গুম কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ, অভিযোগই দেননি বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন
সালাউদ্দিন আহমেদ। ছবি: বাংলা আউটলুক
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির সক্ষমতা নিয়ে সন্দেহ থাকায় নিজের গুমের ঘটনায় কোনো অভিযোগ জমা দেননি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) স্থায়ী কমিটির সদস্য ও গুমের শিকার সালাউদ্দিন আহমেদ।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার বিরোধীদের আন্দোলনের সময় ২০১৫ সালে উত্তরা থেকে গুম হন বিএনপির এই প্রভাবশালী নেতা। গত পাঁচ আগস্ট শেখ হাসিনা ছাত্র জনতার আন্দোলনের মুখে গোপনে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর বিএনপির এই নেতা বাংলাদেশে ফেরত আসেন।
এদিকে, ৫ আগস্ট পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মানবাধিকার প্রশ্নে শেখ হাসিনার সরকারের সময় গুম শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে কি হয়েছিল তা তদন্তে একটি কমিশন গঠন করে। প্রথমে এ কমিশনে অভিযোগ জমা দেওয়ার তারিখ গত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত থাকলেও, পরে তা ১০ দিন বাড়ানো হয়েছে।
ওই কমিশনে এখন পর্যন্ত কতটি অভিযোগ জমা হয়েছে তা কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়নি। তবে গুমের শিকার ও তাদের পরিবারের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’—এর পক্ষ থেকে জানানো হয়, নিয়মিতভাবে তারা ওই কমিশনে অভিযোগ জমা দিচ্ছেন।
এ বিষয়ে বাংলা আউটলুকের পক্ষ থেকে কমিশনের দুজন সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা কোনো কথা বলেননি।
এদিকে, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ বলছেন, ‘গুম সংক্রান্ত একটা কমিশন করা হয়েছে। এই কমিশনে যারা গুমের শিকার হয়েছেন তারা গিয়ে বক্তব্য দিতে পারবেন। এবং যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন তাদের একটা বক্তব্য আমি পত্রিকায় দেখেছি যে, তাদের এখতিয়ার সম্পর্কে তারা বলেছেন যে, এটা আরও সংশোধন হওয়া দরকার, ক্ষেত্র আরও বর্ধিত হওয়া দরকার।’
'আরও wide ( বিস্তৃত) হওয়া করা দরকার। তা না হলে যারা গুম হয়ে আছেন, এখনো পর্যন্ত খোঁজ নেই যাদের, তাদেরকে খুঁজে বের করার বিষয়ে ওনাদের এই বক্তব্য রেকর্ড করে খুব একটা বেশি কাজে আসবে না। তাদের তদন্ত করার কোনো এখতিয়ার দেওয়া হয়নি।’ বলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘তো সে ক্ষেত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধ আদালত যেটা এখন পুনর্গঠন করা হচ্ছে, আইন এবং আদালত সেখানে কমপ্লেন ( অভিযোগ) করলে, কেস ( মামলা) করলে হয়তো কিছু রেমিডি ( সমাধান) পাওয়া যেতে পারে।’
সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আমিও চিন্তা করছি, আমি তো গুমের শিকার, ভিকটিম, আমার ক্ষেত্রে তো ক্রাইম কমিটেড হয়েই গেছে, যারা করেছে। আমি সেটার জন্য প্রতিকার চাইবো সে আদালতে। যদি আদালতটা সুষ্ঠুভাবে পুনর্গঠিত হয়, প্রসিকিউশন এবং প্রসিকিউটর নিয়োগ করা হয়েছে, প্রসিকিউশনে যারা যারা আছেন, তাদের পূর্ণাঙ্গ গঠন হয়ে গেলে, তাদের এখতিয়ার কী হচ্ছে, তদন্ত কীভাবে হচ্ছে দেখে। আমি মনে করি যারা গুমের শিকার হয়েছেন, তারা ওই কোর্টে মামলা ফাইল করতে পারেন। আর যারা গুমের শিকার হয়ে এখনো পর্যন্ত।’
মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের প্রতিবেদন অনুসারে, এ পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন ৭০৯ জন। এই ৭০৯ জনের মধ্যে এখনো ১৫৫ জনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তাহলে তাদের ক্ষেত্রে এই সরকারের ভূমিকা পালন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করে সালাউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, ‘আর যারা জানেন যে বাংলাদেশে গুম, খুন অপহরণের সঙ্গে জড়িত ছিল ফ্যাসিবাদের শাসনকে দীর্ঘায়িত করার জন্য, তাদের মধ্যে কেবল জেনারেল জিয়াউল আহসান নামের একজন অ্যারেস্ট (গ্রেপ্তার) করা হয়েছে । যাকে এখনো পর্যন্ত তেমন কোনো ইন্টারগেট করা হচ্ছে না। তার জবান দিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো স্বীকারোক্তি আসেনি। তাকে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে ১০-১৫ দিন, রিমান্ডে তাকে কী জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে, কে জিজ্ঞাসাবাদ করছে কিছুই মানুষ জানে না। এবং আমাকে যখন গুম করা হয় তখন এই জিয়াউল আহসান সম্ভবত কর্নেল অথবা বিগ্রেডিয়ার ছিলেন, র্যাবের, তো তাদের দায়-দায়িত্ব ছিল, তারা জড়িত ছিল বলে আমি মনে করি। তদন্ত হলে বেরিয়ে আসবে।’
তিনি বলেন, ‘এখন নেই জিয়াউল আহসান ছাড়া বাংলাদেশে অন্যন্যা যেসব গোয়েন্দা সংস্থা গুমের সঙ্গে জড়িত, এবং বিগত দিনের ফ্যাসিজমের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে যাদের পরচিালিত করা হতো তো আরও আছে। তাদের মধ্যে মানে আমরা যতটুকু জানতে পারি, এনএসআইয়ের মহাপরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল জোবায়ের, আমরা জানতে পারি বেনজীর (আহমেদ), তারপর বর্তমান আইজিপি ছিল তার পরে যারা স্যাংশন খেয়েছে আমেরিকার, চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, এই যে ডিবি হারুন, মনিরুল, মেহেদী, আরও অনেকেই আছে। এবং তাদের সবারই নাটের গুরু ছিলেন জেনারেল তারেক সিদ্দিকী।’
তিনি বলেন, ‘এবং সবচেয়ে বড় যেটা, এগুলো পরিচালনা করতেন শেখ হাসিনা নিজেই। সুতরাং তাদের মধ্যে কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিনা কাউকে জিজ্ঞাসা করে হচ্ছে কি না?’
তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘শুধু জিয়াউল আহসান ছাড়া মেনশনাবল ( উল্লেখযোগ্য) কোনো নাম নেই। এবং জিয়াউল আহসানকে কি জিজ্ঞাসা করা হয়েছে এবং কি তার স্বীকারোক্তি কিছুই আমরা জানি না।’
‘তাহলে বাংলাদেশে যত গুম-খুন হয়েছে, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নটোরিয়াস কিলার হিসেবে জিয়াউল আহসানের নাম উঠে এসেছে। কিন্তু একটি কথাও তো তার মুখ দিয়ে বের হলো না। তাহলে ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনও সর্বত্র বসে আছে?’ প্রশ্ন তার।
তিনি মনে করেন, ‘তারা এদের কাছ থেকে কোনো স্বীকারোক্তি আদায় করবে না। তার মানে কী দাঁড়ায় বাংলাদেশে কোনো গুম-খুন হয়নি? সেই জন্য আমার আহ্বান থাকবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে।’
সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এছাড়া বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের একটি কণ্ঠ এক জায়গায় এসে মিলিত হয়েছিল, গত ৫ আগস্ট আমাদের নতুন স্বাধীনতা দিবস।’
তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে সমস্ত আয়নাঘরকে ভেঙে দেওয়া হোক, উন্মুক্ত করা হোক, চিহ্নিত করা হোক, এবং যারা বন্দি আছে তাদের মুক্ত করা হোক, ১৮ কোটি মানুষের মধ্যে একটি মানুষও এই দাবির বিরুদ্ধে ছিল না। এটা সবচেয়ে বড় দাবি ছিল, নতুন স্বাধীনতার, নতুন বাংলাদেশের। নতুন বিজয় দিবসের। এবং শত-সহস্র শহীদের রক্তের দাবি এটা যারা গুমের শিকার হয়েছেন, যারা দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর ফ্যাসিবাদের নির্যাতনের শিকার হয়ে আটক আদেশে আটক থাকতে বাধ্য হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘গ্রেপ্তার হয়েছেন, নির্যাতন হয়েছেন, মামলা-হামলা হয়েছে। এগুলো বিচার হতে হবে। এগুলোর মধ্যে নম্বর ওয়ান জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়েছেন, হত্যার শিকার হয়েছেন, এটা এক নম্বর প্রায়োরিটি । এর বিচার হতেই হবে। বাংলাদেশে কোনোরকম গুমের ঘর, আয়নাঘর, এরকম অন্ধকার বন্দিশালা থাকতে পারবে না। এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং হতে পারবে না। বিচারবহির্ভূত হত্যা, আটক আদেশ, গুম, খুন এসমস্ত বাংলাদেশ থেকে উঠে যেতে হবে। এটা আমাদের স্বপ্ন। নতুন বাংলাদেশে এটা আমাদের প্রথমেই নিশ্চিত করতে হবে।’
দেড়শত বা তার বেশি গুমের ঘটনার তথ্য উপাত্ত গুম সংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি কার্যালয়ে জমা দিয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন। মায়ের ডাকের সংগঠক সানজিদা ইসলাম তুলি জানান, তারা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে নিয়ে এ সকল তথ্য উপাত্ত কমিশনের গুলশান কার্যালয়ে জমা দিয়েছেন এবং আরো দেবেন।
তুলি বাংলা আউটলুককে বলেন, জমা দেওয়া এ ঘটনাগুলো ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যেই ঘটেছে।
কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।