বিআরআই এবং আইসিএসএফের বিবৃতি
বাঙালি সম্পর্কে স্টারমার ও অ্যাশওয়ার্থের মন্তব্যের নিন্দা
স্কটল্যান্ডের ইস্ট কিলব্রাইডে নির্বাচনী প্রচারণা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন কিয়ার স্টারমার। ছবি: লেসলে মার্টিন/রয়টার্স
যুক্তরাজ্যের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে লক্ষ করে লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার ও জোনাথন অ্যাশওয়ার্থের নেতিবাচক মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে দুই প্রতিষ্ঠান—বিআরই (বাংলাদেশ রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ) এবং (আইসিএসএফ) ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম। গতকাল বুধবার যৌথ বিবৃতিতে তারা এই নিন্দা জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘যুক্তরাজ্যের বাঙালি জনগোষ্ঠীকে লক্ষ করে লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার এবং জোনাথন অ্যাশওয়ার্থের সাম্প্রতিক নেতিবাচক মন্তব্যে আমরা ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করছি। তাদের এহেন সংকীর্ণ মন্তব্য এমন একটি সম্প্রদায়কে আলাদাভাবে চিহ্নিত করেছে, যারা ব্রিটিশ সমাজ এবং তার অর্থনীতিতে, বিশেষত এর সরকারি সেবাগুলিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। উপরন্তু, আধুনিক ব্রিটেন অনেকাংশে গড়ে উঠেছে ঐতিহাসিক বাংলা অঞ্চল থেকে আহরিত সম্পদ দ্বারা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লাখো বাঙালি সেনা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অংশ হিসেবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছে। সেই সাথে নিজের জনগোষ্ঠীকে বিপদের মুখে রেখেও বাংলা বিপুল সম্পদ এবং খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে যুদ্ধে অবদান রেখেছে, যার ফলাফল ছিল একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ যা লক্ষ লক্ষ বাঙালির মৃত্যু ঘটিয়েছিল। ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের আট দশক পর, বর্তমান ব্রিটিশ রাজনৈতিক নেতৃত্বের মুখে সেই একই ধরনের ফ্যাসিবাদী বার্তা শুনতে পাওয়াটি প্রবলভাবে উদ্বেগজনক। স্টারমার এবং অ্যাশওয়ার্থের এই মন্তব্য তাদের নিজেদের ইতিহাসের ব্যাপারেই কৃতজ্ঞতাহীনতা এবং অজ্ঞতার পরিচায়ক।’
বাঙালি জনগোষ্ঠী ইতিহাসজুড়ে অমানবিক নৃশংসতা সহ্য করেছে, বিশেষত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে। ১৭৭০ সালে বাংলার মহা মন্বন্তর, যা প্রায় এক কোটি মানুষকে হত্যা করেছিল এবং ১৯৪৩ সালের মহা মন্বন্তর, যা ত্রিশ লক্ষের অধিক মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল—এগুলি সবই ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ নীতি দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়েছিল। একই সাথে, বাঙালি জনগোষ্ঠী নিজ মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হবার ইতিহাসও বহন করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত গণহত্যার ফলে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু বাঙালির কথা। এমনকি আধুনিক ব্রিটেনেও, বাঙালি জনসমাজ জাতিগত বৈষম্য ও সহিংসতার শিকার হয়েছে (আলতাব আলি হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি)।
পৌনঃপুনিক এই বিপর্যয়গুলো বাঙালির সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসেরও উজ্জ্বল স্মারক, যা তাদের সামষ্টিক মানসিকতা ও জনস্মৃতিতে গভীর ছাপ ফেলেছে। সেই সাথে, এগুলো একটি জনগোষ্ঠীর ঘুরে দাঁড়াবার মানসিকতা এবং মর্যাদাবোধকে নির্দেশ করে। এ কারণে এও অনুমান করা যায় যে, তারা স্বভাববতই এ ধরনের বৈষম্যমুলক ও অন্যায় আচরণের ব্যাপারে স্পর্শকাতর হয়ে উঠতে পারে। আমাদের গুরুতর উদ্বেগ এই যে, স্টারমার এবং অ্যাশওয়ার্থের এ ধরনের তাচ্ছিল্যসূচক বক্তব্যের ফলে দীর্ঘদিন যাবত প্রান্তিকিকৃত একটি জনসমাজের প্রতি আরও বৈষম্যমূলক এবং সহিংস আক্রমণ নেমে আসতে পারে, যদি না তা সমালোচিত এবং সংশোধিত হয়। একই রাজনৈতিক দলের দুইজন শীর্ষ নেতা যখন একই নৃগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে, একই ধরনের জাতিবাদি সরলীকরণ পুনরাবৃত্তি করেন এবং উভয়ই তাদের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কোনো সুস্পষ্ট ক্ষমাপ্রার্থনা এবং তা প্রত্যাহারের আন্তরিক প্রচেষ্টা এড়িয়ে যান, তখন তা লেবার পার্টির বর্তমান নেতৃত্বের একটি অংশের মধ্যে গড়ে ওঠা বাঙালিবিদ্বেষের সূচক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
তা যদি নাও হয়, অন্ততপক্ষে, এটি কাকতালীয় একটি সাংঘাতিক রাজনৈতিক ভুল তো বটেই। এ ধরনের মারাত্মক ভুল সংশোধনের জন্য এবং তার প্রায়শ্চিত্তকরণে দলের সদিচ্ছা স্পষ্ট করতে হলে, লেবারকে অনতিবিলম্বে ব্রিটেনের ঔপনিবেশিক অতীতের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা এবং ক্ষতিপূরণ প্রদানের উপায় নিয়ে আলোচনা শুরু করতে হবে।
আমরা স্যার কিয়ার স্টারমার এবং জোনাথন অ্যাশওয়ার্থকে তাদের বক্তব্য সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহার করতে এবং আন্তরিক ও নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করতে আহ্বান জানাচ্ছি।
আমরা ব্রিটিশ সমাজে বাঙালি জনগোষ্ঠীর উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতি প্রদান, তাদের অধিকার এবং মর্যাদারক্ষার জোরালো দাবি জানাচ্ছি। শতাব্দীব্যাপী নিপীড়ন, ব্যাপক বিস্তৃত অমানবিকীকরণ এবং একাধিক গণহত্যার শিকার জনগোষ্ঠী হিসেবে আমরা কেবল যুক্তরাজ্যের বাঙালিদের সাথেই নয়, বরং যেকোনো প্রান্তিক সম্প্রদায়ের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি যারা যেকোনো স্থানে, যে-কারো দ্বারা জাতিবাদি সরলীকরণের মুখোমুখি হচ্ছে, সেই সাথে ন্যায়বিচার ও সমতার পক্ষে আমাদের নিরলস প্রচেষ্টা জারি রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি।
স্টারমার কী বলেছেন?
ইউকের বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, ‘যারা বাংলাদেশের মতো দেশ থেকে এ দেশে এসেছেন, তাদের ফেরত পাঠানো হতে পারে। কয়েকটি দেশের মানুষের এখানে আসা বন্ধ করতে পারি আমরা।‘
যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষে একটি শো-ডাউন অনুষ্ঠানে লেবার পার্টির নেতা কিয়ার স্টারমার এই বক্তব্য দেন। তার দল ক্ষমতায় গেলে তিনি এই উদ্যোগ নেবেন বলে জানান। তার বক্তব্যের পর লেবার পার্টি বিপাকে পড়েছে। ইউকেজুড়ে এ নিয়ে চলছে তুমুল সমালোচনা।