আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতদের মৃত্যুসনদ পরিবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল: ঢামেক চিকিৎসক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৫ পিএম
প্রকৃত ঘটনা আড়াল করার জন্য বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতদের মৃত্যুসনদ পরিবর্তনের নির্দেশনা ছিল প্রশাসনের পক্ষ থেকে। গুলির ঘটনাগুলোকে পাশ কাটিয়ে সাধারণ মৃত্যুর বর্ণনা দিয়ে মৃত্যুসনদ দেওয়ার জন্য নির্দেশনা ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকদের। এই অভিযোগ করেছেন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক মোশতাক আহমেদ।
আজ রবিবার বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের আয়োজনে “হেফাজতে নির্যাতন ও দায়বদ্ধতা: প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকার শীর্ষক” এক মতবিনিময় সভায় তিনি এই অভিযোগ করেন।
কে নির্দেশনা দিয়েছিল এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, উপরের থেকে। তাদের এত লাশ ধরনের সক্ষমতাও ছিল না।
মতবিনিময় সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও ব্লাস্টের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক সারা হোসেন, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সামিয়া সাগর তোশমি এবং হেফাজতে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন।
সভায় বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনিক আর হক ও ঢাকা জজ কোর্টের আইনজীবী মো. আবু তৈয়ব বক্তব্য দেন।
ঢাকার বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল নোমানের সঞ্চালনায় সভায় 'নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩' এর অধীনে প্রথম ঐতিহাসিক রায় প্রাপ্ত জনি হত্যা মামলা বিষয়ক সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের ও ব্লাস্টের স্টাফ আইনজীবী নাজমুল করিম।
উল্লেখ্য, আগামীকাল ৯ সেপ্টেম্বর পল্লবী থানা-পুলিশ হেফাজতে এসআই জাহিদের নির্যাতনের নিহত জনির পক্ষে দায়েরকৃত নির্যাতন এবং পুলিশ হেফাজতে মৃত্যু নিবারণ আইনের প্রথম রায়ের ৪ বছর পূর্ণ হতে যাচ্ছে। সাড়ে ছয় বছর আইনি লড়াই শেষে ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বিচারের একটি ধাপ পার করা হয় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত থেকে।
এ বিষয়ে জনির ভাই ইমতিয়াজ হোসেন রকি বলেন, মামলা চলাকালীন সময়ে অপরাধীদের কাছে বিভিন্ন প্রলোভন ও হুমকির সত্ত্বেও গণমাধ্যম এবং ব্লাস্টের সহযোগিতায় নিম্ন আদালত থেকে একটি যুগান্তকারী রায় পেয়েছি। ২০২০ সালে ক্ষতিপূরণের আদেশ সম্বলিত রায় পাওয়া সত্ত্বেও অদ্যাবধি ক্ষতিপূরণের টাকা হাতে না পাওয়ায় তার পরিবারের জীবিকা নির্বাহ করা দুর্বিষহ হয়ে পড়েছে। তিনি আশা করছেন রাষ্ট্রের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হেফাজতে নির্যাতনের শিকার ফামিয়া সাগর তোশমি বলেন, দেশের এই নতুন সূচনালগ্নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করবে। তিনি সকল নাগরিক স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে পারবেন মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
ব্যারিস্টার অনিক আর হক যারা পুলিশ হেফাজতে নির্যাতিত ও মৃত্যুবরণ করেছে সেসব ব্যক্তিদের পরিবারের জন্য যৌক্তিক ক্ষতিপূরণ নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সংশ্লিষ্ট আইনে ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের সুরক্ষার বিধান উল্লেখ রয়েছে। এ ধারার অধীনে প্রয়োজন বিশেষ ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা সুরক্ষার দাবি করতে পারেন।
আইনজীবী মো. আবু তৈয়ব নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন, ২০১৩ এর সুষ্ঠু প্রয়োগের জন্য এই আইন বিষয়ে সম্যক ধারণা লাভের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
মানবাধিকার কর্মী ও তদন্ত কমিশনের (জোরপূর্বক গুম বিষয়ক) সদস্য নূর খান লিটন বলেন, দেশে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া না গেলে এবং সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব না হলে এবং একইসাথে বিদ্যমান আইন সম্পর্কে সঠিক ধারণা বা সঠিক ব্যাখ্যা না জানার কারণে আইন এর সঠিক প্রয়োগ বা বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তিনি এই বিষয়গুলো নিয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে আরও বেশি বেশি করে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে জনগণের মাঝে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতনতা তৈরির প্রস্তাব রাখেন।
সারা হোসেন হেফাজতে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের আইনগত সুরক্ষার পাশাপাশি আর্থিক এবং সার্বিক সহায়তার ওপর জোর দিন। ইচ্ছাকৃতভাবে আইনের ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হতে বিরত থাকার আহ্বান জানান তিনি।
আলোচকেরা ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের অধীনে ডাক্তারদের সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্তির সুপারিশ দেন। পাশাপাশি জুলাই থেকে ৫ আগস্টে নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীদের যথাযথ সুরক্ষা প্রদানের প্রতিও গুরুত্বারোপ করেন।
তারা বলেন, একটি হটলাইন বা হেল্প লাইন থাকা যেতে পারে, যেখানে ভুক্তভোগীরা প্রতিকারের জন্য আবেদন জানাতে পারবেন, আর হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু বন্ধ এবং এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিতে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান।
সমাপনী বক্তব্যে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এবং ব্লাস্ট ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য জেড আই খান পান্না বাংলাদেশে বিদ্যমান তিনটি আইন যথাক্রমে দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি, বাংলাদেশ পুলিশ প্রবিধান যুগোপযোগী না হওয়ার কারণে তা সংশোধনের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, গবেষক, একাডেমিক, অধিকার কর্মীসহ বিশিষ্টজনেরা আলোচনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী দেশের সংস্কার পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিতের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন। একই সাথে নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের ন্যায় বিচার নিশ্চিতে বিদ্যমান আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের দাবি জানান।