বিবিসির প্রতিবেদন
ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশে ‘হিন্দু নির্যাতন’ নিয়ে গুজব ছড়ানো হয়েছে
বিবিসি
প্রকাশ: ১৮ আগস্ট ২০২৪, ০৪:১৪ পিএম
বাংলাদেশের 'হিন্দু ক্রিকেটার' লিটন দাশের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে গুজব ছড়ানো হয়।
বাংলাদেশে ভয়ংকর সহিংসতা হচ্ছে, বাড়ি-ঘর পুড়ছে এবং কান্নাজড়িত কণ্ঠে নারীরা সাহায্যের আবেদন করছে- এমন মর্মান্তিক সব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে ‘হিন্দু গণহত্যা’ চলছে দাবি করে অনেকে সেই ভিডিওগুলো শেয়ারও করছেন, যাদের অগ্রভাগে রয়েছে উগ্র ডানপন্থিরা।
তাদেরই একজন স্টিফেন ইয়াক্সলি-লেনন, যিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে টমি রবিনসন নামে পরিচিত। উগ্র ডানপন্থি এই ব্যক্তি যুক্তরাজ্যের সহিংসতার সময় বিভ্রান্তিকর পোস্ট করার জন্য ব্যাপক সমালোচিত হয়েছিলেন।
কিন্তু বিবিসির তথ্য যাচাই বিভাগ ‘বিবিসি ভেরিফাই’ এবং ‘গ্লোবাল ডিসইনফরমেশন টিম’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এমন সব ভিডিও যাচাই করতে গিয়ে দেখেছে, সেগুলোর অনেকগুলোই আসলে ভুয়া খবর।
মন্দিরে হামলার ভুয়া খবর
বিশ্ব গণমাধ্যমে বাংলাদেশ গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই বেশ আলোচনায় রয়েছে। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সম্প্রতি দেশটিতে বড় ধরনের বিক্ষোভ হতে দেখা গেছে, যার ফলে সরকারের পতন ঘটেছে এবং দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট পালিয়ে ভারতে চলে গেছেন।
আন্দোলন চলাকালে সহিংসতায় বাংলাদেশের চার শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলটির নেতাকর্মীদের অনেকে হামলার শিকার হয়েছেন, যাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম উভয়ই রয়েছেন।
কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের অতি ডানপন্থি দলের নেতাকর্মীরা এসব হামলার ঘটনাকে রাজনৈতিক না রেখে সাম্প্রদায়িক রঙ দেয়ার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন বলে মনে করেন ফ্যাক্ট চেকাররা।
ভাইরাল হওয়া একটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে ‘বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা’ একটা মন্দিরে হামলা চালিয়েছে।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ভিডিওটি আসলে চট্টগ্রামের। সেখানে ‘নবগ্রহ মন্দিরে’র পেছনে অবস্থিত আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা হয়।
বিবিসি ভেরিফাইয়ের হাতে ওই ঘটনার কিছু ছবি এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, হামলার সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের ছবিসহ বেশ কিছু পোস্টার পোড়ানো হয়েছে।
মন্দিরের কর্মকর্তা স্বপন দাস জানান, গত ৫ আগস্ট দুপুরে আওয়ামী লীগের ওই কার্যালয়ে হামলা হয়। ওই সময় কার্যালয়ের চেয়ার-টেবিল বাইরে বের করে এনে আগুন লাগানো হয়েছিলো।
ওই ঘটনায় মন্দিরের কোনো ক্ষতি হয়নি বলে জানান স্বপন। তিনি আরো জানান, মন্দিরের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেজন্য ২৪ ঘণ্টাই মন্দিরটি পাহারা দেয়া হচ্ছে।
অথচ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর শিরোনাম দিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিওটি ছড়ানো হচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণকারী অ্যাপ ‘ব্র্যান্ডওয়াচ’ বলছে, ভিডিওটি প্রায় একই ধরনের হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায় ১০ লাখ বার মেনশন করা হয়েছে।
এক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ভিডিওটি সবচেয়ে বেশি শেয়ার করা হয়েছে ভারত থেকে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আরেকটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে, বাংলাদেশের ‘হিন্দু ক্রিকেটার’ লিটন দাসের বাড়িতে আগুন দেয়া হয়েছে।
পোস্টে লেখা হয়েছে, ‘কট্টর ইসলামপন্থীরা’ বাড়িটিতে আগুন দিয়েছে।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখা যাচ্ছে, পোস্টের বাড়িটি ক্রিকেটার লিটন দাসের নয়, বরং বাংলাদেশের জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক ও আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য মাশরাফী বিন মর্তুজা।
ভারতে যারা এসব পোস্ট শেয়ার করছেন, তাদের অনেকেই উগ্র ডানপন্থি এবং হিন্দু জাতীয়তাবাদের সমর্থক।
ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বব্যাপী
বাংলাদেশের মুসলমানদের নাম জড়িয়ে বিভ্রান্তিকর ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর এমন ঘটনা এখন ভারতের বাইরে এমনকি যুক্তরাজ্যেও ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’ এ (সাবেক টুইটার) টমি রবিনসন নামে অ্যাকাউন্ট চালানো উগ্র ডানপন্থার সমর্থক স্টিফেন ইয়াক্সলি-লেনন যাচাই না করেই এমন একটি ভিডিও শেয়ার করেছেন।
এর শিরোনামে ইয়াক্সলি-লেনন ‘হিন্দু গণহত্যা’ শব্দটি উল্লেখ করেন।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী একজন নারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে তার স্বামীর জীবন বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছেন।
পোস্টে দাবি করা হয়েছে, ‘ইসলামপন্থীরা’ হামলা করার পর ওই নারী এমন আকুতি জানিয়েছেন। কিন্তু যাচাই করে গিয়ে বিবিসি পুরোপুরি ভিন্ন একটি ঘটনা পেয়েছে।
মূল ভিডিওটি আগস্টের ৬ তারিখে প্রকাশ করা হয়। এরপর স্থানীয় শিক্ষার্থীদের একটি দল ওই নারীকে সাহায্য করতে গিয়েছিল।
তারা বিবিসিকে জানিয়েছে, ভিন্ন একটি বিরোধের জেরে ঘটনাটি ঘটেছে এবং সেটার সাথে ‘ইসলামপন্থিদের’ কোনো সম্পর্ক নেই।
ঘটনাস্থল ঘুরে এসে বিবিসিকে এক শিক্ষার্থী জানান, ‘জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধের কারণে ঘটনাটি ঘটে। বিষয়টি নিয়ে অনেক আগেই একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল।’
প্রায় ৬ মাস ধরে স্থানীয় আদালতে জমির মালিকানা নিয়ে মামলাটি চলছে বলেও জানান তিনি।
বিবিসিকে শিক্ষার্থীরা আরো বেশকিছু ছবি এবং ভিডিও দিয়েছে, যাতে দেখা যাচ্ছে বাড়িটির ভিতরে অবস্থিত মন্দিরটি অক্ষত রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে বিবিসি। তারাও জানিয়েছে, হামলার ঘটনাটি ধর্মীয় কারণে হয়নি।
তারা আরো জানিয়েছে, বাংলাদেশের সরকার পতনের ঘটনায় তাদের এলাকার কোনো হিন্দু পরিবার বা মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেনি।
অথচ ‘এক্স’ (সাবেক টুইটার) এ টমি রবিনসন অ্যাকাউন্ট থেকে ‘বিভ্রান্তিকর’ শিরোনাম দিয়ে ভিডিওটি পোস্ট করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে তার সাথে যোগাযোগ করা হলেও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
যুক্তরাজ্যের সহিংসতার সময় ওই একই অ্যাকাউন্ট থেকে অভিবাসী এবং মুসলমানদের লক্ষ্য করে ‘উসকানিমূলক পোস্ট’ করা হয়েছিল, যা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল।
তবে এর মানে এই নয় যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো হামলার হয়নি।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ নামে দু’টি সংগঠন দাবি করেছে, শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের অর্ধশতাধিক জেলায় সংখ্যালঘু মানুষের ওপর দুই শতাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে।
তবে এসব হামলার ঘটনার জেরে ভুয়া খবর বা গুজব ছড়ানোর ঘটনাও বেড়েছে।
বাংলাদেশে বার্তাসংস্থা এএফপির ফ্যাক্ট-চেকার কদরউদ্দিন শিশির বলেন, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর রাজনৈতিক কারণে হওয়া হামলাগুলোকে ভারতের ডানপন্থি সমর্থকরা ‘ধর্মীয়’ হিসেবে ছড়াচ্ছে।
সংখ্যালঘুদের সংগঠন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের হিসেবে, সরকার পতনের পর অন্তত পাঁচজন হিন্দু নিহত হওয়ার খবর তারা পেয়েছেন, যাদের মধ্যে দু’জন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
আর বার্তাসংস্থা এএফপি জানিয়েছে, সহিংসতায় আওয়ামী লীগের ৫০ জনেরও বেশি মুসলিম নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন।
মুসলমানরাই পাহারা দিচ্ছে মন্দির
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে যখন ভুয়া খবর বেশি ছড়ানো হচ্ছে, তখন বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, অনেক এলাকায় মুসলমান শিক্ষার্থীরাই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উপাসনালয় পাহারা দিচ্ছেন।
যারা এই কাজ করছেন, তাদেরই একজন চট্টগ্রামের শিক্ষার্থী মইনুল।
বিবিসির তথ্য যাচাই বিভাগ ‘বিবিসি ভেরিফাই’ যখন তার সাথে যোগাযোগ করে, তিনি তার আগে চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে ‘শ্রী শ্রী সীতা কালী মাতা মন্দির’ পাহারা দিচ্ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব তো আমাদের। আমরা সব সরকারি স্থাপনা, মন্দির, গির্জা- সব কিছুই রক্ষা করব।’
তার কথায়, যেসব পোস্ট ছড়াচ্ছে, সেগুলো কিন্তু ‘আমাদের চোখে দেখা বাস্তব ছবির সাথে মিলছে না। ওই সব পোস্ট বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল হিসেবে তুলে ধরছে।’
বিক্ষোভকারীদের ওপরে ব্যাপক নির্যাতন ও হত্যার শেষে যখন শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালেন, বিক্ষোভকারী ও বিরোধী দলীয় সদস্যদের ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠা খুব আশ্চর্যের কিছু ছিল না।
অন্যদিকে, থানাগুলোতে আক্রমণ হওয়ার ফলে পুলিশ ছিল না পুরো বাংলাদেশেই। এই সময়েই সাবেক ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘরে লুট চলে, সহিংসতা শুরু হয়।
তবে বাস্তবে দেখা গেছে, যে সাধারণ নাগরিকদের বাড়িতেও লুট চলেছে, তাদেরও কেউ কেউ সহিংসতার শিকার হয়েছেন।
সংখ্যালঘুসহ সকল নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ শুরু করেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের নতুন সরকার।
তথ্য সহায়তা : জয় চেথাম, কুমার মালহোত্রা