বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে ২৫ প্রস্তাব শিক্ষার্থীদের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৩ পিএম
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কারে ২৫টি প্রস্তাবনা পেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। সম্প্রতি গণ-অভ্যুত্থানের ১০০ দিন উপলক্ষে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশ (পুশাব) আয়োজিত ‘জুলাই বিপ্লব: আশাবাদ এবং প্রত্যাশা’ শীর্ষক সংলাপ থেকে 'বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় "মুক্তি সনদ" ২৫ দফা সংস্কার প্রস্তাবনা ২০২৪' প্রস্তাবনা পেশ করেন শিক্ষার্থীরা।
সংলাপে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেন, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এনডিএম চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, এবি পার্টি) যুগ্ম সদস্য সচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, নেত্র নিউজের চিফ এডিটর তাসনিম খলিল, এলডিপির প্রেসিডিয়াম সদস্য ওমর ফারুক, মানবাধিকার কর্মী ও ফটো সংবাদিক শহিদুল আলম, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারি, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির, ছাত্রশিবিরের অফিস সম্পাদক নুরুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় সাহিত্য সম্পাদক সিবগাতুল্লাহ সিবগা, সাবেক অ্যালামনাই কেএম নাজমুল, জাকারিয়া, রিয়াজ, তানজিল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কোনো কিছু পাওয়ার আশায় আন্দোলন করেনি। তারা সবসময়ই দেশের জন্য নেমে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও আসবে। তবে উপস্থিত রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দের কাছে ভবিষ্যতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের দেশ গঠনে আরও অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য আহ্বান জানাই, পাশাপাশি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে পুরো দেশ যে ঐক্যবদ্ধ আয়োজন হয়েছিল তা সামনে ধরে রাখার ব্যত্যয় জানিয়েছেন।
প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস অ্যালায়েন্স অব বাংলাদেশের ২৫ দফা প্রস্তাবনাগুলো হলো,
১. বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন: প্রয়োজনীয় সকল পক্ষের অংশগ্রহণে স্বাধীন “বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন” গঠনের মাধ্যমে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হতে ছাত্র, শিক্ষক নিপীড়ন ও বৈষম্য দূর করতে হবে। অনিয়ন্ত্রিত ও লাগামহীনভাবে ক্রেডিট ফি বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ও ছাত্রদের তুচ্ছ ঘটনায় বহিষ্কার বা বড় শাস্তি দেয়ার সংস্কৃতি বন্ধ করতে হবে।
২. সরকারি তহবিলের বরাদ্দ: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য সরকারি তহবিল হতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ নিশ্চিত করতে হবে।
৩. বাধ্যতামূলক আবাসন ও যাতায়াত ব্যবস্থা: সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক ভাবে ট্রান্সপোর্ট ও আবাসন ব্যবস্থা (হল/হোস্টেল) নিশ্চিত করতে হবে।
৪. আঘাতপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সহায়তা: আন্দোলনে গুরুতর আহত শিক্ষার্থীদের বিনামূল্যে পড়াশোনা শেষ করার ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৫. আর্থিক স্বচ্ছতা: বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আয় ও ব্যয় নিয়মিত ভাবে প্রকাশ করতে হবে।
৬. কর অব্যাহতি: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর আরোপিত ১৫% আয়কর তুলে নিতে হবে এবং আইনের মাধ্যমে শিক্ষা খাত কে করের আওতামুক্ত রাখতে হবে।
৭. রিটেক ও ইন্টার্নশিপ কোর্স ফি হ্রাস: রিটেক ইন্টার্নশিপ কোর্সের জন্য ৫০% কোর্স ফি নির্ধারণ করতে হবে।
৮. শিক্ষা অবকাঠামো উন্নয়ন: প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সকল কোর্স এর জন্য উপযুক্ত ল্যাব ফ্যাসিলিটি, লাইব্রেরি ও পর্যাপ্ত যোগ্য শিক্ষক বাধ্যতামূলক ভাবে থাকতে হবে।
৯. মেধাবীদের নিয়োগ: শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মেধাবীদের প্রাধান্য দিতে হবে।
১০. দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ: সকল ধরনের দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে, শিক্ষক কিংবা প্রশাসন সম্পূর্ণ দলীয় রাজনীতি মুক্ত থাকতে হবে।
১১. স্বচ্ছ নিয়োগ ব্যবস্থা: সকল নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছতার ভিত্তিতে পরিচালনা করতে হবে।
১২. গবেষণার পরিবেশ উন্নয়ন: গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে এবং গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
১৩. অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন: প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অফিসিয়াল অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন এর কার্যক্রমের অনুমতি দিতে হবে।
১৪. ছাত্র ও শিক্ষক সংসদ: পার্লামেন্টারি ছাত্র ও শিক্ষক সংসদ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দলীয় রাজনীতি মুক্ত গণতন্ত্র ও নেতৃত্বের চর্চার সুযোগ দিতে হবে।
১৫. ‘শহিদ কর্নার’ প্রতিষ্ঠা: গণ অভ্যুত্থানের ইতিহাস সংরক্ষণের উদ্যোগ হিসেবে প্রতিটা ক্যাম্পাসে ‘শহিদ কর্নার’ করতে হবে।
১৬. শিক্ষার মান নির্ধারণ: প্রত্যেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিশ্চিত করার জন্য একটি নির্দিষ্ট মান নির্ধারণী নিরীক্ষা কমিটি এবং সিজিপিএ (GPA) স্কেল নির্ধারণ করা আবশ্যক। এই মান ও স্কেল প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার গুণগত মান উন্নত করা সম্ভব হবে। গ্রেডিং সিস্টেমে ভারসাম্য আনতে হবে।
১৭. মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্য সেবা: জুলাই বিপ্লবের পর যারা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। এই সেবার লক্ষ্য হবে, তাদের মানসিক এবং আবেগগত সুস্থতা পুনরুদ্ধার করা। মনস্তাত্ত্বিক স্বাস্থ্য সেবার আওতায় কাউন্সেলিং, থেরাপি, এবং গ্রুপ সাপোর্ট সেশন অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যা তাদের অভিজ্ঞতাকে শেয়ার করতে এবং মানসিক চাপ ও উদ্বেগ মোকাবেলায় সাহায্য করবে। সরকার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে যৌথভাবে কাজ করে এই সেবাগুলি কার্যকর করতে হবে, যাতে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা সহজে এই সেবা গ্রহণ করতে পারেন এবং তাদের পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
১৮. আন্তঃ বিশ্ববিদ্যালয় নেটওয়ার্ক: বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সমন্বয় এবং সহযোগিতার জন্য একটি কার্যকর নেটওয়ার্ক গঠন করা আবশ্যক। এই নেটওয়ার্কের লক্ষ্য হবে, একে অপরের সঙ্গে তথ্য, শিক্ষা, এবং গবেষণার অভিজ্ঞতা শেয়ার করা, যাতে উচ্চশিক্ষার মান উন্নত করা যায়। বিশেষত, এই নেটওয়ার্কটি জুলাই বিপ্লবের আদর্শ ও মূল্যবোধকে ধারণ করবে। এটি ছাত্র-শিক্ষক-অধ্যাপকসহ সকল সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং সমর্থন নিশ্চিত করবে।
১৯. Govt-Industry Collaborative Institute: প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে Govt-Industry Collaborative Institute গড়ে তুলতে হবে যা সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এর চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করবে, জব প্লেসমেন্ট, মার্কেট ওরিয়েন্টেড স্কিল ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করবে, যা শিক্ষার্থীদের জব/ব্যবসা রিলেটেড শিক্ষা গ্রহণে সহযোগিতা করবে।
২০. পার্মানেন্ট ক্যাম্পাস: সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের বাধ্যতামূলক পার্মানেন্ট ক্যাম্পাস থাকতে হবে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ও পার্মানেন্ট ক্যাম্পাস ব্যতীত নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদন দেয়া যাবে না।
২১. নিয়মিত কনভোকেশন: সকল বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়মিত কনভোকেশন আয়োজন করতে হবে।
২২. Subject Accreditation: যে সকল কোর্স পরিচালনার জন্য নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এক্রিডিটেশন প্রয়োজন সে সকল কোর্স এর এক্রিডিটেশন বাধ্যতামূলক করতে হবে।
২৩. পাবলিক প্রাইভেট শিক্ষক নিয়োগ উন্মুক্ত করা: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মেধা ও গবেষণা থাকা সত্ত্বেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে আবেদন করতে পারেন না। শিক্ষক নিয়োগের এই বৈষম্য দূর করতে হবে। একমাত্র মেধা ও শিক্ষাগত যোগ্যতাই হবে শিক্ষক নিয়োগের মাপকাঠি।
২৪. দ্রুত সময়ের মধ্যে মূল সনদ হস্তান্তর: কনভোকেশন ব্যতীত মূল সনদ আটকে রাখার অনৈতিক নিয়ম বাতিল করতে হবে, শিক্ষার্থীর প্রয়োজন সাপেক্ষে দ্রুত সময়ের মধ্যে মূল সনদ প্রদান করতে হবে।
২৫. ঢাকার মধ্যে আর কোন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দেয়া যাবেনা, যে সকল জেলা পিছিয়ে আছে সেখানে সকল শর্ত পূরণ সাপেক্ষে নতুন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমতি দিতে হবে। মানহীন যে সকল বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট সময়ে শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয়েছে তাদের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হবে এবং ট্রাস্টি বোর্ড এ পরিবারতন্ত্রের অবসান করতে হবে।
এই প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ, স্বচ্ছ ও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে এই উদ্যোগ অত্যন্ত জরুরি। জাতীয় উন্নয়ন এবং মানবাধিকার নিশ্চিত করতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার প্রক্রিয়া অপরিহার্য। শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষা ও মানসম্মত শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি করা আমাদের দায়িত্ব, যা দেশের ভবিষ্যৎ গড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।