছিল। তারা তার কাছে এক কোটি টাকা দাবি করে। তিনি ষাট লাখ টাকা দিতে চেয়েছিলেন। তারা তাকে মুক্তি দেয়নি। বরং তাকে একজন ইসলামী জঙ্গি হিসেবে ফাঁসানো হয়েছিল এবং গুমের শিকার হতে হয়েছিল। 

গুমের শিকার ব্যক্তিদের বিষয়ে তদন্ত কমিশনের সদস্য নাবিলা ইদ্রিসের সঙ্গে উপদেষ্টা নাহিদ।

জানা যায় ২০১৬ সালে গুম হয়েছিলেন মাসুদ ইব্রাহীম। তাকে আর কোনদিনও ফিরে পাওয়া যায়নি। গোপন বন্দিশালার দেয়ালে তিনি নিজের নাম এবং ‘I Love My Family...’ লিখেছিল। 

প্রায় এক দশক আগে শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনী তার মা এবং তাকে অপহরণ করেছিল। তখন সে মাত্র ১১ বছর বয়সী শিশু ছিল। তাদের র‍্যাব অফিসের একটি গোপন নির্যাতন কক্ষে রাখা হয়েছিল। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। তবে তার মাকে আর কোনদিন খুঁজে পায়নি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করার অভিযোগে হাসিনার নিরাপত্তা বাহিনী তাকে অপহরণ করেছিল। তখন তিনি একজন তরুণ ব্যবসায়ী এবং তিন সন্তানের বাবা। তাকে ঢাকার র‍্যাব সদর দপ্তরের আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল। তার ভাগ্য ভালো তিনি জীবিত ফিরে এসেছিলেন। কিন্তু অনেকেই পারেননি। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আয়নাঘরের সেই বর্ণনা দেন তিনি।

গোপন বন্দিশালা ও টর্চার সেলের ভেতরের দৃশ্য।

এদিকে,  ঢাকার তিনটি এলাকায় র‍্যাব ও ডিজিএফআইয়ের গোপন বন্দীশালা ও টর্চার সেল পরিদর্শন শেষে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। 

তিনি বলেছেন, 'যা দেখেছি তা বর্ণনা করার মতো না, এটা অবর্ণণীয়। বর্ণনা যদি করতে হয় তাহলে বলতে হয় এটা বিভৎস দৃশ্য। মানুষের মনুষ্যত্ববোধ বলে যে কোনো কিছু আছে এই দৃশ্য মনুষ্যত্ববোধ থেকে বহু দূরে। যা হয়েছে এখানে, গুমের শিকার যে কয়জন আমাকে বর্ণনা দিয়েছেন সেগুলো অবিশ্বাস্য, নৃশংস অত্যাচার। যতটাই শুনি অবিশ্বাস্য লাগে। বিনাদোষে তাদেরকে তুলে এনে টর্চার করা হয়েছে। এটাই কি আমাদের সমাজ, এই সমাজই কি আমরা গড়লাম?' 

তিনি বলেছেন, গত সরকার সর্বক্ষেত্রে আইয়ামে জাহেলিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছে, এই আয়নাঘর হলো তার একটা নমুনা।

'যে খুপড়ির মধ্যে তাদেরকে রাখা হয়েছে গ্রামে  মুরগির খাঁচাও এর থেকে বড় হয়। তাদেরকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর এভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। মানুষ হিসেবে সামান্যতম মানবিক অধিকার থেকেও তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে', প্রধান উপদেষ্টা বলেন। 

গোপন বন্দিশালা ও টর্চার সেলের ভেতরের দৃশ্য।

তিনি বলেছেন, এটা আমাদের সবার অপরাধ যে এটা আমরা হতে দিয়েছি। যারা করেছে তারা আমাদেরই সন্তান, ভাই, আত্মীয়। এই সমাজকে নিপীড়নের এই চূড়ান্ত রূপ থেকে বের করে না আনতে পারলে এ সমাজ টিকে থাকবে না। 

গোপন বন্দিশালা ও টর্চার সেলের ভেতরের দৃশ্য।

প্রধান উপদেষ্টা কমিশনকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তারা কোদাল হাতে দেয়াল ভেঙে এসব টর্চার সেল আবিষ্কার করেছে। 

গুমের সঙ্গে জড়িতদের অবশ্যই বিচার করতে হবে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন,  'যারা এর সঙ্গে জড়িত অবশ্যই তাদের বিচার করতে হবে তা না হলে আমরা নিষ্কৃতি পাব না।'

গোপন বন্দিশালা ও টর্চার সেলের ভেতরের দৃশ্য।

অন্যদিকে, সারা দেশে ৮ শতাধিক আয়নাঘর ছিল বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম। বুধবার রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান। 

তিনি বলেন, প্রতিটি আয়নাঘর খুঁজে বের করা হবে। আয়নাঘরের আলামত নষ্ট করা হয়েছে কি না, গুম কমিশন ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তা তদন্ত করে দেখছে।

ছবি সূত্র: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: banglaoutlook@gmail.com

অনুসরণ করুন