পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পেনশন নিয়ে শিক্ষক, কোটা নিয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ডাক
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩০ জুন ২০২৪, ০৮:০৫ পিএম
ঈদুল আজহা ও গ্রীষ্মের দীর্ঘ ছুটির পর ফের ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ হচ্ছে দেশের সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মর্যাদাহানি হবে-এমন দাবি জানিয়ে গতকাল শনিবার সংবাদ সম্মেলন করে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ডাক দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। এরপর আজ রোববার দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমন ঘোষণা এলো।
রোববার সারাদেশের মোট তিনটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা সর্বজনীন পেনশনের প্রত্যয় স্কিমের সমালোচনা করে বলেন, শিক্ষকরা দীর্ঘদিন ধরেই এ নিয়ে কথা বলে আসছিলো কিন্তু সরকার বিষয়টি আমলে নেয়নি। তাই বাধ্য হয়েই তারা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের মতো কঠোর কর্মসূচিতে নামছেন।
রাজশাহী ও সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইস্যুটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই এ নিয়ে সরব ছিলাম। কিন্তু সরকার বিষয়টি আমলে নেয়নি।
এদিকে সারাদেশে শিক্ষকদের আন্দোলনে যাওয়ার ডাক দেওয়ার পর শিক্ষার্থীরাও কোটা বিরোধী বৃহত্তর আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই অবস্থায় দেশের অচলাবস্থা সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে দেশের উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে।একইসঙ্গে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ভিন্ন ইস্যুতে আন্দোলন সারাদেশের ক্যাম্পাসগুলোতে ছড়িয়ে পড়লে তা সংঘাতে রূপ নিতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন অনেকে।
এ বিষয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী নাহিদ ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, তারা দেশের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য আন্দোলন করছেন। আমরা ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রাখা সাপেক্ষে কমিশন গঠন করে সব গ্রেডে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ কোটা রেখে কোটা পুনর্বণ্টন বা সংস্কার, চাকরির পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করা ও কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্য পদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগের দাবি করছি। এটি আমাদের ন্যায় সংগত দাবি। দাবি আদায়ে ১ জুলাই সোমবার থেকে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে একযোগে ছাত্রসমাবেশে করা হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত ধারাবাহিক আন্দোলন চলবে।
এ বিষয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের একজন প্রফেসর বলেন, দেশের শিক্ষাঙ্গনের পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে যৌক্তিক ইস্যুতেও আমরা মুখ খুলতে পারি না। নানা দিক দিয়ে আটকে দেয়। এক মাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা চাইলেও যেকোনো বিষয়ে পক্ষে বা বিপক্ষে নামতে পারে না। আমাদের হাত-পা বাঁধা।
এর আগে শনিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সই করা এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘আপনাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও ম্যান্ডেটে শিক্ষক সমিতি এ সর্বাত্মক আন্দোলনের রূপরেখা প্রণয়ন করেছে। আমাদের আন্দোলন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজের সম্মান ও মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আন্দোলন।’
বৈষম্যমূলক ও অবমাননাকর পেনশন স্কিম থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বাদ দেওয়া, শিক্ষকদের জন্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক বেতন স্কেল প্রবর্তন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতিশ্রুত 'সুপার গ্রেডে' অন্তর্ভুক্ত করার দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই সর্বাত্মক ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, কর্মবিরতিকালে নিয়মিত, সান্ধ্যকালীন প্রোগ্রাম, প্রফেশনাল প্রোগ্রাম, অনলাইন ক্লাস ও অফলাইন ক্লাসসহ ক্লাস ও পরীক্ষা; সব ধরনের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। চেয়ারম্যান অফিস, হল প্রভোস্ট অফিস, গবেষণা কেন্দ্র, ইনস্টিটিউট, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, ডিন অফিস, কম্পিউটার ল্যাব ও সেমিনার বন্ধ থাকবে।
শিক্ষকদের কোনো সিলেকশন বোর্ড মিটিং, কোশ্চেন কোলাবোরেশন মিটিং বা একাডেমিক কমিটির মিটিংয়ে না যেতে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে। এদিকে শিক্ষকদের এই আন্দোলনের সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও একাত্মতা প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে।
কি আছে প্রত্যয় স্কিমে
এর আগে চলতি বছরের মার্চ মাসে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় নতুন যুক্ত হওয়া প্রত্যয় স্কিমের রূপরেখা ঘোষণা করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, যাদের ন্যূনতম ১০ বছর চাকরি অবশিষ্ট আছে, তারা আগ্রহ প্রকাশ করলে প্রত্যয় স্কিমে অংশগ্রহণ করতে পারবেন। জুলাই মাসের পর স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থার চাকরিতে যারা যোগদান করবেন, তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থায় প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত করা হবে।
আরও বলা হয়েছে, প্রত্যয় স্কিম চালুর ফলে বিদ্যমান কর্মকর্তা বা কর্মচারীদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে না; বরং তাদের বিদ্যমান পেনশন বা আনুতোষিক সুবিধা অক্ষুণ্ন থাকবে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় খুব কমসংখ্যক স্বশাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় সংস্থা ও তাদের অধীনস্থ অঙ্গপ্রতিষ্ঠানে পেনশন স্কিম আছে। এ ধরনের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মচারীরা আনুতোষিক স্কিমের আওতাভুক্ত এবং তাদের জন্য সিপিএফ ব্যবস্থা প্রযোজ্য। এ ব্যবস্থায় কর্মচারীরা চাকরি শেষে অবসর–সুবিধা হিসেবে এককালীন আনুতোষিক পান; কিন্তু মাসিক পেনশন পান না। ফলে অবসরোত্তর–জীবনে প্রায় ক্ষেত্রেই আর্থিক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, কর্মচারীদের অবসরোত্তর–জীবনের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা দিতে বিদ্যমান ব্যবস্থার বিকল্প হিসেবে সরকার ‘প্রত্যয় স্কিম’ প্রবর্তন করেছে। প্রত্যয় স্কিমে অংশগ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীরা প্রাপ্ত মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা সর্বোচ্চ ৫ (পাঁচ) হাজার টাকা, যেটা কম হয়, সেটা তাদের বেতন হতে কাটা হবে এবং সমপরিমাণ অর্থ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা দেবে। এরপর উভয় অর্থ উক্ত প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত উক্ত কর্মকর্তা বা কর্মচারীর কর্পাস হিসাবে জমা করবে। এ প্রক্রিয়ায় কর্মকর্তা–কর্মচারীর পেনশন ফান্ড গঠিত হবে এবং সেই ফান্ড জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ জমাকৃত অর্থের ভিত্তিতে পেনশন দেওয়া হবে।
বিদ্যমান সিপিএফ ব্যবস্থায় কর্মচারী মূল বেতনের ১০ শতাংশ এবং প্রতিষ্ঠান মূল বেতনের ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ দেয়। তবে প্রত্যয় স্কিমে প্রতিষ্ঠান মূল বেতনের ১০ শতাংশ দেবে; সিপিএফ ব্যবস্থা থেকে যা ১ দশমিক ৬৭ বেশি। প্রত্যয় স্কিমে একজন ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠানে যোগদানের পর নিজ বেতন থেকে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান একই পরিমাণ টাকা ৩০ বছর চাঁদা দিলে অবসরের পর অর্থাৎ ৬০ বছর বয়স থেকে মাসিক ৬২ হাজার ৩৩০ টাকা হারে পেনশন পাবেন।
৩০ (ত্রিশ) বছর ধরে মাসিক ২ হাজার ৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিলে সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর নিজ বেতন থেকে প্রদত্ত মোট চাঁদার পরিমাণ দাঁড়াবে ৯ লাখ টাকা এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থা জমা করবে আরও ৯ লাখ টাকা।
অর্থাৎ প্রতিষ্ঠান ও সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর সর্বমোট চাঁদার পরিমাণ হবে ১৮ লাখ টাকা। তিনি যদি ৭৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন, তবে ১৫ বছরে পেনশন পাবেন ১ কোটি ১২ লাখ ১৯ হাজার ৪০০ টাকা, যা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর নিজ জমার ১২ দশমিক ৪৭ গুণ।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, পেনশনের সুবিধা আজীবন মিলবে বলে এই অঙ্ক আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্য মুনাফার হার বৃদ্ধি পেলে মাসিক পেনশনের পরিমাণ আরও বাড়বে। জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের যাবতীয় খরচ সরকার নির্বাহ করবে বলে চাঁদাদাতার কর্পাস হিসাবে জমাকৃত অর্থ এবং বিনিয়োগ লব্ধ আয় সম্পূর্ণ চাঁদাদাতার অ্যানুইটি হিসাবায়নের মাধ্যমে মাসিক পেনশন নির্ধারণ করা হবে।
জমাকৃত চাঁদার ওপর বিনিয়োগ রেয়াত পাওয়া যাবে এবং প্রাপ্য পেনশন আয়করমুক্ত হবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। স্কিমটি রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত হওয়ায় এটি শতভাগ ঝুঁকিমুক্ত ও নিরাপদ। এই স্কিমে নিবন্ধিত কর্মচারী পেনশনযোগ্য বয়সে উপনীত হওয়ার পরবর্তী মাস থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাঁর ব্যাংক হিসাবে মাসিক পেনশনের অর্থ পাবেন। মুঠোফোনে এসএমএসের মাধ্যমে তাঁদের এ বিষয়ে অবহিত করা হবে। এ ক্ষেত্রে তাঁকে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ বা অন্য কোনো দপ্তরে যাওয়ার বা কোনো প্রকার প্রমাণ দেখানোর প্রয়োজন হবে না।