সিলভার ফুডসের ১৮ কোটি টাকার প্রকল্পে ইসলামী ব্যাংকের হাজার কোটির ঋণ!
মঙ্গলবার তোলা ছবি
চট্টগ্রামের বড় বিনিয়োগগুলোর মধ্যে সর্বশেষ এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ইসলামী ব্যাংক আন্দরকিল্লা শাখা। সিলভার ফুড ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি আটা-ময়দার কারখানায় এই ঋণ দেওয়া হয়েছে। ব্যাংকটির ঋণ মঞ্জুরি পত্রে, কোম্পানিটির চেয়ারম্যান হিসেবে মো. মামুনুর রশিদ ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মেহেদি হাসান নামের দুই ব্যক্তির নাম রয়েছে। অনুমোদিত এক হাজার কোটি টাকার মধ্যে ৬ এপ্রিল ২০২৩ থেকে ১৫ মে ২০২৩ পর্যন্ত দেড় মাসে বাই মুরাবাহা (ব্যাংকের জিম্মায় পণ্য সংরক্ষণ করে ব্যবসা পরিচালনা) ক্যাটাগরিতে ৮৫০ কোটি টাকা ঋণ ছাড় দিয়েছে। বাকি ১৫০ কোটি টাকা নন ফান্ডেড বিনিয়োগ সীমা। বিনিয়োগকৃত ৮৫০ কোটি টাকা বর্তমানে সুদাসলে দাঁড়িয়েছে ৯২৬ কোটি ৫৫ লাখ টাকা।
সিলভার ফুডসের ঠিকানা বলে উল্লেখ রয়েছে চট্টগ্রামে খাতুনগঞ্জের ৩৪৭ জিলানী টাওয়ার। কিন্তু খাতুনগঞ্জে লোক পাঠিয়ে ও বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে এই ঠিকানায় প্রতিষ্ঠানটির কোনো অস্তিত্ব মিলেনি। পরে হামিদুল্লাহ মিয়া মসজিদের পাশের একটি ভবনে সিলভার ফুডসের পুরোনো একটি সাইনবোর্ড দেখতে পেয়ে ভবনটিতে গিয়ে দেখা যায়- চতুর্থ তলায় গ্লাস আটকানো একটি কার্যালয়। গ্লাস দিয়ে ভেতরে মাকড়সার জাল দেখা যাচ্ছে।
ভবনটির নিচে পেয়াঁজের আড়তের এক কর্মচারী জানান, চার তলার এই কার্যালয়টি প্রায় সময় বন্ধই থাকে। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদের বাড়ি পটিয়া পৌরসভার সৈয়দ মাস্টার বাড়ি এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেহেদির স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে ঢাকার সবুজবাগে ।
মামুনুর রশিদের এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, মামুনুর রশিদ দীর্ঘদিন সৌদি আরব ছিলেন। গত ১২-১৪ বছর আগে দেশে ফিরলেও উল্লেখযোগ্য কোনো ব্যবসায় নেই। এক সময় পটিয়া স্টেশনে ফিস ফিড ও বাইপাস সড়কে চায়ের দোকান করলেও দুই-তিন বছর ধরে এসব বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে তিনি এলাকায় কয়েকটি ব্যাটারিচালিত রিকশা, টমটম, মাহিন্দ্রা ও সিএনজি ভাড়া দিয়ে সংসার চালাচ্ছেন। তবে সম্প্রতি এস আলম গ্রুপের জমির দালালি করছেন বলে এলাকার মানুষের কাছে গুঞ্জন রয়েছে।
প্রসঙ্গত, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল ইসলাম মাসুদও পটিয়া এলাকার।
হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা পেলেও এই মামুনুর রশিদ এবং সিলভার ফুডসকে চেনেন না খাতুনগঞ্জের কোনো ব্যবসায়ী। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির দুই কর্ণধারের টিআইএন নিবন্ধন হয়েছে ২০২৩ সালের ৩ এপ্রিলে। কিন্তু এর ৫ মাস আগেই ২০২২ সালের ৭ নভেম্বর তাদের হাজার কোটি ঋণ অনুমোদন দেয় ইসলামী ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানটির নেচার অব বিজনেস হিসেবে- আটা-ময়দা ও সুজি ম্যানুফ্যাকচারিং এবং ট্রেডিংয়ের কথা উল্লেখ রয়েছে। কারখানার ঠিকানা নগরীর সাগরিকার বিসিক শিল্প এলাকার এ ব্লকের প্লট এ-৫ ও এ-৬। কারখানা এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে যায়, সিলভার ফুডস আটা-ময়দা প্রক্রিয়াজাত করণের একটি রুগ্ণ কারখানা।
২০২২ সালের মাঝামাঝি সময়ে মাত্র ১৮ কোটি টাকায় কারখানাটি বিক্রি করেছেন পূর্বের মালিক ফরিদ আহমেদ। কারখানাটির পূর্বের মালিকপক্ষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সিলভার ফুডস ইন্ডাস্ট্রিজের যেই ক্যাপাসিটি তাতে দিনে গড়ে সর্বোচ্চ ১৬০ টন আটা-ময়দা-সুজি উৎপাদন সম্ভব।
আটা-ময়দার কারখানার সাথে জড়িত ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, এই ক্যাপাসিটির একটি কারখানায় লোকাল মার্কেট থেকে গম কিনে আটা-ময়দা উৎপাদন করতে সর্বোচ্চ ৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রয়োজন। যেখানে ইসলামী ব্যাংক বিনিয়োগ করেছে এক হাজার কোটি টাকা। এমনকি সিলভার ফুডসের নামে ব্যাংকটির শাখায় কোনো পণ্য আমদানির রেকর্ড নেই।
এদিকে ঋণের বিপরীতে কারখানার ভবন কাম গোডাউনসহ ২২ হাজার ২৯০ বর্গফুটের দুটি প্লট, ঢাকার নারায়নগঞ্জের ৮৮৮ শতক জমি ও প্রজেক্ট মেশিনারিজ কোলাটারেল হিসেবে দেখানো হয়েছে। যার সর্বোচ্চ ভ্যালু দেখানো হয়েছে ১০৯ কোটি টাকা।
গত বুধবার ফোনে ক্রেতা সেজে কোম্পানির চেয়ারম্যান মামুনুর রশিদের কাছে জানতে চাওয়া হয়, তাদের কাছে আটা-ময়দা আছে কি না এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের নাম কি? উত্তরে মামুন বলেন, কোম্পানির নাম-টাম এসব আমি কিছুই জানি না। এগুলোর জন্য আলাদা মানুষ আছে। কথা না বাড়িয়ে তিনি ফোন কেটে দেন।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন 'এসব বিষয়ে বিস্তারিত বলার এখতিয়ার আমাদের নেই। বিস্তারিত জানতে আমাদের হেড অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন। কারণ তাদের অনুমোদন ব্যতীত এসব ঋণ বিতরণ হওয়াই সম্ভব না।
দেশের সর্ববৃহৎ ইসলামী ব্যাংকসহ সাতটি ব্যাংকের ওপর এস আলম গ্রুপের নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের মতো নজির বিশ্বের কোথাও নেই। দেশের প্রতিযোগিতামূলক আইন অনুযায়ী এই বিষয়ে সরকার হস্তক্ষেপ করার কথা। কিন্তু সরকার তা করছে না। এর মধ্যেই অস্তিত্বহীন কিংবা নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠানকে হাজার কোটি ঋণ দেয়ার মাধ্যমে ব্যাংকটির টাকার হরিলুট চলছেই।