সেন্টমার্টিন লক্ষ্য করে গুলির নেপথ্যে নানা সমীকরণ
বাংলাদেশ কি রাখাইনে স্বার্থ হারাচ্ছে?
ছবি: সংগৃহীত
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহী আরাকান আর্মির দক্ষিণে অগ্রসরে, একের পর এক সামরিক ঘাটি দখল, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ভাগ্য কিছুটা পরিবর্তন হবে এমনটা আশা থাকলেও তা এখন পুরোপুরি অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নিধনের অভিযোগ এসেছে যা আরাকান আর্মি বা তাদের রাজনৈতিক দল ইউনাইটেড লীগ অব আরাকানের পক্ষ থেকে অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু নাফ নদীর ওপারে আরাকান আর্মির দখল নেওয়ার পর সেখান থেকে তিন দফায় বাংলাদেশের নৌযানকে লক্ষ্য করে গুলি আসা বাংলাদেশের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে।
কয়েক দফা গুলির ঘটনায় টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের মধ্যে যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি সেখানে খাবার সরবরাহের সংকট দেখা দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান বলছিলেন, ‘আমরা কার্যত বিচ্ছিন্ন। জেলা প্রশাসক আমাদের খাবার পাঠানোর আশ্বাস দিয়েছেন।’
কারা গুলি চালাচ্ছে—এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘আমরা নিশ্চিত নই, কারা গুলি চালাচ্ছেন। তবে জলযানকে উদ্দেশ্য করে গুলি চালানো হয়েছে। মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। আমরা সরকারি দলের লোক সব কথা বলতে পারছি না।’
গতকাল মঙ্গলবার (১১জুন) বেলা ১১টার দিকে সেন্টমার্টিনগামী ট্রলার ও স্পিডবোট লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছে। এতে কেউ হতাহত হয়নি। তবে শঙ্কা বেড়েছে। সেন্টমার্টিনগামী স্পিডবোটের চালক মো. বেলাল বলেন, ‘টেকনাফে চিকিৎসা নিতে আসা লোকদের নিয়ে সেন্টমার্টিনে যাচ্ছিলাম। এ সময় পৃথক আরও দুটি ট্রলার ও একটি স্পিডবোট আমাদের সামনে পেছনে ছিল। আমরা মিয়ানমারের নাইক্ষ্যংদিয়া সংলগ্ন নাফ নদী অতিক্রম করার সময় অতর্কিতে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়া হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে ঝুঁকি নিয়ে স্পিডবোটের গতি বাড়িয়ে ওই এলাকা পার হই।’
গত ৫ জুন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে সেন্টমার্টিনে স্থগিত কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ শেষে টেকনাফ ফেরার পথে নির্বাচনী কর্মকর্তা ও সরঞ্জাম বহনকারী কোস্টগার্ডের স্পিডবোট লক্ষ্য করে প্রায় ২০ রাউন্ড গুলি চালানো হয়। স্পিডবোটটিতে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), নির্বাচন কর্মকর্তা ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ছাড়াও প্রশাসনের লোকজন ছিলেন। এরপর থেকে বন্ধ টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুটের যোগাযোগ।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের মিয়ানমার উইংয়ের মহাপরিচালক মিয়া মোহাম্মদ মাইনুল কবির জানান, কারা গুলি চালাচ্ছে সে বিষয়ে তারা নিশ্চিত নন। তবে ইতোমধ্যে তারা মিয়ানমারের কর্তৃপক্ষকে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আমরা বিষয়টি নিয়ে কাজ করছি। আশা করছি সমাধান হয়ে যাবে।’
এছাড়া রোহিঙ্গাদের প্রতি ইতোমধ্যে যে ধরনের নির্যাতনের বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে, তাতে আপাতত বোঝা যাচ্ছে রোহিঙ্গা ও রাখাইন জনগোষ্ঠীর মধ্যে মানসিক দূরত্ব আরও বাড়তে শুরু করেছে।
রোহিঙ্গাদের পক্ষে এখন বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অবস্থান নিয়েছে। গত মে মাসের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলার ঘোষণা দেন, আরাকান আর্মি ও জান্তা সরকারের মধ্যকার সংঘাতের কারণে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা ও বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনায় তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের হাউস ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সভাপতি গ্রেগরি মিক্স ও সিনেটর জেফ মার্কলি এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, ‘মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির দ্বারা রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চলছে, আমরা চুপ করে বসে থাকতে পারি না।’
তারা বলেন, রোহিঙ্গারা আবারো নির্যাতন ও বাস্তবচ্যুতির সংকটে। আমাদের অবশ্যই রোহিঙ্গাদের এ সমস্যা দূর করতে কাজ করা প্রয়োজন।
পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের নির্যাতনে আরাকান আর্মিকে ইঙ্গিত করলেও আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে না।
কিছুদিন আগেও বাংলাদেশ মানবিক কারণে যুদ্ধাহত আরাকান আর্মির সদস্যদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে রোহিঙ্গাদের পক্ষে দাঁড়ানোর পাশাপাশি আরাকান আর্মির প্রতি মানবিক সহায়তা বাংলাদেশকে ভবিষ্যৎ রাখাইনে কিছুটা শক্তি দেবে এমনটা প্রত্যাশা করা হয়েছিল। তবে এখন বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত নিয়ে কাজ করা বাংলাদেশি কর্মকর্তারাদের মাঝে কিছুটা হতাশা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এছাড়া রোহিঙ্গারা রাখাইনের ভেতরে যে উভয় সংকটে পড়েছে তা এখন কার্যত দৃশ্যমান।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব কারো সাথে বৈরিতা নয়’ -এমন কথিত রাষ্ট্রনীতির আলোকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা দেওয়া থেকে নিজেদেরকেই বিরত রেখেছে। তবে বাংলাদেশ সরকারের এমন ‘সুবিধাবাদী’ অবস্থান রোহিঙ্গাদেরকে দুর্বল করে দিয়েছে। তাছাড়া বাংলাদেশের শক্ত অবস্থানের অভাবে ভবিষ্যতের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অকার্যকর হয়ে উঠতে পারে। বহির্বিশ্বের রোহিঙ্গারা তাদের রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। তারা রাখাইনে তাদের নিজ গ্রামে ফেরত যাওয়া, সমাধিকার এবং নাগরিকত্বের অধিকার নিশ্চিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
রাখাইনে বাংলাদেশ কি তার স্বার্থ হারাচ্ছে?
বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সংঘাত নিরসনে কাজ করেছেন এমন একজন প্রবাসী গবেষক বাংলা আউটলুককে বলেন, শুরু থেকে তাদের প্রচেষ্টা ছিল রোহিঙ্গা ও রাখাইন জনগোষ্ঠীর যুগের পর যুগ চলে আসা অবিশ্বাস আর ঘৃণাকে কমিয়ে এনে আরাকান আর্মি নেতৃত্বাধীন রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য সমমর্যাদার অবস্থান সৃষ্টি করা, যাতে বাংলাদেশের স্বার্থ অর্জিত হয়।
দেশে ও বিদেশে থাকা রোহিঙ্গারা সে কারণে বরাবরই আরাকান আর্মির সঙ্গে সুসম্পর্কের মধ্য দিয়ে রাখাইনে তাদের নিজ ভূমিতে ফিরে গিয়ে সমমর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারে।
তিনি জানান, আরকান আর্মির পক্ষ থেকে সাড়া না মিললে, রোহিঙ্গাদের চার দশকের পুরোনো রাজনৈতিক ও সামরিক সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন বা আরএসও নতুন করে তাদের অবস্থান জানান দিতে থাকে।
রোহিঙ্গা শিবিরের নেতারা বলছেন, ২০২২ সালের শেষের দিক থেকে আরএসও তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখে। তবে রোহিঙ্গা শিবিরের অভ্যন্তরে তাদের সংঘাত শুরু হয় আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির সঙ্গে।
এসব সংঘাতে অন্তত ৭০ জনের অধিক আরসা ও আরএসও সদস্য নিহত হবার খবর পাওয়া গেছে। আর র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বলছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে তারা ১১২ জন আরসা সদস্যকে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে আটক করেছে। রোহিঙ্গা শিবিরে সমর্থন বাড়ানোর পাশাপাশি রাখাইনেও রোহিঙ্গা সংগঠনগুলো তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।
আরএসও’র সামরিক নেতা মাস্টার আইয়ুব খানসহ অন্যান্যরা দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে সংগঠনকে গুছিয়ে এনেছেন। এ ব্যাপারে জানতে আরএসও নেতা বা আইয়ুবের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে কয়েক মাস আগে যমুনা টেলিভিশনে সাক্ষাৎকারে তারা নিজেদের সামর্থ্য প্রদর্শন করেন এবং তাদের নিজ ভূমি পুনরুদ্ধারে সশস্ত্র আন্দোলন জোরদার করার ঘোষণা দেন।
অবিশ্বাস আরো ঘনীভূত!
আরএসও নেতাদের সশস্ত্র সাক্ষাৎকার আরাকান আর্মির নেতৃত্বকে কিছুটা সংকটে ফেলে দেয়। এ বিষয়ে কাজ করা প্রবাসী গবেষক বলছেন, আরাকান আর্মি নেতৃত্ব মনে করে এক দেশে দুই আর্মি হতে পারে না।
তিনি বলেন, ‘আমরা বলার চেষ্টা করেছিলাম রাখাইন তো কোন স্বাধীন দেশ নয় আর সেখানে রোহিঙ্গাদের হিস্যা বুঝে নেওয়ার বিষয় রয়েছে।’
তার মতে, আরাকান আর্মির সাথে সংঘাতে পর মিয়ানমার জনতার রেখে যাওয়া ১৩টি গ্রামে রোহিঙ্গারা তাদের অবস্থান নিতে গেলে রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্যে মানসিক সংকট বৃদ্ধি পায়।
এদিকে, জান্তা সরকার যেভাবে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদেরকে বাধ্যতামূলকভাবে সৈনিক হিসেবে সংগ্রহ করেছে, তাতে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়তে থাকে।
রোহিঙ্গা ও রাখাইন নিয়ে কাজ করা এমন একজন বাংলাদেশি কর্মকর্তাও বলেছেন, ‘গত এপ্রিলে আরএসও নেতা আইয়ুবের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হওয়ার পর সংকট আরও গভীর হয়।’
ইউনাইটেড লিবারেশন অব আরাকানের (ইউএলএ) এক নেতা যিনি নিজেকে জন রুথ হিসেবে পরিচয় দেন। তিনি বাংলা আউটলুককে বলেন, ‘আমরা আরএসও’র সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেয়েছি। আমরা তাদের বোঝাতে চেয়েছি, জান্তা সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের উভয়েরই শত্রু। রোহিঙ্গা যুবকরা যখন মিয়ানমার সেনাবাহিনীতে যোগদান করছে, তারা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। সেখানে আমাদের করণীয় কেবলমাত্র তাদের প্রতিহত করা। আর যুদ্ধ যখন চলে, তখন হতাহতের ঘটনা ঘটবেই।’
তিনি জানান, মিয়ানমার জান্তা রোহিঙ্গাদের সাথে প্রতারণা করছে তাদেরকে ভাঙাচোরা পুরোনো অস্ত্র দিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে। এতে করে ভবিষ্যতে রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে সংকট আরো গভীর হয়ে উঠবে।
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা আমাদের ভাই, আমরা চাই জান্তার বিরুদ্ধে এ যুদ্ধে আমরা একই সাথে লড়াই করি। কিন্তু তা হচ্ছে না।’
তাই বলে কি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গুলি চালাবেন? -এমন প্রশ্ন করা হলে ইউএলএ নেতা জন রুথ বলেন, ‘আমরা গুলি চালাচ্ছি তো আর্মির বিরুদ্ধে। বাংলাদেশকে ক্ষতি করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়।’
সংকট কি এখানেই সীমাবদ্ধ?
বাংলাদেশে রাখাইন জনগোষ্ঠীর বসবাস অনেক পুরেনো। ঢাকা, কক্সবাজার ও পটুয়াখালীতে তাদের জনগোষ্ঠী বসবাস করছে।
স্থানীয়ভাবে কটাক্ষ করে তাদের মগ নামেও ডাকা হয়। রাখাইন জনগোষ্ঠীর এক আওয়ামী লীগ নেত্রী কিছুদিন আগে জানান, তারা বাংলাদেশের সাথে রাখাইনের সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহী। তবে সংকট রয়েছে। গত মে মাসের ২০ তারিখে কক্সবাজার সিটি কলেজে রাখাইন জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশি একজন শিক্ষককে আটক ও কিছু কম্পিউটার জব্দ করা নিয়ে সম্পর্কে কিছুটা তিক্ততা আসে।
কক্সবাজার অবস্থানরত রাখাইন আরেক নেতা অবশ্য জানান, পরিস্থিতি এখন ভালো।
বাংলাদেশ কী পেল?
মিয়ানমারের বাংলাদেশ দূতাবাসে সামরিক অ্যাটাশে হিসেবে কাজ করেছেন শহিদুল হক। পরে মেজর জেনারেল হিসেবে অবসরে যান। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের সবচেয়ে শান্ত সীমান্ত ছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার নিজের অবস্থানগত কারণে এখানে এমন কিছু করেনি যাতে করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে এই সীমান্তে বাড়তি ক্ষমতা প্রদশর্ন করতে হয়। এর বিনিময়ে বাংলাদেশ কী পেয়েছে? দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তাহলে বাংলাদেশের লাভটা কী হলো?’
তিনি মনে করেন, বাংলাদেশের সামরিক ও কূটনৈতিক অবস্থান আরও পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। আরাকান আর্মিকে স্পষ্ট মেসেজ দেওয়া প্রয়োজন। সামনে যে অবস্থার মধ্য দিয়ে রাখাইনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তাতে বাংলাদেশ যেন ঠকে না যায়।
তার মতে, আরাকান আর্মি এবং মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্কের জন্য নিজস্ব স্বাধীন কৌশল প্রণয়ন করা প্রয়োজন। অন্যথায় এখানে প্রশ্ন আসবে, রাখাইনে বাংলাদেশ কি তার স্বার্থ হারাচ্ছে?
অস্ত্রগ্রহণই কি রোহিঙ্গাদের শেষ ভরসা?
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বাংলা আউটলুককে বলছেন, বাংলাদেশ সরকার কেবল ‘চোখ বুজে’ থাকলে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র আন্দোলন গড়ে তুলে রাখাইনে তাদের ভূমি ফেরত পাওয়ার সংগ্রাম শুরু করতে ছয় মাসের প্রয়োজন। রোহিঙ্গা শিবিরে ও বিদেশে প্রশিক্ষিত যোদ্ধা রয়েছে। তবে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে রোহিঙ্গারা কেমন সিদ্ধান্ত নেবে, ভবিষ্যতে তা দেখার বিষয়।
গত এক দশকে, রোহিঙ্গাদের সরাসরি অস্ত্র প্রদান করে বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে যুদ্ধে আগ্রহী প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা মনে করেন, ১০ লাখ ভিনদেশী জনগণের জন্য দেশের ১৮ কোটি মানুষের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করার অবস্থা বাংলাদেশের নেই। আবার বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর এমন প্রস্তুতি আছে কিনা সেটাও প্রশ্ন। বাংলাদেশ কেবল মানবিক একটি সংকটে ভূমিকা পালন করেছে।
তবে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল শহিদুল হক বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করছেন ভিন্নভাবে। তিনি বলেন, ‘এখানে একটা বিষয় বোঝা খুবই প্রয়োজন যে, বাংলাদেশ চুপ করে বসে থাকলে ভারত, চীন কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো রাষ্ট্রগুলো এখান থেকে তাদের ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টি সরিয়ে নেবে না। আরাকান আর্মির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বহুল অংশে নির্ভর করছে বাংলাদেশের সাথে তাদের সম্পর্ক ও আস্থার ওপর। ’
তিনি অবশ্য মনে করেন, এ সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন দেশের সাথে যেমন আস্থা প্রয়োজন। তেমনি দরকার সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কার্যকরী সমন্বয়।
তিনি মনে করেন, রোহিঙ্গাদের সার্বজনীন রাজনৈতিক নেতৃত্ব সুসংগঠিত হওয়া প্রয়োজন। আর সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা শিবির, রাখাইন ও বিভিন্ন দেশে থাকা রোহিঙ্গাদের সমন্বয় জরুরি। আর রাজনৈতিক নেতৃত্ব সার্বজনীন হলেই বাংলাদেশের উচিত ১৯৭৮ সালের মতো রোহিঙ্গাদেরকে অস্ত্র প্রদানের ঘোষণা দেওয়া।
সরকার কী ভাবছে?
সরকার কী ভাবছে এ বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পাওয়াটা বেশ জটিল। অতীতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল শহিদুল হক মনে করেন, একটা সমন্বিত ব্যবস্থা এ বিষয়ে থাকা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন কর্মকর্তারা বলছেন, এটা মনে রাখার প্রয়োজন যে যুদ্ধটি এখন চলছে তা এখনো গণযুদ্ধ নয়। এটা কেবলই একটি গোষ্ঠীর যুদ্ধ এবং তারা হলো রাখাইন।
কর্মকর্তারা বলছেন, এটা মনে রাখার প্রয়োজন সেখানে আরও সংখ্যালঘু গোষ্ঠী রয়েছে। দেখতে হবে, মিয়ানমারে বামাররা যেমন অন্য জাতি গোষ্ঠীর উপরে প্রভাব বিস্তার করেছে, রাখাইনরা কি একই পথে এগোচ্ছে কিনা?
‘আমরা জানতে পেরেছি, মিয়ানমারের অন্যান্য জাতি গোষ্ঠী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী আরাকান আর্মির বিষয়ে খুব একটা খুশি নয়,’ বলছিলেন একজন কর্মকর্তা। একই সঙ্গে আরাকান আর্মির কাছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সহায়তার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের যে প্রত্যাশা তা এখন অস্পষ্ট।
তিনি মনে করেন, আরাকান আর্মি বা তাদের নেতৃত্ব যত সহজে ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করবে, তা ধরে রাখা তাদের জন্য ততটাই কঠিন। তবে আরাকান আর্মির সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে তাতে ভিন্ন রূপ আসতে পারে। এখানে বড় দুটো সংকট হলো আরাকান আর্মির রাজনৈতিক নেতৃত্ব ইউএলএর সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দল, বিশেষত, এএলপি বা আরাকান লিবারেশন পার্টির সম্পর্ক কী দাঁড়ায়। একই সঙ্গে আরাকান আর্মির নেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর যে অবিশ্বাসের সম্পর্ক রয়েছে তা কী রূপে প্রকাশিত হয়।