সংবিধানের স্থলে গঠনতন্ত্র চান ফরহাদ মজহার
কবি ও চিন্তাবিদ ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘সংবিধান’ শব্দটি পরিবর্তন করতে হবে। এটি ঔপনিবেশিক শব্দ। ব্রিটিশ শাসকেরা সংবিধান নামে আইন চাপিয়ে দিয়ে শাসন চালাত। কিন্তু গণতন্ত্রে শাসনের অস্তিত্ব নেই। সংবিধানের আভিধানিক অর্থ হবে ‘গঠনতন্ত্র’। জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে জনগণের রাষ্ট্রগঠনের অভিপ্রায়ই ব্যক্ত হয়েছে।
আজ শুক্রবার (১ নভেম্বর) এক আলোচনা সভায় এসব কথা বলেছেন তিনি। আজ সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে ‘দুর্নীতি ও রাষ্ট্রপতি বা সংস্কার’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন ফরহাদ মজহার। সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজ এই বৈঠকের আয়োজন করে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব নতুন একটি গঠনতন্ত্র উপহার দেওয়া। জনগণের অভিপ্রায়ের মধ্য দিয়ে এই সরকার ক্ষমতায় এসেছে। নতুন গঠনতন্ত্রে জনগণের অভিপ্রায়কে বাস্তবায়িত করতে হবে। এই গঠনতন্ত্র বৃহৎ হতে হবে, এমন নয়। এটি মাত্র ১৬ পাতারও হতে পারে। রাষ্ট্র কী করতে পারবে আর কী করতে পারবে না, জনগণকে কী ক্ষমতা দেওয়া হলো আর রাষ্ট্রকে কী ক্ষমতা দেওয়া হলো—সেই বিষয়গুলো গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট করে লিখিত থাকবে। রাষ্ট্র জনগণের জীবন ও জীবিকা নিশ্চিত করবে। ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ করতে পারবে না।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সারা বিশ্বের কাছে অবৈধ উল্লেখ করে ফরহাদ মহজার বলেন, অভিযোগ উঠতে পারে, অবৈধভাবে শেখ হাসিনাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই এই সংবিধানের অধীনে আমরা অন্তর্বর্তী সরকার চাই না। এই সংবিধান আমাদের জন্য বিপজ্জনক। এই সংবিধান দিল্লি এবং ইন্দো-আমেরিকান-ইসরায়েলের আগ্রাসন থেকে আমাদের রক্ষা করতে পারবে না। সুতরাং অবিলম্বে এই সংবিধান বাতিল করে, সেনাবাহিনী সমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকারের ধারণা থেকে বের হয়ে এসে পরিপূর্ণ স্বাধীন সরকার হিসেবে ঘোষণা দিতে হবে। সেই সরকারের প্রতি আমাদের সমর্থন সহযোগিতা পরিপূর্ণভাবে থাকবে।
ফরহাদ মজহার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের সর্বজনীন আদর্শের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন করা। কিন্তু তা করা হয়নি। ভাষা, ধর্ম, বর্ণ যেকোনো জাতীয়তাবাদভিত্তিক রাষ্ট্র উগ্রতা ও বিচ্ছিন্নতাবোধের সৃষ্টি করে। ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। আমরা মুক্তিযুদ্ধের ওই সর্বজনীন আদর্শের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক জাতিগোষ্ঠী ও সমাজ গঠন করতে চাই। যেখানে প্রত্যেক বিশ্বাস, আদর্শ ও শ্রেণি–পেশার মানুষ তাদের নিজস্ব অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে। স্বাধীন রাজনৈতিক জাতিগোষ্ঠীর বোধ যতক্ষণ না জনগণের চেতনায় আসবে, ততক্ষণ জনগণের প্রকৃত বিজয় অর্জন সম্ভব হবে না।
বড় দল হিসেবে বিএনপিকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে বলে মন্তব্য করেন ফরহাদ মজহার বলেন, বিএনপি কেন এই রাষ্ট্রপতিকে রাখতে চায়, তা বোধগম্য নয়। রাষ্ট্রপতি যখন বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগপত্র তার কাছে নেই, তখন থেকেই তার আর ক্ষমতায় থাকার নৈতিক অধিকার নেই। এই সরকার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে এসেছে। সেটিই তাদের সবচেয়ে বড় বৈধতা, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার দায় তাদের নেই। তারা রাষ্ট্রপতিকে বিদায় দেওয়ার ঘোষণা দিতে পারে। অধ্যাদেশ নয় ঘোষণা দিতে হবে। এই বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, সামরিক সরকার যদি অধ্যাদেশ জারি করে সরকার চালাতে পারে, তবে গণ-অভ্যুত্থানে গঠিত সরকারও ঘোষণা দিয়ে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে এবং সেটি বৈধ বলে গণ্য হবে। এই বৈধতার আইনগত ভিত্তি রয়েছে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে ফরহাদ মজহার বলেন, আগে গঠনতন্ত্র তৈরি করতে হবে। সর্বস্তরের জনগণের অভিপ্রায় অনুসারে গঠনতন্ত্র সম্পর্কে গণপরিষদ নির্বাচন করতে হবে। এরপরে হবে সরকার গঠনের নির্বাচন।
গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন শিক্ষাবিদ মোমেনা খাতুন, অধ্যাপক ঈসা মোহাম্মদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সাইফুল আলম, প্রাবন্ধিক মেহেদি হাসান, প্রকৌশলী আল মামুন, রাজনীতিক মমতাজ উদ্দিন আহমদ, মাসুদুর রহমানসহ অনেকে। সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড পিস স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক সাদেক রহমান।