Logo
Logo
×

সংবাদ

শুধু বেনজীর নন, সাবেক ডিএমপিপ্রধান আছাদুজ্জামান মিয়ারও ছিল 'জাদুর চেরাগ'

জুলকারনাইন সায়ের

জুলকারনাইন সায়ের

প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৪, ০২:১১ পিএম

শুধু বেনজীর নন, সাবেক ডিএমপিপ্রধান আছাদুজ্জামান মিয়ারও ছিল 'জাদুর চেরাগ'

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদের খবর চাউর হওয়ার পর একজন ব্যক্তি সরকারি ওই বেতনে চাকরি করে কীভাবে এতো সম্পদ গড়ে তুলতে পারেন তা নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন উঠেছে।

এদিকে, অস্বাভাবিক সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে বেনজীরের চেয়ে কম যাননি ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার পদে তারই স্থলাভিষিক্ত হওয়া আছাদুজ্জামান মিয়া। তিনিও একইরকম  সরকারি চাকরির ‘ঘোষিত’ আয়ের তুলনায় বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। বাংলা আউটলুকের অনুসন্ধানে এমনটাই দেখা গেছে। 

এখন পর্যন্ত যেসব কাগজপত্র পাওয়া গেছে তাতে দেখা গেছে,  স্ত্রী ও তিন সন্তানসহ আছাদুজ্জামানের নামে দেশের বিভিন্ন স্থানে ২৩৭ কোটি টাকারও বেশি মূল্যের সম্পদ রয়েছে।

পরিবারের সদস্যদের নামে ছাড়াও শ্যালক, চাচাত ভাই ও গ্রামের বাড়ির বিশ্বস্ত তত্ত্বাবধায়কের নামেও সম্পত্তি কিনেছেন পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা আছাদুজ্জামান। আর তাদের নামে কেনা সম্পদের মোট মূল্য অন্তত ৬ কোটি টাকার বেশি।  

বেনজীরের বিপুল সম্পদ ফিরিস্তি সামনে আসার পর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) জোর দিয়েছে যে, যখন তার মতো শক্তিশালী কর্মকর্তারা কোনো জবাবদিহি ছাড়াই তাদের পদের অপব্যবহার করেন, তখন তারা সমাজের জন্য অনিয়ন্ত্রিত হুমকি হয়ে ওঠেন এবং জনগণের প্রতি সরকারের দায়িত্বের বিষয়টি হারিয়ে যায়। দুর্নীতিবিরোধী এই ওয়াচডগ দুর্নীতিতে জড়িত সবার নাম প্রকাশ করে এবং তাদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের জিরো টলারেন্স প্রতিশ্রুতি’ প্রমাণের আহ্বান জানিয়েছে।

ডিএমপির ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে কমিশনার আছাদুজ্জামান প্রায় পাঁচ বছর এ দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে অবসর নেওয়ার পর তিনি আরও তিন বছর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অধীনে জাতীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সেলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

আছাদুজ্জামান দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সময় ডিএমপি প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একটি  হলো গুলশানের হলি আর্টিসান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলা। অন্যটি ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচন, যা ব্যাপক কারচুপির অভিযোগে ‘মধ্যরাতের নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি পায়।

সবচেয়ে ভালো অফিসারদের একজন হিসেবে আছাদুজ্জামান ২০১৭ ও ২০১৯ সালে দুইবার বাংলাদেশ পুলিশ মেডেল (সাহসী) এবং দুইবার রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদক (সাহসিকতা) পান। 

আছাদুজ্জামান ও তার পরিবারের সম্পদ

বাংলা আউটলুকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, আছাদুজ্জামান শুধু নিজের নামেই নয়, তার স্ত্রী আফরোজা জামান এবং তাদের তিন সন্তান আসিফ শাহাদাত, আয়েশা সিদ্দিকা এবং আসিফ মাহদিনের নামেও উল্লেখযোগ্য সম্পদ গড়েছেন।  

গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, ভাঙ্গা মহাসড়ক সংলগ্ন এলাকা এবং বসুন্ধরা, আফতাবনগর, মোহাম্মদপুর, জোয়ার সাহারা, সাভার ও পূর্বাচলসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছাদুজ্জামান পরিবারের সম্পদ (প্লট, ফ্ল্যাট ও জমি) আছে। 

নথি থেকে জানা যায়, আছাদুজ্জামান পূর্বাচলে ৭.৫ কাঠা সরকারি প্লটের মালিক, যার আনুমানিক মূল্য ৮ কোটি টাকা। তার আফতাবনগরে একটি ৬ কাঠার প্লট এবং পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটির মধ্যে একটি ৬.৯ কাঠার প্লট রয়েছে, যার প্রতিটির মূল্য কমপক্ষে সাড়ে ৭ কোটি টাকা করে। ডিএমপির সাবেক এই প্রধানের সাভারে দুই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে যার মূল্য আনুমানিক ২ কোটি টাকা এবং রূপগঞ্জে দুটি প্লট আছে যেগুলোর আনুমানিক মোট মূল্য প্রায় ৯ কোটি টাকা।

যদিও আছাদুজ্জামান তার বোনদের কাছ থেকে উপহার হিসেবে ৩২২ ডেসিমেল জমি পেয়েছেন বলে দাবি করেছেন। তিনি আরও দাবি করেন, বোনদের কাছ থেকে তিনি ২০১১ সালের ৩ নভেম্বর ও ২০১৩ সালের ৩১ অক্টোবর উপহার হিসেবে আরও ৬৮ ও ২১৫ ডেসিমেল জমি পেয়েছেন। তবে তার বোনদের দেওয়া ট্যাক্সের কাগজপত্রের একটি অনুলিপি বাংলা আউটলুকের কাছে এসেছে। সেগুলো দেখে বোঝা যায় আছাদুজ্জামানের বোনদের এত ‘ব্যয়বহুল’ উপহার দেওয়ার মতো আর্থিক অবস্থা ছিল না। 

বেনজীর যেমন স্ত্রীর নামে শত কোটি টাকার সম্পত্তি গড়েছেন, আছাদুজ্জামানও তার স্ত্রী আফরোজা জামানের নামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

নথিপত্র থেকে জানা যায়, আছাদুজ্জামানের স্ত্রী আফরোজা একজন গৃহিণী। তিনি চাকরি বা ব্যবসা করেন এমন কোনো ইতিহাস নেই। তারপরও তার নামে অন্তত ১১৩ কোটি টাকার সম্পত্তি রয়েছে।

অভিজাত বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ১০ কাঠা জমিতে নির্মিত একটি বিলাসবহুল ছয়তলা বাড়ির মালিক আফরোজা। যার আনুমানিক মূল্য ৫০ কোটি টাকার বেশি। এছাড়া তিনি ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেন ও ধানমন্ডি ১২/এ এলাকায় ১৩/এ নম্বর রোডে ৬৯ নম্বরে একটি (বি/২/৫) ফ্ল্যাটের মালিক।

২০১৮ সালে রাজউক বিধিবিধানের সম্ভাব্য লঙ্ঘন হয়ে থাকতে পারে। কারণ বিধি অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রী একসাথে প্লট বরাদ্দ পান না। কিন্তু তাদের ক্ষেত্রে তা হয়েছে। আফরোজাকে পূর্বাচলে ১০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের একটি ১০ কাঠার প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকার গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার চাঁদখলা মৌজায় আফরোজার ৪১ ডেসিমেল জমি রয়েছে, যা ২০১৭ সালে কেনা হয়েছিল (ডিড নং ৯৯৯৮/১৭)। একই বছর একই মৌজায় (ডিড নং ১০৪৭২/১৭) তার নামে একটি ২৬ ডেসিমেল জমি ক্রয় করা হয়। দুই বছর পর একই মৌজায় (ডিড নং ১১২৮) তার নামে আরও ৩৯ ডেসিমেল জমি ক্রয় করা হয়।

২০২০ সালে জোয়ার সাহারা মৌজায় আফরোজার নামে ৫ কাঠা জমি কেনা হয় (ডিড নং ৫২৩২/২০)। একই বছর একই মৌজায় (ডিড নং ৯৬৯৫) আরও ১০ কাঠা জমি কেনা হয় এবং তার উপর একটি ৬ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়।

২০১৮ সালে আফরোজা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের কাইয়ামসির-কায়েতপাড়া মৌজায় দুটি জমি কিনেছিলেন। একটি ০.২৮ একর (ডিড নং ১৩১৯০/১৮) এবং একটি ৩২ ডেসিমেল (ডিড নং ১৩১৮৯/১৮)।

সন্তানদের নামে ক্রয়কৃত সম্পদ

ডিএমপির সাবেক কমিশনার তার তিন সন্তানের নামে প্রায় ৭০ কোটি টাকার সম্পদ কিনেছেন বলে বাংলা আউটলুক জানতে পেরেছে।

আছাদুজ্জামানের ৩২ বছর বয়সী মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা ঢাকার ৫৬/৫৭ সিদ্ধেশ্বরী রোডে রূপাল স্বপ্ন নিলয় ভবনে ৪ হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাটের মালিক। মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় তার একটি জমি রয়েছে। তার অন্যান্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে ঢাকার মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর মৌজায় একটি ৫ কাঠার প্লট এবং পূর্বাচলের ১ নং সেক্টরের ৪০৬/বি রোডে একটি ১০ কাঠার প্লট।

বড় ছেলে আসিফ শাহাদাতের নামেও বেশকিছু প্লট, ফ্ল্যাট ও জমি রয়েছে। তার সম্পদের মধ্যে রয়েছে ফরিদপুরে ১.৬৫ একর জমি, যার মূল্য সর্বনিম্ন ১ কোটি টাকা। এছাড়া পূর্বাচল নিউ টাউন, আফতাবনগর ও রূপগঞ্জের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বিভিন্ন সম্পত্তি রয়েছে। এসবের আনুমানিক মোট মূল্য ২০ কোটি টাকার বেশি।

আছাদুজ্জামানের ছোট ছেলে আসিফ মাহদিন বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করছেন। তার নামেও রাজধানীর নিকুঞ্জ আবাসিক এলাকায় একটি বিলাসবহুল ট্রিপলেক্স (৮/এ, রোড নং ৬) রয়েছে। যার মূল্য কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা।

ডিএমপির সাবেক এই কমিশনার তার শ্যালক ও ভাতিজার নামেও সম্পদ রেখেছেন।

আছাদুজ্জামানের শ্যালক নুর আলম ওরফে মিলন কোনোদিন চাকরি করেননি, বেকার ছিলেন। তার আয়ের উৎসও নেই। তার নামেও গাজীপুরের শ্রীপুরে দেড় একর জমি আছে, যার আনুমানিক মূল্য ২ কোটি টাকার বেশি। আছাদুজ্জামানের ভাগ্নে কালাম গাজীপুরে দেড় একর জমির মালিক, যার আনুমানিক মূল্য এক কোটি টাকা।

ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গা উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের কামারগ্রামে আছাদুজ্জামানের গ্রামের বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক হলেন ইব্রাহিম শেখ। বিশ্বস্ত এই তত্ত্বাবধায়কের নামেও দুটি দামি সম্পত্তি রয়েছে। তার নামে গাজীপুর এলাকায় ১০০ ও ৬০ ডেসিমেল জমি রয়েছে, যেগুলোর আনুমানিক মূল্য ৩ কোটি টাকার বেশি।

উপরে উল্লিখিত ব্যক্তিদের ট্যাক্স রেকর্ডের কপি বাংলা আউটলুকের কাছে এসেছে। তাতে এই ধরনের সম্পদ কেনার ক্ষেত্রে সঠিক কোনো আয়ের উৎস উল্লেখ করতে পারেননি তারা।

এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য যোগাযোগ করা হলে আছাদুজ্জামান মিয়া বাংলা আউটলুককে বলেন, তার সম্পদ কোনো অবৈধ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে কেনা হয়নি। তার সমস্ত সম্পদ সঠিকভাবে নথিভুক্ত করা হয়েছে এবং কর পরিশোধ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমার বাবার সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হওয়ায় আমি উত্তরাধিকার সূত্রে ১০০ বিঘার বেশি জমি পেয়েছি। আমি এই জমি থেকে আনুমানিক ১০ বিঘার মতো বিক্রি করেছি। সেই টাকা দিয়ে সম্পদ কিনেছি। ‘ 

ডিএমপির এই সাবেক কমিশনার চ্যালেঞ্জ করেন, তার পরিবারের আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় এমন সম্পত্তি কেউ পারলে খুঁজে বের করুক।

Logo

প্রধান কার্যালয়: ৬০৯০ ডাউসন বুলেভার্ড, নরক্রস, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র।

ই-মেইল: [email protected]

অনুসরণ করুন