Logo
Logo
×

সংবাদ

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন: প্রতিশ্রুতি পূরণে অগ্রগতি কতটুকু?

ডেস্ক রিপোর্ট

ডেস্ক রিপোর্ট

প্রকাশ: ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৩৪ এএম

অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন: প্রতিশ্রুতি পূরণে অগ্রগতি কতটুকু?

বাংলাদেশে গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এখন থেকে ১০০ দিন আগে যাত্রা শুরু করেছিল অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্তী সরকার। গণঅভ্যুত্থানের ঠিক তিন দিনের মাথায় গঠিত সরকারের প্রতি তখন সাধারণ মানুষকে সমর্থন দিতে যেমন দেখা গিয়েছিল, তেমন প্রত্যাশাও ছিল বিপুল।

সরকারের পক্ষ থেকেও আইনশৃঙ্খলা, দ্রব্যমূল্য, অর্থনীতি, নির্বাচনসহ বিভিন্ন বিষয়ে দ্রুত পরিবর্তন আনাসহ নানান প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিন মাস পর এসে সরকারের সেসব প্রতিশ্রুতির মধ্যে অনেকগুলোতেই তেমন কোনো অগ্রগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, যা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা ও ক্ষোভ দেখা যাচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, বিশেষত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সরকার কার্যকর কোনো ভূমিকাই রাখতে পারেনি। ব্যর্থ বলার জন্য এই তিন মাস পর্যাপ্ত না হলেও একেবারে কমও নয়।

যদিও উপদেষ্টারা বলছেন, একের পর এক আন্দোলন-বিক্ষোভের মধ্যেও তারা লক্ষ্য অর্জনে সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যার ফল আগামী তিন মাসের মধ্যেই পুরোপুরি দৃশ্যমান হবে।

এছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখার চিন্তাও জানিয়েছে সরকার।

সংস্কারে অগ্রগতি কতটুকু?

দায়িত্ব গ্রহণের পর সরকারের পক্ষ থেকে যে বিষয়টির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে, সেটি হলো- রাষ্ট্র সংস্কার।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণেও প্রতিবার রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মহাম্মদ ইউনূসকে। গত ২৫ অগাস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, জনস্বার্থের বিপরীতমুখী এক কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের দেশ পুনর্গঠনের কাজে হাত দিতে হয়েছে। আমরা এখান থেকেই বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই যেন এ দেশে জনগণই সত্যিকার অর্থে সব ক্ষমতার উৎস হয়।

সেদিনে ভাষণে তিনি আরও বলেন, তরুণ প্রজন্ম, শিক্ষার্থী ও জনতার আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানাতে রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে সফল আমাদের হতেই হবে। এর আর কোনও বিকল্প নেই।

গণঅভ্যুত্থানের এক মাসের মাথায় সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন ও জনপ্রশাসন সংস্কারে ছয়টি আলাদা কমিশন গঠন করে সরকার। পরবর্তীতে এই তালিকায় নতন আরও চারটি কমিশন যুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো- স্বাস্থ্যবিষয়ক সংস্কার কমিশন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন, শ্রমিক অধিকারবিষয়ক সংস্কার কমিশন এবং নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন।

দশখাতের কোনটিতে কী ধরনের সংস্কার হওয়া প্রয়োজন, সে বিষয়ে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছে কমিশনগুলো। আগামী ডিসেম্বরের শেষে তাদের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা রয়েছে। এরপর রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত সংস্কারকাজ শুরু করা হবে বলে জানিয়েছে সরকার। তবে কতদিনের মধ্যে সংস্কারকাজ শেষ হবে, সে বিষয়ে এখনও সুস্পষ্ট কোনো সময়সীমা ঘোষণা করা হয়নি।

রাষ্ট্র সংষ্কারে কমিশন গঠনকে ‘ইতিবাচক অগ্রগতি’ হিসেবে সাধুবাদ জানালেও বিশ্লেষকরা বলছেন, এক্ষেত্রে সরকারের আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করা উচিৎ ছিল।

ড. জোবাইদা নাসরীন বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পর মানুষ দ্রুত কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন দেখার অপেক্ষায় ছিল, কিন্তু সরকার তাদের সেই আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারেনি।

এদিকে, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকেও কেউ কেউ সংস্কার প্রক্রিয়ায় ধীরগতির অভিযোগ তুলেছে। আবার বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি দলকে দ্রুত সংস্কার শেষ ও নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবিও তুলতে দেখা যাচ্ছে।

“এ অবস্থায় কতদিন ক্ষমতায় থেকে সরকার কী প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র সংস্কার করতে চায়, সেটি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। এতে সরকারের সংস্কার কাজেও গতি আসবে বলে আমি মনে করি,” বলেন মিজ নাসরীন।

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ কতদূর?

ক্ষমতা গ্রহণের পর যে কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জের মুখে অর্ন্তবর্তী সরকার পড়েছে, সেগুলোর একটি হলো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ। বিশ্লেষকরা মনে করেন যে, দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে না রাখতে পারায় আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি মানুষের বড় ধরনের ক্ষোভ জন্মেছিল।

আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মানুষের প্রত্যাশা ছিল, বাজারে পণ্যের দাম কমবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি।

ঢাকার ধানমণ্ডি এলাকার শায়লা সুলতানা নামে একজন বাসিন্দা বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। জিনিসপত্রের দাম তো কমেইনি, বরং সবকিছুর দাম আরও বেড়ে গেছে।

শায়লা ও তার স্বামী দু’জনই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, তারপরও ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া ও বাজার খরচ চালাতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।

একই কথা বলছিলেন আজিমপুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আমিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাহলে এত আন্দোলন-সংগ্রাম করে হাসিনারে নামায়ে সাধারণ মানুষের কী লাভ হলো?

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়ায় ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ হয়েছিল।

নতুন সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর সুদের হার বাড়ানোর পাশাপাশি নতুন করে টাকা না ছাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে সরকার। এতে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও বাজারে সেটার প্রভাব খুব একটা দেখা যায়নি। এমনকি তেল, চিনিসহ আমদানি করা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের শুল্কহার কমিয়েও দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পারছে না সরকার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব বলছে, অক্টোবরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ। গত তিন মাসে, অর্থাৎ অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এটাই সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি। অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৬৬ শতাংশে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী বলেন, সোজা কথায়, গত তিন মাসে সরকার কোনোভাবেই দ্রব্যমূল্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয় নাই।

দ্রব্যমূল্য যে সহনীয় পর্যায়ে নেই, সেটি সরকারও স্বীকার করছে। বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) নবনিযুক্ত খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার সাংবাদিকদের বলেন, আমি মধ্যবিত্ত, নিজে বাজার করে খাই। আমি নিজেও মূল্যস্ফীতির কারণে চাপে আছি।

সরকার বলছে, সাম্প্রতিক বন্যার কারণে কৃষিক্ষেত্রে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেটিও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। শিগগিরই চালসহ সবকিছুর দাম কমে আসবে বলেও আশা করছেন তারা।

আলী ইমাম মজুমদার বলেন, গত এক সপ্তাহ পর্যন্ত চালের দাম যতটুকু বেড়েছে আপাতত তা স্থিতিশীল রয়েছে, আমন ধান বাজারে এলে দাম আস্তে আস্তে আরও কমবে।

অর্থনীতির সংকট কাটছে?

বিশ্লেষকরা বলছেন যে, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা রীতিমত নাজুক হয়ে পড়েছিল। দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল। গত তিন মাসে সেটি বৃদ্ধি পেয়ে এখন ২০ বিলিয়ন ডলার ছুঁয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, যে উদ্যোগ থেকে আমরা সবচেয়ে বেশি ফলাফল দেখা যাচ্ছে সেটা বৈদেশিক মুদ্রা বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে ব্যাংকের রিজার্ভ স্থিতিশীল অবস্থায় আছে। খুব একটা বেড়েছে তা না, তবে কমে নাই।

রিজার্ভের ক্ষেত্রে তিন মাসে ভালো অর্জন দেখালেও সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি বলে জানিয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, যেখানে ফলাফল দেখতে পাচ্ছি না একেবারে, সেটা হচ্ছে, মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে।

দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতিও তিন মাসে সামান্যই কমেছে। গত জুলাইয়ে যেখানে ১১ দশমিক ৬৬ শতাংশ সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল, সেটি অক্টোবরে ১০ দশমিক ৮৭ শতাংশ হয়েছে।

এদিকে, ব্যাংকখাত সংস্কার ও অনিয়ম-দুর্নীতিরোধে একটি ব্যাংকিং কমিশন গঠনেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। সেইসঙ্গে, খেলাপি ঋণ ও বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

জাহিদ হোসেন বলেন, আপাতত ব্যাংকখাতের রক্তক্ষরণটাকে বন্ধ করা গেছে। তবে ডায়াগনোসিস এখনো পুরোপুরি সম্ভব হয়নি।

ফলে টাকা উত্তোলনে সীমা নির্ধারণ করাসহ নানান পদক্ষেপ নিয়েও ব্যাংকখাতের তারল্য সংকট পুরোপুরি কাটানো সম্ভব হয়নি।

এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকও দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অর্থ ধার দিচ্ছে না। তবে অন্য সবল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে দুর্বল ব্যাংককে সহায়তা করতে সম্প্রতি পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, গত ১৫ বছর ধরে দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাত থেকে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। তবে এখন কেনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেন বন্ধ হয়ে না যায়, সেজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।

তারপরও দেখা যাচ্ছে যে, দুর্বল ব্যাংকগুলো গ্রাহকের টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলার কী অবস্থা?

ক্ষমতা গ্রহণের পর গত ১০০ দিনে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বিশেষ করে, পাঁচই আগস্টের পর মাঠে পুলিশের অনুপস্থিতি ও পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধ প্রবণতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পায়।

একের পর এক ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকাসহ সারা দেশে আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যা এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। ঢাকার মধ্যে মোহাম্মদপুর এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির বিষয়টি সবচেয়ে আলোচিত হয়েছে।

সেখানে প্রকাশ্যে গণছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, সশস্ত্র মহড়া এবং বিহারি ক্যাম্পে খুনোখুনির ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে সেভাবে সক্রিয় ভূমিকায় দেখা যায়নি। আবার এটাও বাস্তবতা যে, পাঁচই আগস্টের পর হামলার শিকার পুলিশ ফাঁড়ি ও থানাগুলোর সবক’টি এখনো পুরোপুরি গুছিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।

এছাড়া ছাত্র আন্দোলন দমনে নিজেদের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণে পুলিশ বাহিনী যে ভাবমূর্তির সংকটে পড়েছিল, সেটিও কাটিয়ে ওঠা যায়নি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনীকে বিশেষ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামায় নতুন সরকার। এতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও জনমনে আতঙ্ক রয়েই গেছে।

এদিকে, গত তিন মাসে গণপিটুনিতে সারা দেশে অন্তত ৬৮ জন মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র।

একই সময়ে, কমপক্ষে ৭৮টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলেও জানায় সংস্থাটি। এছাড়া আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই বিভিন্ন স্থানে হামলা ও লুটপাটের শিকার হয়েছেন। সব মিলিয়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে, সেই প্রশ্ন উঠছে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, আমিতো দেখি হোম মিনিস্টার (স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা) অনেক সময় শুনেও না শোনার ভান করেন, (আইনশৃঙ্খলার বিষয়ে) উত্তর দিতে চান না, এভয়েড করে যান। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণে নাই।

নির্বাচনের অগ্রগতি কতটুকু?

বাংলাদেশে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে গত অক্টোবরে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটিও গঠন করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু করেছে বলে জানা যাচ্ছে। সরকার বলছে, গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন দেওয়া হবে।

বার্তা সংস্থা এএফপিকে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, এটি একটি প্রতিশ্রুতি, যা আমরা দিয়েছি। আমরা প্রস্তুত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নির্বাচন দেবো। সংস্কারের গতিই ঠিক করে দেবে, নির্বাচন কত দ্রুত হবে।

কিন্তু সংস্কার শেষ হতে কতদিন লাগবে, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। যদিও ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা আগে বলেছিলেন, কখন নির্বাচন হবে, সেটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়।

সরকারের পক্ষ থেকে সংস্কারের পর নির্বাচনের কথা বলা হলেও বিএনপি চাচ্ছে, দ্রুত সময়ের মধ্যে ভোট হোক। সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, নির্বাচন যত দ্রুত হবে, ততই জাতির জন্য মঙ্গল হবে। সংস্কার প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ জরুরি। সেজন্যই নির্বাচনের দরকার।  

‘গণহত্যার’ বিচার

শপথ নেওয়ার পর থেকেই অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যে কাজটি সম্পন্ন করার কথা বলে আসছে, সেটি হলো- জুলাই-অগাস্টের ‘গণহত্যার’ বিচার।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রাথমিক তালিকা অনুযায়ী, আন্দোলন চলাকালে তিন সপ্তাহে সাড়ে আটশ’র বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই মারা গেছেন গুলিতে।

হত্যার ঘটনায় ইতোমধ্যেই কয়েকশ মামলা হয়েছে, যেগুলোতে পুলিশ সদস্যদের পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়েছে। ‘গণহত্যার’ মামলার বিচার কাজ শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

শেখ হাসিনাসহ ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ, তাদের জোটসঙ্গীসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে গ্রেপ্তারে রেড অ্যালার্ট জারির জন্য আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের কাছে সম্প্রতি অনুরোধও জানিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলির কার্যালয়। ট্রাইব্যুনালের প্রধান কৌঁসুলি মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) যেহেতু মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠনের অভিযোগে অভিযুক্ত। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেন্ডিং আছে। কিন্তু বাংলাদেশের জুরিসডিকশনের বাইরে তিনি চলে গেছেন, সে কারণে ইন্টারপোল যাতে তাকে গ্রেপ্তারে করার ব্যবস্থা নেয় এবং তার ব্যাপারে অন্তত রেড অ্যালার্ট জারি করে, সেই ব্যাপারে আমরা অনুরোধ পাঠিয়েছি।

অভিযুক্ত রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তারে তোড়জোড় দেখা গেলেও বাকি আসামিদের ক্ষেত্রে তেমনটি দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন মামলার বাদীরা। নিহত ইমাম হাসানের বড় ভাই রবিউল আউয়াল বলেন, আমরা মামলা করেছি আগস্ট মাসে, কিন্তু সেটার অগ্রগতি কী? এখনও তো চার্জশিটই দেওয়া হলো না। যারা গুলি চালিয়েছে, পুলিশের সেসব সদস্যদের সবাইকে এখনও শনাক্ত করা হয়নি কেন? কেন সবাইকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচারকাজ শুরু করা হচ্ছে না।

আহতদের চিকিৎসা

আন্দোলন চলাকালে সারাদেশে ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সরকার। তাদের মধ্যে অনেকেই হাত, পা এবং চোখ হারিয়েছেন। আবার পঙ্গুত্বও বরণ করেছেন অসংখ্য মানুষ।

ক্ষমতা গ্রহণের পর ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’ গঠন করে নিহতদের পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি আহতদের ‘সুচিকিৎসা’র ব্যবস্থার কথা বলেছিলো সরকার। কিন্তু তিন মাস পর এখন ‘সুচিকিৎসা’র দাবিতে আহতদের বিক্ষোভ করতে দেখা যাচ্ছে।

গুলিতে আহত রাইসুল ইসলাম বলেন, ডাক্তার বলেছে আমার পেটের মধ্যে গুলি, চিকিৎসা ছাড়া উপায় নাই। আমার পরিবার ধার-দেনা করে এতদিন চিকিৎসা চালিয়েছে। এখন তাদের পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছে না। অথচ সরকার ফ্রি চিকিৎসার কথা বলে একবার খোঁজও নেয়নি। তবে ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে অবশ্য বলা হচ্ছে যে, তালিকা চূড়ান্তের পরও অর্থছাড়ের প্রক্রিয়ায় কিছুটা দেরি হচ্ছে।

‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনে’র সাধারণ সম্পাদক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, সমস্যাটা হলো প্রসেসিং-এর জায়গাতে।

সরকার কী বলছে?

ক্ষমতা গ্রহণের তিন মাসপূর্তিতে সম্প্রতি নিজেদের বিভিন্ন কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সেখানে মোটাদাগে পাঁচটি ক্ষেত্রে নিজেদের অর্জনের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সরকার মনে করে যে, ক্ষমতায় বসার প্রথম তিন মাসে তারা প্রশাসনিক ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণভাবে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে।

একইভাবে, দেশের ভঙ্গুর অবস্থা থেকে অর্থনীতি বেশ খানিকটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে বলেও জানানো হয়েছে। এর বাইরে, সংস্কার কাজ পরিচালনায় ব্যাপকভাবে বিদেশি আর্থিক সহায়তা পাওয়া, সংস্কারের রূপরেখা ঘোষণা এবং বন্যা মোকাবিলার পাশাপাশি তৈরি পোশাকশিল্পের সংকট ও অস্থিরতা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

সাংবাদিকদের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, মোটাদাগে তিন মাসে সরকার যথেষ্ট অর্জন করেছে। তবে দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা, প্রশাসনসহ অনেক ক্ষেত্রেই যে সংকট রয়েছে, সেটি অবশ্য স্বীকার করছেন উপদেষ্টারা।

সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়া উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, এত কম সময়ের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান সম্ভব না। সরকার চেষ্টা করছে এবং ইতোমধ্যেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেটার ফল দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সংকট আরও কমে আসবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।

একই কথা জানিয়েছেন ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তিনি বলেন, আমরা আশা করি যে, ছয় মাসের একটা টাইমফ্রেমের মধ্যে, (অর্থাৎ) আগামী তিন মাসের মধ্যে আমরা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারবো।

এ লক্ষ্যে সরকার নতুন করে আরও পুলিশ ও আনসার সদস্য নিয়োগ দিতে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

এছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনীকে মাঠে রাখার চিন্তা ভাবনা সরকারের রয়েছে বলেও জানিয়েছেন এই উপদেষ্টা। আসিফ মাহমুদ বলেন, পুলিশ সম্পূর্ণভাবে রিভাইভ করা এবং আমাদের যে অভ্যন্তরীণ যে অন্যান্য বাহিনীগুলো যারা আইনশৃঙ্খলা দেখে থাকে, তাদের মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসার পরপরই সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যাবে।

উল্লেখ্য যে, সম্প্রতি সেনসদরের এক ব্রিফিংয়ে জানানো হয়েছে যে, মাঠে নামার পর সেনাবাহিনী সাত শতাধিক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। সেইসঙ্গে, গণঅভ্যুত্থানের পর থানা থেকে লুট হয়ে যাওয়া ছয় হাজার অস্ত্র দুই লক্ষাধিক গুলি উদ্ধারের পাশাপাশি লুটের সঙ্গে সম্পৃক্ত আড়াই হাজার ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে তারা।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন