Logo
Logo
×

সংবাদ

বেঁকে বসল চীন?

৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়ে ১ বিলিয়ন ইউয়ান পাচ্ছে বাংলাদেশ

Icon

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০২৪, ১০:৫১ পিএম

৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ চেয়ে ১ বিলিয়ন ইউয়ান পাচ্ছে বাংলাদেশ

বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যকার চুক্তি স্বাক্ষরের চিত্র। ছবি: সংগৃহীত

চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং আজ বুধবার (১০ জুলাই) বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সহায়তা হিসেবে ১ বিলিয়ন ইউয়ান দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ব্রিফিংকালে সাংবাদিকদের বিষয়টি জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয় চীন। চীনের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় এগিয়ে নেওয়ার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন।

এদিকে, চীন সফরের আগে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবরের বলা হয়েছিল, চীনের কাছে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের চীনা ইউয়ান ঋণ চাওয়া হবে। আর তা দিয়ে বাংলাদেশের রিজার্ভ সংকট সামাল দেয়া ছাড়াও চীন থেকে পণ্য আমদানি ব্যয় মেটাতে ব্যবহার করা হবে। 

এমনকি মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশে ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছিলেন,  ‘চীনা মুদ্রা ইউয়ানে ঋণ গ্রহণ করা হবে। রিজার্ভ সংকট সামাল দেয়া ছাড়াও চীন থেকে পণ্য আমদানি ব্যয় মেটাতেও ঋণের অর্থের ব্যবহার করা হবে। তবে ঋণের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।’ 

মাত্র এক সপ্তাহ আগেই তিনি আরও জানিয়ে ছিলেন, দুপক্ষের মধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে কারিগরি আলোচনাও হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেইজিং গেলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হবে।

এ ছাড়া, ঋণের বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে গত ৪ জুলাই ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানিয়ে ছিলেন, রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় চীনের কাছে বাংলাদেশ সহযোগিতা চেয়েছে। এই প্রথম রিজার্ভ সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ অন্য কোনো দেশ থেকে সহযোগিতা চাইল। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের মাধ্যমে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যেতে পারে।

সবকিছু ঠিকঠাক থাকা সত্বেও কোথায় গড়বড় হলো যে, চীন ৫ বিলিয়ন ডলারের জায়গায় ১ বিলিয়ন ইউয়ান দেবার ঘোষণা দিলো? শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সরকারি সফরে চীন গেলেও, সফর চলাকালেই একদিন আগে দেশে ফেরার কথা জানানো হয়। 

এদিকে, একদিন আগে চলে আসা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রেসসচিব ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবার দুই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাইমুল ইসলাম খান গণমাধ্যমকে জানান, একদিন আগে ফিরলেও নির্ধারিত সব কর্মসূচি শেষ করেই দেশে ফিরবেন প্রধানমন্ত্রী। 

ফেরার সময় এগিয়ে আনার কারণ হিসেবে নাইমুল ইসলাম খান বলেন, ‘সকালে আসলে একটা দিন চলে যায়, রাতে চলে আসলে দিনটা বেঁচে যায়।’

কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ আবার বলছেন ভিন্ন কথা। বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি একদিন আগে ফেরার কারণ হিসেবে বলছেন, একদিন আগে ফিরছেন কারণ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সফরসঙ্গী হিসেবে তার কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বেইজিং সফরের কথা ছিল। অসুস্থতার কারণে তিনি বেইজিং আসতে পারেননি। আমরা যেদিন বেইজিংয়ের উদ্দেশে রওনা করি, সেদিন সকালবেলা হঠাৎ করে সায়মা ওয়াজেদ অসুস্থ হয়ে পড়েন। ফলে তিনি আসতে পারেননি। তিনি এখনো অসুস্থ। কাজেই প্রধানমন্ত্রী সফর সংক্ষিপ্ত করেন, ওনার এখানে রাত যাপন করার কথা ছিল। এখন তিনি সেটা না করে মা হিসেবে অসুস্থ মেয়েকে সময় দেওয়ার জন্য চলে যাচ্ছেন।’

সিনহুয়ায় চীন-বাংলাদেশ সামরিক মহড়ার প্রসঙ্গে প্রকাশিত খবর।  

দুইজনের দুইরকম কথা শুনে সন্দেহ করাই স্বাভাবিক যে, ব্যাপারটাতে কোনো ধরনের ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা আছে। চীন সফরের ঠিক আগে আগে প্রধানমন্ত্রী ভারত সফর করেন। সেই সফরে তিনটি নবায়নসজ ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য বহুল আকাঙ্ক্ষিত তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বরং বাংলাদেশ তিস্তা নিয়ে যে প্রকল্প পরিকল্পনা করেছিল, চীন যেখানে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দেবার আগ্রহ প্রকাশ করেছিল সেটায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী খুব আগ্রহ দেখালেন। এমনকি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য প্রতিনিধি পাঠাবেন বলেও জানা যায়। 

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শেষেই বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল, তিস্তা প্রকল্পে চীনকে আর সঙ্গে নেবে না বাংলাদেশ। এ ছাড়া ভারতের নাকের ডগায় চীনের উপস্থিতি দেশটি মানবে না এটাও ছিল আলোচনার বিষয়। কথিত আছে, ভারতের নিরাপত্তা দিয়ে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকার সুষ্ঠু নির্বাচন না করেও শাসনে ক্লিয়ারেন্স পেয়ে যাচ্ছে।   

এদিকে, ভারত ও চীনের সঙ্গে এই সরকারের সম্পর্ক কেমন সেটা আরও কিছুটা পরিষ্কার হওয়া যায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেই। গত ৩ জুলাই রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হা‌সিনার চীন সফর নিয়ে ভারতের কখনো কোনো আপত্তি ছিল না।

তারও আগে গত এপ্রিলে হঠাৎ চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যম সিনহুয়া সূত্রে জানা যায়, প্রথমবার একসঙ্গে সামরিক মহড়া করবে চীন ও বাংলাদেশ। বলা হয়েছিল, গত মে মাসের গোড়ায় ওই যৌথ সামরিক মহড়ার আয়োজন করবে চীন ও বাংলাদেশ। 

এনিয়ে চীনের প্রতিরক্ষা বাহিনীর মুখপাত্র সিনিয়র কর্নেল উ কিয়ান তখন জানান, মে মাসে পিপলস লিবারেশন আর্মির একটি দল ঢাকায় যাচ্ছে। দুদেশের বাহিনী একসঙ্গে মহড়ায় অংশ নেবে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বেইজিং-ঢাকা সহযোগিতার পরিসর এবং ব্যবহারিক আদান-প্রদান বৃদ্ধি করার জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফর নিয়ে দ্য হিন্দুর সংবাদ। 

যৌথ ওই মহড়ার নামও দেওয়া হয়েছিল, ‘চীন-বাংলাদেশ গোল্ডেন ফ্রেন্ডশিপ ২০২৪’। আর এই মহড়ার খবরে প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছিল ভারত। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল গত ২৫ এপ্রিল দিল্লিতে সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে ওই মহড়ার খবর নিয়ে বলেছিলেন, এ সংক্রান্ত বিষয়ে আমরা বহুবার আমাদের কথা জানিয়েছি। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রে অথবা অন্য কোথাও সব ধরনের ঘটনার ওপর আমরা নজর রাখি। বিশেষ করে সেই ধরনের ঘটনা, যা আমাদের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার ওপর যা প্রভাব ফেলতে পারে। 

এ ধরনের বিষয়ে ভারত ‘প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ নিয়ে থাকে বলেও জানান ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র।

মে মাসের শুরুতে এই মহড়া হওয়ার কথা থাকলেও পরে তা হয়েছে কিনা এমন কোনো সংবাদ সংবাদমাধ্যমে পাওয়া যায়নি। কিংবা চীন বা বাংলাদেশের পক্ষেও কিছু বলা হয়নি। তবে গত ৮ মে দুদিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকও করেছিলেন। 

ওই দিনই ভারতের দ্য হিন্দু পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিনয় কোয়াত্রা বাংলাদেশে এ সফরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের বিষয়ে পর্যালোচনা করতে পারেন। কারণ চীনের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একটি পরিকল্পিত সামরিক মহড়া ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঢাকার একটি দৈনিক জানিয়েছে, বাংলাদেশের তিস্তা বরাবর চীনের পরিকল্পিত প্রকল্পটি পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার আসন্ন বাংলাদেশ সফরের সময় প্রদর্শিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এতে আরও বলা হয়, ভারত সতর্কতার সঙ্গে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ পরিকল্পনাকে দেখছে যার মধ্যে রয়েছে বহু মিলিয়ন ডলারের ড্রেজিং এবং উন্নয়ন প্রকল্প যা তিস্তাকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের একটি অঞ্চলে পরিণত করার কল্পনা করে। প্রকল্পটি ২০২০ সালে ফোকাসে এসেছিল এবং তখন থেকেই ভারতের জন্য উদ্বেগের। কারণ এটি কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শিলিগুড়ি করিডর এবং উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোর কাছাকাছি পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

ব্লুমবার্গে প্রকাশিত চীনের কাছে বাংলাদেশের ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ চাওয়ার সংবাদ।

এপ্রিলে চীনা পত্রিকার মাধ্যমে মে মাসের শুরুতে চীন-বাংলাদেশের যৌথ মহড়ার খবর প্রকাশ। এই খবরে ভারতের উদ্বেগ প্রকাশ। মে মাসের শুরুতে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফর। মহড়া অনুষ্ঠিত না হওয়া। তিস্তা প্রকল্পে চীনের আগ্রহের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর এবং এই প্রকল্পে হঠাৎ ভারতের আগ্রহী উঠা। চীন সফর নিয়ে ভারতের আপত্তি না থাকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তথ্য—সব মিলিয়ে তবে কি চীন বাংলাদেশ নিয়ে নতুন করে ভাবছে। আর সেই ভাবনা থেকেই সহজ শর্তে চাওয়া ৫ বিলিয়ন ডলার ঋণের জায়গায় মাত্র ১ বিলিয়ন দিচ্ছে? 

এ বিষয়ে চীনে বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক মুনশী ফয়েজ আহমেদ বলেছেন, ঢাকার পক্ষ থেকে দেনদরবারটা আরো জোরালো ভাবে করার প্রয়োজন ছিলো। তারপরও যেটা হয়েছে সেটিও ভালো হয়েছে। তারা ১ বিলিয়ন ইউয়ান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সামনের দিনগুলোতে হয়তো চীনা ঋণ আরো বাড়বে। তবে দেশের রিজার্ভ সঙ্কট মোকাবিলায় এখন ১ বিলিয়নও কম নয়। 

তিনি আরো বলেন, আমার দৃষ্টিতে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর ভালো হয়েছে। এটি প্রয়োজন ছিলো। তবে অনেকে এর সঙ্গে ভারতের প্রসঙ্গ টেনে আনছেন। আমি এর কোনো যৌক্তিকতা দেখি না। কেননা দেশটিতে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী সেখানে গিয়েছেন। আবার দ্বিপক্ষীয় সফরেও গিয়েছেন। সব মিলে তাদের সঙ্গে আমাদের অংশীদারিত্বের যায়গা আরো পোক্ত হয়েছে। এখন চীনের ভিজিটে দেশের বেশকিছু খাতে তাদের উন্নয়ন প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে এটি ইতিবাচক।   

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন