র্যাবে কর্মরত দুই সেনা কর্মকর্তাকে জাতিসংঘ শান্তি মিশনের আগমুহূর্তে প্রত্যাহার
লেফটেন্যান্ট কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুবুল আলম। ছবি : সংগৃহীত
এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-র্যাবে কাজ করেছেন বা করছেন এমন অন্তত দুজন সেনা কর্মকর্তার নাম সম্প্রতি জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যাবার ঠিক আগ মুহূর্তে তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীতে কাজ করছেন বা করতেন এমন চারটি সূত্র তথ্যটি নিশ্চিত করেছেন।
দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানায়, ওই সেনা কর্মকর্তাদের শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠানোর জন্যে নিজ নিজ ইউনিট থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে মিশনে না পাঠিয়ে তাদের আবার নিজ নিজ ইউনিটেই ফেরত পাঠানো হয়েছে। তাদের একজন হলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল। তিনি র্যাব-৭ অধিনায়ক এবং র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে কাজ করেছেন। ৪৫ লংকোর্সের কর্মকর্তা মশিউর রহমান সেনাবাহিনীতে ফেরত গেছেন বেশ কিছুদিন আগে। সর্বশেষ বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন তিনি। অন্যজন হলেন, বর্তমান র্যাব ৭-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুবুল আলম। তিনি মশিউর রহমানেরই কোর্সমেট। তবে ৪৬ বিএমএ লংকোর্সে তিনি কমিশন পান।
মশিউর রহমান জুয়েলের সঙ্গে ১৮ জুন যোগাযোগ করা হলেও তিনি কথা বলেননি। তবে মাহবুব আলম বাংলা আউটলুককে বলেন, ‘এটা রুটিন একটা প্রসেস। এটা সিনিয়রদের ডিসিশন।'
১৭ জুন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু হায়দার মোহাম্মদ রাসেলুজ্জামানের কাছে এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হয়। কিন্তু সাতদিন পরও আইএসপিআরের পক্ষ থেকে কোন মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
এদিকে, একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের দুজনকে মিশনে অংশগ্রহণের জন্য ক্লোজ করা হয়েছিল। তবে কী কারণে তাদের আবার নিজ নিজ ইউনিটে ফেরত পাঠানো হয়েছে, তার বিস্তারিত তিনি জানেন না।
‘কোন মিশনে পাঠানো হচ্ছিল বা পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল, আমি তার বিস্তারিত জানি না,’ বলেন তিনি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশে জাতিসংঘ কার্যালয়ে যোগাযোগ করেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশের অন্তত দুজন কর্মকর্তা বলেছেন, তারা মনে করছেন সম্প্রতি জার্মান রাষ্ট্রীয় সংবাদ প্রতিষ্ঠান ডয়চে ভেলের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে তাদের ধারণা।
গত ২১ মে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের এক তথ্যচিত্রে বলা হয়, নির্যাতন ও হত্যার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। ডয়চে ভেলের তথ্যচিত্র প্রচারিত হবার পর, আইএসপিআরের পক্ষ থেকে ২৫ মে ২০২৪ জানানো হয়, অতি সম্প্রতি ডয়চে ভেলে কর্তৃক `Torturers deployed as UN peacekeepers’ শিরোনামে প্রচারিত ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্রে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সেনাসদস্যদের নিয়ে একটি “বিভ্রান্তিমূলক প্রতিবেদন” উপস্থাপন করা হয়।
ডকুমেন্টারিটিতে অপ্রাসঙ্গিকভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করে অপর একটি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মানহানি করাই এর মূল অভিপ্রায় ছিল বলে প্রতীয়মান। এটি সম্পূর্ণরূপে একটি পক্ষপাতদুষ্ট অভিপ্রয়াস, যা ডকুমেন্টারিটির বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা বিনষ্ট করেছে।
আইএসপিআর জানায়, ‘বিগত তিন দশকে জাতিসংঘের অধীনে দায়িত্ব পালনকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা কোনরূপ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ মুক্ত, যা একটি দৃষ্টান্তমূলক অর্জন।‘
আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছিলেন, ‘জাতিসংঘ মহাসচিব এবং এর অন্য কর্তাব্যক্তিরাসহ সারা বিশ্ব বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের প্রশংসা করছে, তাদের নিয়ে ডয়চে ভেলের নেতিবাচক প্রতিবেদন অন্তঃসারশূন্য, দেশবিরোধী।’
দায়িত্বশীল সূত্র বাংলা অউটলুককে বলেছে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে পাঠানোর আগে তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর মানবাধিকার ক্ষুন্নের কোনো অভিযোগ আছে কিনা তা যাচাই করা শুরু হয়েছে।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ১৯৯৪ এবং ২০০৯ সালে দু'দফায় অংশগ্রহণ করেছেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ড. মো. নাঈম আশফাক চৌধুরী। অবসরের পর তিনি এখন গবেষণা করছেন। বাংলা আউটলুককে তিনি বলছিলেন, ‘আমাদের একজন সেনা কর্মকর্তা অযোগ্যতার কারণে শান্তিরক্ষা যোগদান করতে পারবে না তা আমার জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক। প্রতিষ্ঠান ও দেশের জন্য এটা খুবই দুঃখজনক খবর।’
কিন্তু কী করা যায়?
আশফাক চৌধুরী বলছিলেন, সম্প্রতি যে সমস্ত অভিযোগ এসেছে তা "ফু" দিয়ে উড়িয়ে না দিয়ে, তিনি মনে করেন এগুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘আমাদের একটা কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে কিছু অভিযোগের ভিত্তিতেই ইতিপূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এসেছে।’
ড. আশফাক বলেন, ‘আমরা জানি র্যাবে নিজস্ব মেকানিজম বা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে 'কভার আপ' কিংবা প্রসিডিউর ফলো করা হয়। আমি মনে করি এ পুনর্বিবেচনা করা খুবই জরুরি।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, যে আইনের ভিত্তিতে র্যাব গঠিত হয়েছে এখন পুনর্বিবেচনা করা উচিত। র্যাবের কার্যক্রম সুনির্দিষ্ট হওয়া উচিত।’
তার মতে, অপারেশন ক্লিন হার্টের পরবর্তী সময় সামরিক বাহিনীর সাফল্য থেকে ২০০৪ সালে সন্ত্রাসী অস্ত্রধারীদের ধরার জন্য দেশে র্যাব গঠন করা হয়েছিলো। কিন্তু যেই করুক পরবর্তীতে এ বাহিনী সবসময় সঠিক কাজে ব্যবহার হয়নি। প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা বা দায়বদ্ধতা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।
নাঈম আশফাক মনে করেন, সেনাবাহিনী বা সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের পুলিশি কাজে দীর্ঘদিন থাকা উচিত নয়। এই তিন বাহিনীকে মনে করা উচিত তারা ফোর্স, কোন সার্ভিস নয়।
তিনি বলছেন, দীর্ঘদিন সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা এভাবে পুলিশি ডিউটি করার ফলে তাদের মধ্যে পেশাদারিত্ব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
র্যাবে নিয়োগে স্বচ্ছতা
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদরদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, র্যাব পুলিশের একটি বিশেষায়িত বাহিনী হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেখানে ভূমিকা রাখার সুযোগ খুবই কম। র্যাবে সশস্ত্র বাহিনী থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে আসছেন বা ফেরত যাচ্ছেন সে বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে বিস্তারিত কোনো তথ্য নেই। এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট বা এসপি পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তার ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়।
মানবাধিকার কর্মীরা কী বলছেন
মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলেন, বাংলাদেশে স্বাধীন তদন্ত ব্যবস্থার সংকট রয়েছে, ফলে তা থেকে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা গুমের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করা পুরাপুরি সম্ভব নয়। আস্থা রাখার মতো কোনো তদন্ত হয়েছে শোনা যায়নি।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো এখন জাতিসংঘের কাছে দাবি জানাচ্ছে যাতে করে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের পূর্বেই কর্মকর্তাদের কঠোর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়।
২৩ জুন ২০২৩ সালে মানবাধিকার বিষয়ক আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল দাবি জানায়, জাতিসংঘকে অবশ্যই শান্তিরক্ষা বাহিনীতে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তাদের ভর্তির বিষয়টি পর্যালোচনা করতে হবে ।
তারা বলে, ‘শান্তিরক্ষী বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ট্র্যাক রেকর্ড থাকা উচিত নয়। জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জিন পিয়েরে ল্যাক্রোইক্সকে অবশ্যই বাংলাদেশে নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের পর্যালোচনাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধীদের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে মোতায়েন করা হবে না।‘
জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ
জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ১৯৮৮ সালে সর্বপ্রথম ইরাক এবং নামিবিয়া দুটি অপারেশনে অংশগ্রহণ করে। বর্তমানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বৃহৎ ভূমিকা পালনকারী দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। ১৯৮৮ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১,৮৮,৫৫৮ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী ৪০টি দেশে ৬৩টি জাতিসংঘ শান্তি মিশনে অংশ নিয়েছেন। বর্তমানে ৭,৪৩৬ জন ইউনিফর্ম-পরিহিত শান্তিরক্ষী ১৩টি দেশে কর্মরত রয়েছেন।
১৯৮৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত দায়িত্ব পালনকালে ১৬৭ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিহত হয়েছেন এবং ২৫৯ জন শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন।