চট্টগ্রামে সংঘর্ষের ঘটনায় ২৭ মামলা
ধরা ছোঁয়ার বাইরে সেই ৮ অস্ত্রধারী
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৬ জুলাই ২০২৪, ০৬:১১ পিএম
চট্টগ্রামে কোটা আন্দোলনে ঘিরে সংঘর্ষের ঘটনায় গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অন্তত ১ হাজার আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। ওইসব সংঘর্ষের ঘটনায় মামলা করা হয়েছে ২৭টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩০ হাজারের বেশি মানুষকে। তবে চট্টগ্রামে ৫ শিক্ষার্থী ও এক শ্রমিক নিহতের ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করা হয়নি। আবার আন্দোলনে পুলিশের সামনে অস্ত্র ব্যবহার করা ৮ অস্ত্রধারীর কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মামলায় বেশিরভাগই আসামি অজ্ঞাত হিসেবে দেখানো হয়েছে। যাদের গ্রেপ্তার হচ্ছে তাঁদের বেশিরভাগই বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, জামায়াত, শিবিরসহ বাম সংগঠনের নেতা-কর্মী। পুলিশের দাবি করছে, ঘটনার সময় সিসিটিভি ফুটেজে পাওয়াসহ বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে আসামিদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
সরেজমিনে ও তথ্য নিয়ে জানা গেছে, ১৬ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ হয়। এছাড়া ১৮ জুলাই নগরের বহদ্দারহাটে সংঘর্ষ হয়। এ সময় ৫ শিক্ষার্থী ও এক শ্রমিক নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। এরমধ্যে অধিকাংশ গুলিবিদ্ধ হন।
এরমধ্যে ১৬ জুলাই নগরের মুরাদপুরে নিহত হন তিনজন। তারা হলেন চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরাম, চট্টগ্রাম নগরের ওমরগণি এমইএস কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মো. ফয়সাল আহমেদ শান্ত ও ফার্নিচারের দোকানের কর্মচারি পথচারী ফারুক।
এদিকে ১৮ জুলাই বহদ্দারহাটে সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। তাঁরা হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হৃদয় চন্দ্র তরুয়া, আশেকানিয়া ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগের ছাত্র তানভীর আহমেদ (১৯) ও সন্দ্বীপের হারামিয়া ইউনিয়নের বিধবা রহিমা বেগমের ছোট ছেলে সাইমন হোসেন (১৯)।
আন্দোলনকারীদের ওপর আট অস্ত্রধারীর গুলি:
কোটা আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা সারা দেশে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই বেলা ৩টার দিকে চট্টগ্রামের মুরাদপুরে জড়ো হন। বেলা সাড়ে ৩টার দিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা-কর্মীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হন। এ সময় সংঘর্ষের মধ্যে শিক্ষার্থীদের মিছিল লক্ষ্য করে চার ব্যক্তিকে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। তাতে তিনজন নিহত হন। আহত হন অন্তত ৩০ জন।
গুলি করা সেই চার ব্যক্তির মধ্যে একজন মো. ফিরোজ। তিনি মহানগর যুবলীগের কর্মী। অন্যজন মো. দেলোয়ার স্বেচ্ছাসেবক লীগের সংগঠক। ফিরোজ রিভলবার নিয়ে এবং দেলোয়ার শটগান নিয়ে গুলি করেন। বাকি দুজন এইচ এম মিঠু ও মো. জাফর। তাঁরা দুজনও যুবলীগের কর্মী বলে জানা গেছে। তাঁদের রিভলবার নিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে।
এদিকে ১৮ জুলাই সরেজমিন দেখা যায়, দুপুর থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বহদ্দারহাট মোড়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন চার অস্ত্রধারী। হামলাকারীরা সরকারদলীয় স্লোগান দিয়েছেন। বেশ কয়েকটি গ্রুপ ছাত্রদের ওপর হামলা করেছেন। কালো টি শার্ট ও নীল গেঞ্জি পরা দুজনকে একটি শটগান দিয়ে গুলি করতে দেখা গেছে।
বহদ্দারহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের সামনে একটি গ্রুপ থেকে ওই দুজন গুলি ছোড়েন। আরও দুজন রিভলবার দিয়ে গুলি করেছেন। এর মধ্যে হেলমেট ও সাদা গেঞ্জি পরা একজন রিভলবার দিয়ে গুলি ছুড়েছেন। তিনি চান্দগাঁও থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মহিউদ্দিন ফরহাদ। তাঁর সঙ্গে আরও একজন রিয়াল মাদ্রিদের গেঞ্জি-ক্যাপ ও মুখোশ পরে রিভলবার দিয়ে গুলি ছুড়েছেন। তিনি মো. জালাল। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। অন্যজনের পরিচয় পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে মহানগর যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক দিদারুল আলম অস্ত্রধারীদের নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। এখন পর্যন্ত এই আট অস্ত্রধারীর বিরুদ্ধে কোনো মামলা হয়নি। গ্রেপ্তার বা অস্ত্রও উদ্ধার হয়নি।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) কাজী মো. তারেক আজিজ বলেন, এখন পর্যন্ত চট্টগ্রাম নগরীতে সহিংসতার অভিযোগে করা মামলায় ৩৭৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৬ জনকে। চট্টগ্রাম নগরীতে হওয়া ১৬টি মামলায় তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আবু তৈয়ব মো. আরিফ বলেন, কোটা আন্দোলন নিয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় চট্টগ্রাম জেলার ১০টি থানায় ১১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় এখন পর্যন্ত ৩৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মী বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি নেতা মো. ইদ্রিস আলী বলেন, আন্দোলনের সঙ্গে বিএনপি কোনোভাবেই যুক্ত ছিল না। আন্দোলনটি ছাত্রদের ছিল। তবে পুলিশ গত ১৬ জুলাই থেকে বিএনপি, যুবদল, কৃষক দলের ৩১০ জন নেতা-কর্মীকে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করেছে। হয়রানির উদ্দেশ্যে আমাদের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।
সর্বশেষ গত বুধবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তছলিম উদ্দিন জানান, হাসপাতালে সংঘর্ষে আহত ২০৮ চিকিৎসা নিয়েছেন। বর্তমানে ১৬ জন ভর্তি রয়েছেন। এদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
সূত্র: আজকের পত্রিকা