গণমাধ্যমের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় সংস্কার দাবি সাংবাদিকদের
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৪০ পিএম
আজ শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ‘গণমাধ্যম সংস্কার উদ্যোগ’ ব্যানারে আয়োজিত মতবিনিময় সভা
ক্ষমতাশালী শ্রেণির প্রভাবমুক্ত সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন সর্বস্তরের সাংবাদিকরা। আজ শনিবার (১৭ আগস্ট) বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘গণমাধ্যম সংস্কার উদ্যোগ’ ব্যানারে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় এসব দাবি জানান সাংবাদিকেরা।
সভা পরিচালনা করেন সাংবাদিক আরিফুল সাজ্জাদ ও আহমেদ ফয়েজ। সভায় সাংবাদিকরা একটি মুক্ত, স্বাধীন ও শক্তিশালী গণমাধ্যমের জন্য নির্দলীয় প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একমত পোষণ করেন।
মতবিনিময় সভায় সাংবাদিকেরা বলেন, করপোরেট মালিকদের স্বার্থরক্ষা ও রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তিমূলক সাংবাদিকতা পেশাদার গণমাধ্যমকর্মীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করার পাশাপাশি গণমাধ্যমকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এছাড়া এ সংকট কাটাতে গণমাধ্যমের সামষ্টিক চরিত্র পালটে জনবান্ধবমুখী করার দাবিও জানান তারা।
সভায় লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, সাম্প্রতিক রাষ্ট্রীয় গণহত্যায় গণমাধ্যম কোনোভাবেই তার দায় এড়াতে পারে না। সেজন্য এখন আমাদের প্রচণ্ড রকমের আত্মসমালোচনা দরকার। সাংবাদিকতায় এখন তিনটি অভ্যুত্থান দরকার উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘প্রথমত করপোরেট ইন্ডাস্ট্রির বিরুদ্ধে, দ্বিতীয়ত দলীয় সাংবাদিক ইউনিয়ন ও প্রেস ক্লাবের বিরুদ্ধে এবং তৃতীয়ত নিজেদের লোভ ও পক্ষপাতের বিরুদ্ধে আমাদের অভ্যুত্থান দরকার।’
সিনিয়র সাংবাদিক খায়রুজ্জামান কামাল নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় সংকট করপোরেট মালিকানা। এই ব্যবস্থার পরিবর্তন না করতে পারলে গণমাধ্যমকর্মীদের অর্থনৈতিক মুক্তিসহ আমরা যে জনবান্ধব গণমাধ্যম দেখতে চাই, সেটি কঠিন হয়ে পড়বে।’ দল মতের বাইরে পেশাদার সাংবাদিকদের নিয়ে একটি শক্তিশালী সংগঠন তৈরির ওপর জোর দেন তিনি।
সভায় আরেক সিনিয়র সাংবাদিক সেলিম সামাদ বলেন, ‘সাংবাদিকরা নিজেদের কর্মক্ষেত্রেই আজ সবচেয়ে বড় পরাধীন। সাংবাদিকদের হুটহাট কেন চাকরি যায় তার বিরুদ্ধে শক্ত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।’
দ্যা ডেইলি স্টারের সিনিয়র সাংবাদিক বাহরাম বলেন, ‘রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ গণমাধ্যম। সেই গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় আমাদের যা করণীয় করতে হবে। অপেশাদার, রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিমূলক সাংবাদিকতা আস্তাকুঁড় নিক্ষেপ করতে হবে। এজন্য আমাদের একদফা দাবি গণমাধ্যমে ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে।’
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডের বাংলাদেশ প্রতিনিধি কামরুজ্জামান বাবলু বলেন, ‘আমাদের সিনিয়র সাংবাদিকদের অনেকে এতোটাই ক্ষমতার লোভ ও স্বার্থের কাছে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে, যে তাদের দিয়ে আর কোনো পরিবর্তন আশা করা যায় না। সাংবাদিকতাকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় পেশা হিসেবে তুলে ধরতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে।’
মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য দেন, একাত্তর টেলিভিশনের শাহনাজ শারমিন, নিউ এইজের মঈনুল হক, মাইটিভির মাহবুব সৈকত, কালবেলার জুনাইদ শিশির, সাংবাদিক মিজানুর রহমান কবির, নিউজ ২৪ এর হোসাইন শাহদাৎ ও দ্যা বিজনেস পোস্টের আশরাফুল ইসলাম রানা।
সভায় গণমাধ্যমের ব্যাপক সংস্কারকল্পে ১৩ দফা দাবি তুলে ধরেন সাংবাদিকেরা।
দাবিগুলো হলো-
* ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় নিহত সাংবাদিকদের হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
* ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে ঘিরে আহত-নিহত গণমাধ্যমকর্মী ও আক্রান্ত গণমাধ্যমকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সব বন্ধ গণমাধ্যম অনতিবিলম্বে খুলে দিতে হবে।
* গণমাধ্যমের যেসব মালিক ও নির্বাহীরা গণমাধ্যমকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে তৈরি করেছে, তদন্ত সাপেক্ষ তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
* গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য অভিন্ন ওয়েজবোর্ড প্রণয়ন করতে হবে। অনতিবিলম্বে নবম ওয়েজ বোর্ড বাস্তবায়ন করতে হবে। যারা অষ্টম ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করেছে বলে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে কিন্তু বাস্তবে বাস্তবায়ন করেনি তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে হবে।
* শ্রম আইন অনুযায়ী লভ্যাংশ বণ্টন করতে হবে।
* উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অগণতান্ত্রিক উপায়ে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের দখলদারিত্বের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
* গণমাধ্যম কর্মীদের সর্বস্তরের ভয়ভীতি দেখানো বন্ধ করতে হবে। গণমাধ্যম পরিচালনা সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ এবং সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনে সরকার ও বিশেষ সংস্থার নির্দেশনা, নিয়ন্ত্রণ প্রবণতা চিরতরে বন্ধ করতে হবে।
* গণমাধ্যম পরিচালনার ধরনসহ সার্বিক বিষয়ে সংস্কারের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিশন গঠন করতে হবে।
* গণমাধ্যম ও স্বাধীন মত প্রকাশে বিরোধী নিবর্তনমূলক আইনের সব ধারা বাতিল করতে হবে।
* আইসিটি, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও সাইবার সিকিউরিটি আইনের অধীনে গণমাধ্যমকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সব মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
* সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাসহ সব হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
* বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের গুম, নির্যাতন ও হয়রানির সঙ্গে জড়িতদের বিচার করতে হবে।
* সব গণমাধ্যম যেন গণমানুষের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করতে পারে সেই নিশ্চয়তার বিধান করতে হবে।