Logo
Logo
×

সংবাদ

গুম হওয়া ব্যক্তির স্বজনের সঙ্গে শেষ কথা

‘মা আমাকে ওরা মারছে’

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৫০ পিএম

‘মা আমাকে ওরা মারছে’

গুম হওয়া ব্যক্তিদের ছবি হাতে স্বজনরা। ছবি: সংগৃহীত

আব্দুল কাদের মাসুম ২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর গুমের শিকার হন। সেই মাসুমের সঙ্গে মা আয়শা বেগমের শেষবার ফোনে কথা হয়েছিল। তখন মাকে মাসুম বলেছিলেন,‘মা ওরা আমারে অনেক মারধর করেছে। আমি ভালো নেই।’ এরপর ফোন কেটে যায়। সেই ২৩ সেকেন্ডের কথাই মায়ের কানে এখনো বাজে। 

আয়শা বেগম বলেন, ‘দেশ আবার স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু আমার ছেলে এখনো ঘরে ফেরেনি। আমার ছেলে মাসুমের জন্য কি দেশ স্বাধীন হয়নি?’ কথাগুলো বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। এসময় তিনি ছেলের ছবির দিকে তাকিয়ে ছিলেন, আর দুই চোখ দিয়ে অঝোর পানি পড়তে ছিলো তার। 

আজ শুক্রবার (৩০ আগস্ট) সকালে আন্তর্জাতিক গুমপ্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে ‘মায়ের ডাক’ আয়োজিত গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধের প্রতিবাদে এক মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। সেখানে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত মানবাধিকারকর্মী, রাজনীতিবিদ, আইনজীবী ও গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদরা উপস্থিত ছিলেন।

তিন ঘণ্টাব্যাপী এই কর্মসূচিতে ৩০ জনেরও বেশি অংশগ্রহণকারী ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছতার পক্ষে কথা বলেন। তাদের অনেকের হাতে স্বজনের ছবি ছিল।

অনুষ্ঠানের এক কর্ণারে ছেলের ছবি হাতে নিয়ে বসে ছিলেন গুম হওয়া মাসুমের মা আয়শা বেগম। তিনি বলেন, মাসুম ২০১৩ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ওই সময় তিনি সেনাবাহিনীর কমিশন র‌্যঙ্কে পরীক্ষা দেন ও লিখিত পরিক্ষায় পাস করেন। কয়েকদিন পরেই ভাইভা ছিলো মাসুমের। তার মধ্যেই ভাটারা থানাধীন এলাকায় থেকে নিখোঁজ হন তিনি। ১২ দিন পরে ১৬ ডিসেম্বর একটি অচেনা নম্বর থেকে ফোন করে মাসুম। সেই দিনটি ছিলো মাসুমের জন্মদিন। তখন বলেছিলেন, ‘মা আমি মাসুম, আমি ভালো নেই। আমাকে ওরা মারধর করছে।’ এই কথা বলতে বলতে ফোন কেটে দিয়েছিলো। প্রায় ১১ বছর পার হয়ে যাচ্ছে এখনো মাসুমের কোন খবর নেই। শুধু মাসুম নয় ওই সময় তার সঙ্গে থাকা আল-আমিন, রাসেল, আদনান, সুমনসহ ছয় জন গুমের শিকার হয়। তাদেরও খোঁজ নেই। 

মায়ের ডাক সংগঠনটির সমন্বয়ক সানজিদা ইসলাম তুলি বলেন, ‘৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যান। অবশিষ্ট অপশক্তিগুলো এখনো দেশে অবস্থান করছে। কিন্তু গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের তথ্যগুলো এখনো পরিবারের কাছে আসছে না।’ 

বিভিন্ন সময়ে বিরোধী মতের ব্যক্তিদের গুম করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে আসছেন ভুক্তভোগী পরিবারগুলো। নিখোঁজ অনেকেই ফিরে এসে ‘আয়নাঘর’ নামক গোপন কারাগারে বন্দি ছিলেন বলে দাবি করেছেন। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্র্বতী সরকার এ বিষয়ে এখনও চুপ আছে। তাই দ্রুত এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণাসহ শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। 

তিনি বলেন, ‘আমাদের এখন অতীতকে স্মরণ করে ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। কল্পনাও করা যাবে না, গত সরকারের অধীনে পুলিশ কতটা অমানবিক ছিল। আমি ২৩ ঘণ্টা গুম ছিলাম, দুই মাস জেলে ছিলাম। সে সময় এমন অনেক ঘটনা দেখেছি, সেগুলো লিখলে বিরাট এক বই হয়ে যাবে। গুম নিয়ে মায়ের ডাকসহ অনেকেই তালিকা তৈরি করেছে। তার ৯৫ শতাংশের মতো সঠিক। তবে শতভাগ সঠিক করতে পারবেন কি না জানি না।’

মাহমুদুর রহমান মান্না আরও বলেন, ‘গত জুলাইয়ে কত মানুষ মারা গেছে? হয়তো হাজারেরও বেশি। আমরা বলতে চাই, তাদের হত্যার বিচার করতে হবে। যারা গুম-খুনের শিকার হয়েছেন, তাদের কাছে আমাদের যেতে হবে, সরকারকে যেতে হবে। আমরা যে মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাচ্ছি, সে বাংলাদেশে সব মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।’

অনুষ্ঠানে গুম থেকে ফিরে আসা মাইকেল চামকা বলেন, ‘২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল ঢাকার কল্যাণপুর থেকে সাদাপোশাকধারী সাত জন আমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়। শেখ হাসিনার পতনের পর আমাকে আমার এলাকার একটি জায়গায় ছেড়ে দিয়ে আসে। সেখান থেকে আমি বহু কষ্টে বাড়ি পৌঁছি। শেখ হাসিনা এই গুমের মাধ্যমে আমাদের এই ভয় দেখিয়েছিলেন। সরকার ইচ্ছা করলে মাসের পর মাস গুম করে রাখতে পারে। আমরা সব গুম-খুনের ন্যায় বিচার চাই। এখানে যারা কান্না করছে, তাদের কষ্ট আমি বুঝি। দেশে আয়নাঘর নামে যেসব বন্দিশালা আছে, এগুলো বন্ধ করতে হবে। লেখক-কবি-শিল্পীরাসহ সবাই এসবের বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে তা বন্ধ হবে না।’ 

২০১৩ সালে গুম হয় সাজেদুল ইসলাম সুমন। তারা দুই মেয়ে আছেন। বড় মেয়ে হাফসা ইসলাম তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ত, আর ছোট মেয়ের বয়স দেড় বছর ছিল। এখন বড় মেয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে পড়েন আর ছোট মেয়ে আরওয়া ইসলাম ষষ্ট শ্রেণিতে পড়েন। 

বড় মেয়ে হাফসা ইসলাম বলেন, ‘আমার বাবার কথা কিছুটা মনে আছে। কিন্তু আমার ছোট বোন এখনো বাবার জন্য কাঁদে। ছবি দেখেই বড় হয়েছে আরওয়া ইসলাম। আমার বাবা বিএনপি করতো বলে তাকে গুম করা হয়েছে। তার কোন হদিস নেই। আমার বাবার হত্যার বিচার চাই। আমার বাবাকে গুম করার পেছনে যারা জড়িত রয়েছে তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের মাধ্যমে বিচার করতে হবে। এটাই আমাদের চাওয়া।’

গুমের শিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান বলেন, ‘২০১৭ সালের ৪ ডিসেম্বর আমাকে বন্দুক তাক করে গুম করা হয়েছিল। পরে গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে আমরা লুকিয়ে লুকিয়ে মিটিং করেছি, কীভাবে তাদের সহায়তা করা যায়। আমরা চাই, এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যে কমিশন করেছে, তাদের মাধ্যমে সব গুমের দ্রুত বিচার করতে হবে। পুরো স্টেট মেশিনারিকে আইডেন্টিফাই করতে হবে।’

গুম হওয়া ইসমাইল হোসেনের মেয়ে আনিকা ইসলাম ইশা বলেন, ‘আমার বাবাকে আমার কাছ থেকে দূরে রাখা হয়েছে। আমার ছোট ভাই প্রতিদিন আশায় থাকে বাবা ফিরবে বলে। মাঝেমধ্যে সে প্রশ্ন করে, বাবা কেন আসে না? আমরা বাবাকে হারিয়ে অসহায়, আমার বাবাকে ফেরত চাই, আমার ভাইয়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই। আমার বাবার কী হয়েছে জানতে চাই।’

গুমের শিকার কাউসার হোসেনের মেয়ে লামিয়া বলেন, ‘২০১৩ সালের ৪ ডিসেম্বর আমার বাবাকে গুম করা হয়েছে। আমি তখন ছোট, আমার বাবার কথা আমার মনে নেই। আজও বাবার আদর পাইনি। বাবাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। বাবাকে আমি ছুঁতে চাই, বাবার আদর কেমন জানতে চাই। আমি ১১ বছর রাস্তায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাবাকে ফেরত চেয়েছি। আমরা একটাই দাবি, আমার বাবাকে ফেরত দেওয়া হোক।’ 

অনুষ্ঠানে অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ও মানবধিকারকর্মী সাইয়েদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের অনেক মানবাধিকার সংগঠন পার্টি স্টেট। কিন্তু এগুলো শুধু লিখিত ও নামসর্বস্ব। এখানে এসে যেসব বাচ্চা কান্না করলো, তাদের হাসি ফিরিয়ে দিতে না পারলে আমাদের এগুলো ব্যর্থ।’ 

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন বলেন, ‘গুম শব্দ নেই বলে বিচার করা যাবে না, এটা সঠিক নয়। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতের মুখ বন্ধ ছিল। আদালত এই ব্যাপারে নীরবতা পালন করেছে। কোনো হস্তক্ষেপ আমরা দেখিনি।’

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সাইফুল হক বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক গুমবিরোধী সনদে সই করেছে, এ জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। এই কমিটি একটি তদন্ত কমিটি করতে বলেছে, কিন্তু তদন্ত কমিটিই যথেষ্ট নয়। এর সঙ্গে জড়িতদের যেন আইনের আওতায় এনে বিচার নিশ্চিত করা হয়। বিষয়টি তদন্ত কমিটির কার্যাবলির মধ্যে দেওয়া হোক। গুরুত্ব দিয়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের যেন তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দেওয়া হয়।’

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন