গড়েছেন সম্পদের পাহাড়
স্ত্রীকে ৫টি জাহাজ কিনে দিয়েছেন চট্টগ্রামের পুলিশ কর্মকর্তা
মোহাম্মদ কামরুল হাসান। ছবি: সংগৃহীত।
১৯৮৯ সালের ১০ জানুয়ারি উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে পুলিশে যোগ দেন মোহাম্মদ কামরুল হাসান। এই কর্মকর্তা এখন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ক্রাইম)। এরমধ্যে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন।
বিলাসবহুল বাড়ি, গাড়িসহ কি নেই তার ধন ভাণ্ডারে। শুধু নিজের নয়, স্ত্রীর জন্যও করেছেন অঢেল সম্পদ। এরমধ্যে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কিছু অবৈধ সম্পদের ফিরিস্তি। যেখানে বলা হয়েছে, তিনি স্ত্রী সায়রা বেগমকে ৫টি জাহাজও (বার্জ) কিনে দিয়েছেন। দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এসব সম্পদ ক্রোকের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দেশের ট্যাবলয়েড মানবজমিন এই খবর প্রকাশ করেছে।
জানা যায়, পুলিশে ইন্সপেক্টর পদে পদোন্নতি পেয়ে চট্টগ্রামের ৮টি থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপালন করেন নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা কামরুল। মূলত ওই সময়েই বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হন তিনি। এরমধ্যে নিজের ও স্ত্রীর নামে করা ১৯ কোটি টাকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির বিষয় প্রকাশ্যে এসেছে।
দুদকের অনুসন্ধানে কামরুল হাসানের ১২ কোটি ৭২ লাখ ৯২ হাজার ৬৯৫ টাকার স্থাবর ও ১ কোটি ২৩ লাখ ৩৯ হাজার ২১৬ টাকার অস্থাবর সম্পত্তি থাকার তথ্য উঠে এসেছে।
এ ছাড়া একই সময়ে তার মোট ৭০ লাখ ২৮ হাজার ২৪১ টাকা পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়ের তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ১৪ কোটি ৬৬ লাখ ৬০ হাজার ১৫২ টাকার। উক্ত সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তার গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া গেছে ৪ কোটি ৮০ লাখ ৩২ হাজার ৮৭ টাকা। এক্ষেত্রে তার অর্জিত সম্পদের চেয়ে তার বৈধ আয়ের উৎস ৯ কোটি ৮৬ লাখ ২৮ হাজার ৬৫ টাকা কম।
এদিকে, দৃশ্যত কোনো আয় না থাকলেও কামরুল হাসানের স্ত্রী সায়মা বেগমের ২ কোটি ৫৩ হাজার ২৪০ টাকার সম্পদ থাকার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। সায়মা বেগমের ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার স্থাবর ও ১ কোটি ৯৯ লাখ ২৮ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ আছে। একই সময়ে তার মোট ৩১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৫৫ টাকা পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়ের তথ্য পাওয়া যায়। অর্থাৎ পারিবারিক ও অন্যান্য ব্যয়সহ তার মোট অর্জিত সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ২ লাখ ৯৯ হাজার ৬২১ টাকা। ওই সম্পদ অর্জনের বিপরীতে তার বৈধ ও গ্রহণযোগ্য আয়ের উৎস পাওয়া যায় ৪০ লাখ ১৪ হাজার ৪৩৩ টাকা। বাকি সম্পদ জ্ঞাত আয়ের উৎস বহির্ভূত অর্জনের তথ্য রেকর্ডপত্রদৃষ্টে পাওয়া যায়।
দুদক সূত্রে জানা যায়, সিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কামরুলের চট্টগ্রাম নগরের সবচেয়ে অভিজাত খুলশী আবাসিক এলাকায় ‘ফয়জুন ভিস্তা’ অ্যাপার্টমেন্টের অষ্টমতলায় সি-৭ নামে ২ হাজার ৫৭০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ও ১৩৬ বর্গফুটের গাড়ি পার্কিং রয়েছে।
সোয়া সাত লাখ টাকায় ফ্ল্যাট ও মাত্র ২৫ হাজার টাকায় পার্কিং স্পেস কিনেছেন আয়কর নথিতে দাবি করলেও খুলশীতে আড়াই হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটের বর্তমান বাজারমূল্য তিন কোটি টাকার বেশি।
চট্টগ্রাম নগরের পশ্চিম নাসিরাবাদে সাত শতক জমির উপর চারতলাবিশিষ্ট বাড়ি করেছেন কামরুল। জমিসহ এই ভবন নির্মাণে ১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা খরচ দেখালেও নাসিরাবাদ এলাকায় এক শতক ভূমিই এক কোটি টাকার বেশি মূল্যে কেনাবেচা হচ্ছে। সেই হিসাবে ভূমি ও ভবনের বাজারমূল্য কমপক্ষে ৮ কোটি টাকা।
ঢাকার সাভারে ১০৭ শতক জায়গার উপর সাভার সিটি সেন্টার নামে ১২ তলা ভবনের চারজন অংশীদারের একজন এডিসি কামরুল। সেখানে তিনি কাগজ-কলমে সাত কোটি ৫২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন। এ ভবনের বেজমেন্টে ৯০টি, প্রথমতলায় ১৪০টি, দ্বিতীয় তলায় ১৪৬টি, তৃতীয়তলায় ৮৯টি ও চতুর্থ তলায় ১০৩টি দোকান এবং ৫ হাজার বর্গফুটের ফুডকোর্ট, পঞ্চম তলায় অফিস ও ষষ্ঠতলায় ৬৭টি ফ্ল্যাট রয়েছে। বাজারমূল্যে এ সম্পদের মূল্য শতকোটি টাকারও বেশি। এছাড়া, সাভার সিটি টাওয়ার নামে একটি ১০ তলা আবাসিক ভবনেরও অংশীদার কামরুল। সেখানে ৫৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে।
এদিকে, চট্টগ্রাম নগরের উত্তর হালিশহর, নাসিরাবাদ, চান্দগাঁও এলাকা শতাধিক ফ্ল্যাট ও দোকান রয়েছে কামরুলের। চট্টগ্রাম ও ঢাকার সাভারে ১৫৪ শতক জমি ও দুটি বাড়ি রয়েছে তার। পাশাপাশি কামরুলের ব্যাংকে ১ কোটি ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকার বন্ড ও এফডিআর থাকার তথ্য উঠে এসেছে দুদকের অনুসন্ধানে।
জানা যায়, কামরুল হাসান স্ত্রী সায়মা বেগমের নামে সওদাগর নেভিগেশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে দিয়েছেন। এটির অফিস নগরের আগ্রাবাদের পোর্টল্যান্ড সাত্তার টাওয়ারের ৪র্থ তলায়। ৫টি ছোট জাহাজের এক তৃতীয়াংশের মালিক এই সওদাগর নেভিগেশন। এদের মধ্যে চারটির নাম জানা গেছে। সেগুলো হলো এম.ভি প্যাসিফিক রাইডার, এম.ভি. পানামা ফরেস্ট-০১, এম.ভি. রাইসা তারাননুম, বার্জ আল বাইয়েত। এই জাহাজগুলোতে কাগজে কলমে সায়মার ইনভেস্ট দেখানো হয়েছে দেড় কোটি টাকা। তবে বাস্তবে এটি ৩ থেকে চারগুণ বেশি বলে জানা গেছে।
জানা যায়, সায়মার চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরে ৪০ শতক নাল জমি রয়েছে। যেগুলোর ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে মাত্র ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। তবে বর্তমান বাজারে সেই জমির মূল্য ১২ থেকে ১৫ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকে তার নামে ৪৫ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র রয়েছে।
অবৈধ সম্পদের বিষয়ে জানতে এডিসি কামরুলকে বেশ কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে ক্ষুদে বার্তা দেওয়া হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।
এদিকে, দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ কর্মকর্তা কামরুল হাসান এবং তার স্ত্রীর স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। গত সোমবার চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ জেবুননেছার আদালত এই আদেশ দেন।
দুদক সূত্রে জানা যায়, চট্টগ্রামের অন্তত আরও ৪০ জন পুলিশ কর্মকর্তার অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, সহকারী কমিশনার পদমর্যাদার পাশাপাশি থানার ওসিসহ একাধিক উপ-পরিদর্শক। এদের বিরুদ্ধেও শিগগিরই ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।