টানা ৩২ বছর কারাগারে থাকার পর মুক্তি পাওয়া আলোচিত জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া মারা গেছেন। আজ সোমবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। তার বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
জল্লাদ শাহজাহানের বোন ফিরোজা বেগম মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, শাহজাহান ভূঁইয়া বেশ কিছুদিন ধরে ঢাকার পাশের এলাকা হেমায়েতপুরে থাকতেন। রবিবার রাতে তার বুকে ব্যথা শুরু হলে রাজধানীরসোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তিনি মারা যান।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) শেরে বাংলা নগর থানার ওসি মোহাম্মদ আহাদ আলী গণমাধ্যমকে জানান,শাহজাহানকে অসুস্থ অবস্থায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
দীর্ঘ ৩১ বছর ৬ মাস ২ দিন কারাভোগের পর ২০২৩ সালের ১৮ জুন দুপুরে কারাগার থেকে মুক্তি পান শাহজাহান। ডাকাতি করতে গিয়ে হত্যা ও অস্ত্র আইনের দুই মামলায় তার ৪২ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। কিন্তু কারাগারে জল্লাদের কাজ, সুশৃঙ্খল জীবনযাপন আর ভালো কাজের পুরস্কার হিসেবে তিনি ১০ বছর ৫ মাস ২৮ দিন রেয়াত (সাজা মওকুফ) পান। ওই দুই মামলায় তার পাঁচ হাজার টাকা করে মোট ১০ হাজার টাকা জরিমানা হয়। মুক্তির সময় কারা কর্তৃপক্ষ তা পরিশোধ করে দেয়।
ছাত্রজীবনে স্থানীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া শাহজাহান অপরাধ জগতে ঢুকতেও বেশি সময় নেননি। ডাকাতি ও খুনের মতো ভয়ংকর সব অপরাধ করার পর ১৯৯১ সালের ১৭ ডিসেম্বর তিনি প্রথম গ্রেপ্তার হয়ে মানিকগঞ্জ জেলা কারাগারে যান। এরপর দুই মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে ৪২ বছরের কারাদণ্ড হয় তার। কারাগারে তার কয়েদি নম্বর ছিল ২৫৮৯/এ। সাজা কমাতে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। এরপর সহযোগী হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে জল্লাদ জীবন শুরু করেন তিনি। এক সময় মানিকগঞ্জ জেলা কারাগার থেকে ঢাকা সেন্ট্রাল কারাগারে আনা হয় শাহজাহানকে। সেখানে তাকে প্রধান জল্লাদের আসন দেওয়া হয়।
যেভাবে আটক হন
নারীঘটিত একটি ঘটনার পরে শাহজাহান বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। তাছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করার পর থেকে যেকোনো ‘অপারেশনে’ তার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন করেছিলেন ১৯৯১ সালে মাদারীপুর জেলায় এবং এটাই ছিল তার জীবনের সবশেষ অপারেশন। অপারেশন শেষে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করছিলেন শাহজাহান। তবে গোপন সূত্রে পুলিশের কাছে পৌঁছে যায় সেই খবর।
মানিকগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্ট বসালে শাহজাহান তার ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জানতে পারেন। কিন্তু সব জেনেও ওই এলাকা দিয়েই ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিও হয়। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন, পথিমধ্যে পুলিশ তাকে আটক করে। সেদিনই তার গতিময় জীবনের সমাপ্তি এবং এরপর থেকে বন্দিজীবন শুরু হয়।
জল্লাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ
জীবনের সোনালী সময়গুলো কারাগারেই কাটাতে হবে- এমন ভাবনা থেকে শাহজাহান চিন্তা করলেন, জল্লাদ হিসেবে সময় দিলে তার সাজা কিছুদিনের জন্যে হলেও কমবে। তাই নিজেকে অন্যভাবে প্রস্তুত করার জন্য জেল সুপারের কাছে গিয়ে জল্লাদের খাতায় নাম লেখানোর আগ্রহপ্রকাশ করেন।
তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এটাই তার জীবনে প্রথম কারাগারে কাউকে ফাঁসি দেওয়ার ঘটনা। এই কাজে শাহজাহানের যোগ্যতা দেখে আট বছর পর কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের স্বীকৃতি দেয়।
প্রধান জল্লাদ হওয়ার পর আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন শাহজাহান। তিনি জানান, একটি ফাঁসি দিতে প্রধান জল্লাদের সঙ্গে ছয়জন সহযোগী লাগে এবং ফাঁসির রায় কার্যকর করলে প্রত্যেক জল্লাদের দুই মাস চার দিন করে কারাদণ্ড মওকুফ হয়। এছাড়া, কারাগারে যারা জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করে, কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাহজাহান তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।