রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখ্যান করে ফেসবুকে প্রতিবাদের ঝড়
আন্দোলনকারীদের সমর্থনে দেওয়া একটি প্রোফাইল ছবি।
কোটা আন্দোলনে নিহতের স্মরণে দেশব্যাপী শোক কর্মসূচি দিয়েছিল সরকার। সেই কর্মসূচি প্রত্যাখ্যান করে লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তুলে এবং অনলাইনে তা ব্যাপক প্রচারের কর্মসূচি দেয় আন্দোলনকারীরা।
আজ মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) ভোর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক ব্যবহার করেন এবং কৌশলে ফেসবুকে ঢুকতে পারছেন এমন হাজার হাজার মানুষ আন্দোলনকারীদের সমর্থনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের প্রোফাইল পিকচার লাল রঙে রাঙাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার বলছেন, এই লাল মানে সরকারকে লাল কার্ড দেখানো।
নিজেরা প্রোফাইলের ছবি পরিবর্তন করেই থেমে থাকেননি, অনেকে আবার আন্দোলনকারীদের এই কর্মসূচি সফলে সর্বস্তরের মানুষকে আহ্বান জানাচ্ছেন। কবিতা, গ্রাফিতি ও পোস্টার আঁকাসহ নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অনেক কবি, শিল্পী, সাংবাদিক, সাহিত্যিক আন্দোলনকারীদের সমর্থন জানাচ্ছেন।
এদিকে, আজকেও রাজধানী ঢাকার আকাশে হেলিকপ্টার টলহ দিতে দেখা গেছে। ঢাকায় সকাল ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল আছে। সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে সেনসদস্য, বিজিবি টহল দিচ্ছে। এছাড়া, ঢাকার অলি-গলিতে অতিরিক্ত পুলিশ সদস্যরা অবস্থান করছেন।
এর আগে গতকাল সোমবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন সমন্বয়ক মো. মাহিন সরকার। কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় শোক প্রত্যাখান করে মঙ্গলবার লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তুলে এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রচারের আহ্বান করা হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে সারাদেশের শিক্ষক, পেশাজীবী, শ্রমজীবী ও সকল নাগরিককে তাদের কর্মসূচি পালনে সর্বাত্মক সহযোগিতা ও দাবি আদায়ের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সোমবার ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, সিলেট, নোয়াখালী, রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, যশোর, ঠাকুরগাঁও সহ সারাদেশব্যপী আজকের কর্মসূচি বিক্ষোভ ও ছাত্রসমাবেশ সফল করার জন্য সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি। একই সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবিসমূহের সাথে সংহতি প্রকাশ করার জন্য শিক্ষক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী, শ্রমজীবী ও গণমানুষের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা।
আরও বলা হয়, চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে দেশজুড়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিকে কেন্দ্র করে নির্বিচারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে শত শত শিক্ষার্থীর মৃত্যু ও হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আহত হয়ে যখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে তখনও শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে না নিয়ে একাত্তরের হানাদার বাহিনীর মতো মধ্য রাতে বাসা বাড়িতে রেইড ব্লকের মাধ্যমে নিরপরাধ শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে রিমান্ডের নামে মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বর নির্যাতন চালানো হচ্ছে।
এমতাবস্থায় বর্তমান সরকারের কর্তাব্যক্তিরা সংকট নিরসনে শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে না নিয়ে প্রতিদিনই নির্মমভাবে শিক্ষার্থীদের দমন নিপীড়ন ও মানুষের জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় সম্পদকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ায় প্রচার করছে এবং মিডিয়ার সামনে দেওয়া সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মায়া কান্না প্রচার করছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের বিচার না করে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে প্রতিদিন যে নির্মম উপহাস করা হচ্ছে। তার প্রতিবাদে শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে রাষ্ট্রীয় শোককে প্রত্যাখান করে আগামীকাল লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তুলা এবং অনলাইনে ব্যাপক প্রচার কর্মসূচি করার জন্য অনুরোধ করছি।
বাংলাদেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল,মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও দেশের আপামর জনসাধারণের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি, একটি নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে আপনারা আগামীকালের কর্মসূচি সফলে সহযোগিতা করুন। সকলেই একক বা ঐক্যবদ্ধভাবে লাল কাপড় মুখে ও চোখে বেঁধে ছবি তুলে এবং অনলাইনে প্রচার কর্মসূচি পালন করুন।
আরও বলা হয়, আমরা সরকারের উদ্দেশ্যে বলতে চাই, ছাত্রসমাজের বুকে গুলি চালিয়ে বাংলার ইতিহাসে কোনো আন্দোলন দমন করা যায়নি। অবিলম্বে ছাত্রসমাজের নয় দফা দাবি মেনে নিয়ে দেশকে স্থিতিশীল করুন।
শিক্ষার্থীদের দাবি সমূহ,
১। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে জাতির কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।
২। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দলীয় ক্যাডার এবং সন্ত্রাসী কর্তৃক ছাত্র-নাগরিক হত্যার দায় নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে মন্ত্রীপরিষদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। ইন্টারনেট শাটডাউন করে দেশে ডিজিটাল ক্র্যাকডাউন করায় তথ্য প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলককে পদত্যাগ করতে হবে। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় শহীদ শিক্ষার্থী এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদেরকে ড্রাগ অ্যাডিক্ট বলে কুরুচিপূর্ণ ও মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে এবং আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করায় তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাতকে পদত্যাগ করতে হবে।
৩। ঢাকাসহ যত জায়গায় ছাত্র-নাগরিক শহীদ হয়েছে সেখানকার ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও পুলিশ সুপারদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করতে হবে।
৪। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে ক্যাম্পাসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে হামলা হয়েছে, প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং প্রক্টরদেরকে পদত্যাগ করতে হবে।
৫। যে পুলিশ-বিজিবি-র্যাব ও সেনা সদস্যরা শিক্ষার্থীদের উপর গুলি করেছে, ছাত্রলীগ-যুবলীগসহ যে সকল সন্ত্রাসীরা শিক্ষার্থীদের উপর নৃশংস হামলা পরিচালনা করেছে এবং যেসকল নির্বাহী মেজিস্ট্রেট পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদেরকে নিরস্ত্র ছাত্র-নাগরিকদের উপর গুলি করার নির্দেশ দিয়েছে তাদেরকে আটক করে হত্যা মামলা দায়ের করতে হবে ও দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করতে হবে।
৬। দেশব্যাপী যেসকল ছাত্র-নাগরিক শহীদ এবং আহত হয়েছে তাদের পরিবারকে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযথ ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে।
৭। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নামক সন্ত্রাসী সংগঠনসহ সকল দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে দ্রুততম সময়ে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ছাত্র সংসদ কার্যকর করতে হবে
৮। অবিলম্বে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হলগুলো খুলে দিতে হবে। কারফিউ তুলে নিয়ে সারাদেশের সমস্ত ক্যাম্পাসে মোতায়েনকৃত পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, সোয়াট এবং আর্মি তুলে নিতে হবে।
৯। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কোনো ধরনের হয়রানি করা হবে না এই মর্মে অঙ্গীকার করতে হবে। ইতিমধ্যে গণগ্রেফতার ও পুলিশি হয়রানির শিকার সমন্বয়কবৃন্দ ও ছাত্র-নাগরিকদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে ও সকল মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।