বিডিআর বিদ্রোহ
সেনাবাহিনীর তদন্ত রির্পোট ছুড়ে ফেলে নির্দেশনা মতো রিপোর্ট লিখতে বলেছিলেন শেখ হাসিনা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০৮:১৭ পিএম
বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় সেনাবাহিনীর তদন্ত রিপোর্ট ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে তার নির্দেশনা মতো রির্পোট করতে বলেছিলেন। কিন্তু পরের বারও সঠিক তদন্ত রির্পোট দেওয়ায় তাকে ৩৬ দিন ডিজিএফআইয়ের আয়নাঘরে আটকে রেখে নির্যাতন করা হয়। পরে একটি মিথ্যা মামলায় তাকে ৫ বছর বন্দি রাখা হয়। সম্প্রতি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের টকশোতে এসব তথ্য জানান সাবেক সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন ও বিডিআর বিদ্রোহের তদন্তের সমন্বয়ককারী অফিসার ড. খান সুবায়েল বিন রফিক।
ড. খান সুবায়েল বিন রফিক বলেন, ২০০৯ সালের অক্টোবরের ১৪ তারিখ, যেহেতু আমি সমন্বয়কারী কর্মকর্তা ছিলাম, আমাকে এবং তৎকালীন ডিজি মইনুল ইসলাম প্রাইম মিনিস্টার অফিসে ডাকা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওনি ওনার ব্যক্তিগত কক্ষে আমাকে এবং মইনুল স্যারকে ডাকেন। আমি ওনার সামনে আমার রিপোর্টটা পেশ করি। আমি যখন আমার রিপোর্টটা পেশ করি তখন দেখে ওনি এটা ছুড়ে ফেলে দেন। ওনি ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলেন, এগুলো কি আবোল-তাবোল নিয়ে আসছো? তোমাকে যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলো ফলো করছো না কেন? যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেগুলো সব ফলো করবে বলে ওনি চলে যেতে বলেন।
ক্যাপ্টেন সুবায়েল বলেন, আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও। সে যায়নি। পরবর্তীতে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। আমার স্ত্রী তুলে নিয়ে আসার হুমকি দেওয়া হয়। এরপর ৫ বছর জেলে ছিলাম।
ড. খান সুবায়েল আরও বলেন, তখন জেনারেল মইনুল বলেন, তুমি এগুলো কীভাবে করছো? এখান কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের নাম থাকা যাবে না। পুলিশ থেকে যে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে শুধুমাত্র সেই রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে তদন্ত কার্যক্রমের রিপোর্ট করতে হবে। সেনাবাহিনী বা র্যাবের যে রিপোর্ট আছে সেটি গ্রহণ করা যাবে না।
তিনি বলেন, এরপর আবার ১৯ অক্টোবর আমাকে আবার ডাকা হয়। তবে আমি সেই রিপোর্ট কোনোটাই চেঞ্জ করি নাই। আমি একটাই উত্তর দিয়েছিলাম যে, আমি আমার ভাইয়ের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করতে পারব না। এরপর কয়েকদিন পর আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। ডিজিএফআইয়ে আটক থাকাকালীন আমি রেজা স্যারকে সেখানে বন্দি দেখি। এর আগে আমি তাকে চিনতামও না। এটা আয়নাঘর ছিল।
ড. খান সুবায়েল বলেন, এটি পরিকল্পিত গণহত্যা। এই পরিকল্পিত গণহত্যাটি সংঘটিত হয়েছিল বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদের চেতনাকে, দেশ প্রেমকে, যারা দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শুধুমাত্র সামরিক-বেসামরিক নয়, সমগ্র বাংলাদেশকে ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য প্রথম স্টেপ ছিল এটি। এবং এই গণহত্যার গণহত্যার পিছনে সামরিক, বেসামরিক এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত।
তিনি আরও বলেন, আমি যখন এই বিডিআর বিদ্রোহের তদন্তের সমন্বয়ককারী অফিসার হিসেবে দায়িত্ব নিলাম তখন বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের যিনি উপদেষ্টা রয়েছেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জাহাঙ্গীর স্যার, তার নেতৃত্বে একটি তদন্ত টিম কাজ করছিল। এর বাইরে র্যাবের একটি তদন্ত কমিটি ছিল। পুলিশের একটি তদন্ত কমিটি ছিল, যেখার নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল কাহার আকন্দ। আপনি নামগুলো খেয়াল করবেন, আবদুল কাহার আকন্দ এবং মনিরুল ইসলাম এবং বিডিআরের অভ্যন্তরীণ একটি তদন্ত কমিটি ছিল। যেটার নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তৎকালীন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ পরে যিনি সেনা প্রধান হয়েছিলেন। সেখানে বিডিআরের ডিজি ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল মইনুল ইসলাম। ওনি পরবর্তীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল হিসেবে অবসরে যান। আমি যখন কাজ করতাম তখন তাদের সব এভিডেন্স আমার কাছে আসত। আমি দেখতাম সেখানে তদন্ত কার্যক্রম বাধা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এই তদন্তের রিপোর্টে আমি দেখতে পাই এই বিডিআর গণহত্যার পরিকল্পনা করা হয় ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। পরবর্তী তিন মাসে ৫০ জনের অধিক বিডিআরের সৈনিকরা বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা এসব বিষয় পরিকল্পিতভাবে গোপন করেছে। এর সঙ্গে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস এবং জাহাঙ্গীর কবির নানক জড়িত ছিল। তাদের সঙ্গে বিডিআরের সৈনিকরা একাধিকবার বৈঠক করেছে।
তিনি বলেন, ২০০৯ সালের মে মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাসের ভেতরে বিডিআরের ভেতরে তিনজন আত্মহত্যা করেন। এই তিনজনই ছিল প্রধান সাক্ষী। তারা কোনো কারণ ছাড়াই আত্মহত্যা করেন। তারা কীভাবে আত্মহত্যা করেন বা তারা আত্মহত্যা করেছেন কী না সেটি আজ পর্যন্ত তদন্ত করা হয়নি।
ড. খান সুবায়েল বলেন, গণহত্যা এবং তার সঠিক বিচার না করার কারণে গুটিকয়েক সেনা অফিসার তারা গুম-খুন এবং আয়নাঘরের সূচনা এখান থেকে। আমি এই জন্য প্রত্যেকটা না ক্লিয়ারভাবে বলতে চাই, জেনারেল আজিজ, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন, তৎকালীন ডিজি ডিজিএফআইয়ের ফজলুর আকবর, তৎকালীন র্যাবের কর্মকর্তা জেনারেল জিয়া যাকে এখন গ্রেপ্তার করা হয়েছে, লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুজিব দুঃখজনকভাবে তিনি এখনো সেনাবাহিনীতে আছেন। এদের প্রত্যেকের হাতে রক্ত রঞ্জিত। এদের প্রত্যেকের হাতে গুম, খুন, দুর্নীতি হয়েছে। এগুলোর মাস্টারমাইন্ড হলেন মেজর জেনারেল তারেক সিদ্দিকী যিনি সমগ্র জিনিসটাকে কন্ট্রোল করেছেন। ভারতের নিম্নমানের জিনিসগুলো সেনাবাহিনীতে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। ইন্ডিয়া থেকে যে মর্টার কেনা হয়েছে সেটি ফায়ার করতে গিয়ে একজন অফিসার এবং দুজন সৈনিক মারা গেছেন।