ছবি: সংগৃহীত
বিদ্যমান ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯-এ এমনটাই বলা আছে, যারা সরকারি চাকরি করেন প্রতি পাঁচ বছর পর পর তাদের সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। কিন্তু আইনের এই নির্দেশনা মানছেন না সরকারি চাকরিজীবীরা। বিশেষ করে প্রশাসনের প্রভাবশালী কর্মকর্তা এবং পুলিশে কর্মরতরা।
প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের অনেকে চাকরিরত অবস্থায় সম্পদের পাহাড় গড়লেও তার কোনো হিসাব নেই সরকারি দপ্তরে। এতে বেড়েছে দুর্নীতি ও অবৈধ আয়ে সম্পদ গড়ার প্রবণতা।
অন্যদিকে, পুলিশ প্রবিধানে নির্দেশনা দেওয়া আছে, পুলিশ সদস্যদের নিজ জেলায় সম্পত্তি কেনা এবং অন্য জেলায় থাকা সম্পত্তি বিক্রির ক্ষেত্রে সদর দপ্তরের অনুমতি নিতে হয়।এ ছাড়া বছর শেষে একটি নির্দিষ্ট মাসে সমস্ত সম্পদের হিসাব দেওয়ার বাধ্যবাধকতাও আছে তাদের। কিন্তু বছরের পর বছর পুলিশ প্রবিধানে উল্লেখিত এসব নিয়মনীতির ধার ধারছেন না পুলিশ সদস্যরা। কোনো প্রকার জবাবদিহি ছাড়াই বৈধ ও অবৈধ আয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি সম্পদ গড়ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। দৈনিক আজকের পত্রিকার দুটি ভিন্ন প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
সম্প্রতি ছেলের ছাগল-কাণ্ডে ফাঁস হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) মতিউর রহমান ও তার পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য। উচ্চপদস্থ আরেক কর্মকর্তা এনবিআরের প্রথম সচিব আবু মাহমুদ ফয়সালের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের অভিযোগ এনেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এসব নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের পর থেকেই সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার বিষয়টি আবার সামনে উঠে এসেছে।
বিদ্যমান ‘সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ১৯৭৯’ অনুযায়ী সরকারি চাকরিজীবীদের প্রতি পাঁচ বছর পর সম্পদের হিসাব বিবরণী জমা দিতে হবে। এতে বলা হয়েছে, ‘প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী প্রতি পাঁচ বছর অন্তর প্রদর্শিত সম্পত্তির হ্রাস-বৃদ্ধির হিসাব বিবরণী যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে দাখিল করবেন। প্রত্যেক সরকারি কর্মচারী চাকরিতে প্রবেশের সময় যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সরকারের কাছে তার অথবা তার পরিবারের সদস্যদের মালিকানাধীন বা দখলে থাকা শেয়ার, সার্টিফিকেট, সিকিউরিটি, বিমা পলিসি এবং ৫০ হাজার টাকা বা ততধিক মূল্যের অলঙ্কারাদিসহ স্থাবর/অস্থাবর সম্পত্তির ঘোষণা দেবেন।’ কিন্তু ৪৫ বছর আগের আইনটি মানছেন না অধিকাংশ সরকারি চাকরিজীবী।
আইনটি কার্যকর করতে ২০২২ সালের ১৬ জুন জাতীয় সংসদে অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে তৎকালীন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছিলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবীদের সম্পদের হিসাবের বিবরণ দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে আচরণ বিধিমালা, ১৯৭৯ হালনাগাদ করা হচ্ছে।’
প্রতিমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের পর উল্টো সম্পদের হিসাবে ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করে সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা, ২০২২ এর খসড়া চূড়ান্ত করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এই ব্যাপারে প্রশাসন বিশেষজ্ঞ, প্রশাসনবিষয়ক বহু গ্রন্থের প্রণেতা ও সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. ফিরোজ মিয়া সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আয়কর রিটার্নের পাশাপাশি প্রতিবছর সরকারি কর্মচারীরা সম্পদের হিসাব দিয়ে থাকেন। ভারতে শুধু সম্পদের হিসাব প্রদান তদারকির জন্য একজন উপসচিবের নেতৃত্বে একটি সেল কাজ করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আয়কর রিটার্ন ও সম্পদের হিসাব প্রদান এক নয়। কালোটাকা সাদা করা ও আয়করের মাধ্যমে রাজস্ব বৃদ্ধি করা এনবিআরের কাজ। আর সম্পদের হিসাব অন্য জিনিস। কীভাবে, কোন উৎস থেকে সম্পদ বাড়ল, তার তদারক করা এনবিআরের কাজ নয়। সুতরাং দুটি দুই জিনিস, উদ্দেশ্যও আলাদা।’
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি দুর্নীতি প্রতিরোধে সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসনের পর সম্পদ বিবরণী দাখিল ও স্থাবর সম্পত্তি অর্জন বা বিক্রির নিয়ম মানতে সব মন্ত্রণালয়ে ২০২১ সালের ২৪ জুন চিঠি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। কিন্তু এতে সাড়া দেননি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এরপর ২০২২ সালের মার্চে আবারও চিঠি দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তারপরও সাড়া মেলেনি।
এই ব্যাপাারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান এ বিষয়ে বলেন, ‘সরকারি চাকরিতে ঢোকার সময় সম্পদের হিসাব দেওয়া এবং প্রতিবছর সেটা হালনাগাদ করার কথা। আমাদের দেশে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, জালিয়াতি-প্রতারণা, অবৈধ অর্থ সম্পদের মালিকানা—এসবের অন্যতম কারণ হচ্ছে, আইনের প্রয়োগ নেই। এখন যেসব বিধিমালা আছে, সেসব মানা হয় না। যারা করে না, তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয় না। সে কারণে প্রতিনিয়ত দুর্নীতি হচ্ছে। তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।’
এদিকে, সম্প্রতি পুলিশের শীর্ষস্থানীয় সাবেক দুই কর্মকর্তা এবং বর্তমানে কাজ করা ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার অস্বাভাবিক সম্পদ নিয়ে সারা দেশে আলোচনা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠছে, একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে কোনো প্রকার জবাবদিহি ছাড়া কীভাবে এত সম্পদ গড়ে তুললেন তারা।
পুলিশে কর্মরত অবস্থায় দেশজুড়ে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদ। চলতি মাসে ঢাকার একটি আদালত দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের জন্য বেনজীর ও তার পরিবারের সদস্যদের সম্পদ জব্দের আদেশ দেয়। এরপরই বেরিয়ে আসে তার বিপুল সম্পত্তির তথ্য।
আরেক অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়াও বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন বলে প্রথমে সংবাদ বেরোয়। পরে তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়। এখন তার ঠিক কত সম্পদ তা অনুসন্ধান করে জনমনের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য দুদকে আবেদন জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী।
এ ছাড়া, পুলিশের সিটি এসবির অতিরিক্ত ডিআইজি শেখ রফিকুল ইসলাম শিমুলের বিরুদ্ধেও অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। শিমুলের বিষয়ে তথ্য চেয়ে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি পাঠিয়েছে সংস্থাটি। সেখানে দাবি করা হয়, এই কর্মকর্তা ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন।
যদিও কর্মকর্তাদের এত সম্পদের বিষয়ে কিছুই জানে না পুলিশ সদর দপ্তরের সংস্থাপন শাখা। সেখানকার কর্মকর্তারা বলছেন, যদি অনুমোদন না নিয়ে কেউ সম্পত্তি কিনে থাকেন, তাহলে সেটা পুলিশ প্রবিধান অনুসারে অপরাধ।
প্রসঙ্গত, পুলিশ প্রবিধানের ১১২ (ঙ) ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘পুলিশ অফিসারগণ নিজ জেলা ব্যতীত অন্য কোনো স্থানে ইন্সপেক্টর জেনারেলের পূর্বানুমতি ব্যতীত স্বনামে, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, আত্মীয়স্বজন, চাকরবাকর বা আশ্রিত ব্যক্তির নামে বা বেনামে জমি বা অন্য কোনো স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করতে পারবেন না। নিজ জেলা ব্যতীত অন্য কোনো জেলায় মালিকানা থাকলেও ইন্সপেক্টর জেনারেলের পূর্বানুমতি ব্যতীত তাহা বিক্রয় করিতে পারিবেন না।’
ওই ধারায় আরও বলা হয়, প্রতিবছরের মার্চ মাসে তাঁদের (পুলিশ সদস্যরা) সম্পত্তির হিসাব কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করবেন।
সম্পত্তি কেনার আগে অনুমতি নেওয়ার নিয়মের বিষয়টি স্বীকার করেছেন পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, সরকারি কর্মচারী হিসেবে পুলিশ সদস্যদের সম্পত্তি কেনার আগে পুলিশ সদর দপ্তর হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নেওয়ার বিধান রয়েছে। পুলিশ অধিদপ্তরের সদস্য হিসেবে এই অনুমতি নেওয়া সবার জন্য বাধ্যতামূলক।
বাধ্যতামূলক হলেও অনুমতি নেওয়ার ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, সম্পত্তি কেনা বা সম্পদ তৈরির ক্ষেত্রে পুলিশপ্রধানের অনুমতি নেওয়ার পুরো ব্যবস্থাটি ভেঙে পড়েছে। বেশির ভাগ পুলিশ সদস্যই অনুমতি না নিয়ে গোপনে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি গড়ছেন। এসব নিয়ে কোনো নজরদারিও নেই।
এই ব্যাপারে পুলিশের সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘পুলিশ প্রবিধান ব্রিটিশ আমলের। সে সময় কোনো পুলিশ সদস্য সম্পদের হিসাব দিত কি না জানি না। তবে আমাদের চাকরিজীবনে পুলিশ সদস্যদের এমন হিসাব জমা দেওয়া ও অনুমতি নেওয়ার রীতি দেখিনি। আসলে এসব তথ্য জমা দিয়েও কোনো লাভ নেই। হয়তো কেউ কেউ নয়ছয় করেই জমা দিলেন, এভাবে কখনো দুর্নীতি কমানো সম্ভব না। যত দিন না পুলিশকর্তারা নিজেদের মানসিকতা থেকে দুর্নীতিকে মুছে ফেলবে, তত দিন দুর্নীতি কমবে না।’
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি বিধি অনুযায়ী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব দেওয়ার নিয়ম আছে। পুলিশের নিজেদের আইনের যেহেতু একই নিয়ম আছে, তাই কর্মকর্তা ও পুলিশ সদস্যরা এটা মানতে বাধ্য। তবে এখানে শুধু পুলিশ সদস্যদের দোষ দিলে হবে না। এর পেছনের ব্যর্থতার দায় পুলিশের কর্তাদের। তাঁরা নিজেরা সম্পদের হিসাব দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতেন। অন্য সদস্যদের উৎসাহ দিতে পারতেন। তা করেননি, নিজেরা সম্পদ গোপন করে নিচের সদস্যদেরও উৎসাহ দিয়েছেন।