ঘূর্ণিঝড় রেমালের অগ্রভাগ গত রোববার বিকেলে পর উপকূল অতিক্রম শুরু করে। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্টি হওয়া এই ঘূর্ণিঝড় রেমাল উপকূলে আঘাত হানার পর থেকে প্রায় ৫০ ঘণ্টা পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ কেন এত দীর্ঘস্থায়ী হলো এই রেমালের তাণ্ডব?
আবহাওয়াবিদ ও বিশ্লেষকরাও সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন। গত প্রায় ১০০ বছরে ঘূর্ণিঝড় নিয়ে গবেষণার রিপোর্টের কথা উল্লেখ করে গবেষকরা বলছেন, ৬০-এর দশক পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড়গুলো ভূমিতে আঘাত হানার পর ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত শক্তিক্ষয় হতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই গতি-প্রকৃতি বদলানোর কারণ এখন ঘূর্ণিঝড় ভূমিতে আঘাতের পর শক্তিমাত্রা আর আগের মতো কমছে না।
জাপানের ওকিনাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার বরাত দিয়ে আবহাওয়াবিদ ও গবেষক আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ৬০-এর দশক পর্যন্ত যেখানে ঘূর্ণিঝড়গুলো ভূমিতে আঘাত হানার পর ৭৫ শতাংশ শক্তি ক্ষয়ে যেত এখন সেখানে শক্তিক্ষয় হচ্ছে ৫০ শতাংশ। যে কারণে ভূমিতে আঘাতের পরও অনেক সময় ধরে তাণ্ডব চালাচ্ছে সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়গুলো।
এক্ষেত্রে, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ আরো কিছু কারণ আমলে নিয়ে এ বিষয়ে নতুন করে গবেষণার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্লেষকরা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেনসিং অ্যান্ড জিআইএসএর পরিচালক অধ্যাপক ড. শেখ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, হিমালয়, ভারতীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরসহ এই বেল্টে যে প্রেশার সিস্টেম এবং বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ নানা কারণে ঝড়ের গতি-প্রকৃতি পরিবর্তন হওয়ায় ঝড়ের আচরণ এমন হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রেজওয়ান হোসেন ভুঁইয়া বলেন, ‘মূলত এই ধীর গতির কারণেই এতক্ষণ ধরে রেমালের প্রভাব রয়েছে।’
দীর্ঘস্থায়ী রেমালের ধীর তাণ্ডব
গত ২২ মে পূর্ব-মধ্য বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন পশ্চিম-মধ্য বঙ্গোপসাগর এলাকায় সৃষ্ট লঘুচাপটি ধীরে ধীরে শক্তি সঞ্চয় করে সুস্পষ্ট লঘুচাপ, নিম্নচাপ ও গভীর নিম্নচাপ হিসেবে অবস্থান করছিল। গত শনিবার সন্ধ্যায় গভীর নিম্নচাপটি পরিণত হয় ঘূর্ণিঝড় রেমালে। পরদিন রোববার সকালে ঘূর্ণিঝড়টি পরিণত হয় প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে। ওই দিন বিকেলে ঘূর্ণিঝড়ের অগ্রভাগ স্থলভাগ স্পর্শ করে বাংলাদেশ উপকূল।
আবহাওয়া অধিদফতর বলেছে, রেমাল উপকূলে স্পর্শ করা থেকে শুরু করে নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার পরও প্রায় ৫০ ঘণ্টা বাংলাদেশে ছিল। এর প্রভাবে ভারী বৃষ্টি ও ঝড়ো বাতাস বয়ে গেছে। শক্তি অনেকটা কম হলেও নিম্নচাপ আকারে মঙ্গলবার বিকেল পর্যন্ত এটি ছিল সিলেট অঞ্চলে।
রেমাল সিভিয়ার সাইক্লোন ছিল না। এটি ছিল মধ্যম মানের একটি ঝড়। কিন্তু তারপরও এর এত দীর্ঘ স্থায়িত্বকাল দেখে অনেকেই অবাক হয়েছেন। গবেষকরা বলছেন, সাধারণত সাগরে নিম্নচাপ তৈরির পর ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে আঘাত হানতে দুই থেকে তিন দিন সময় লাগে। কিন্তু শুরু থেকেই এই প্রক্রিয়া অন্তত পাঁচ দিন সময় নিয়েছে।
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ষাটের দশকের বাংলাদেশ ভারত কিংবা মিয়ানমার অঞ্চলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড়গুলোর তুলনায় পরবর্তী ঘূর্ণিঝড়গুলো ধীরে ধীরে শক্তি বাড়াচ্ছে এবং উপকূলে আঘাত হেনেই দুর্বল না হয়ে শক্তি ধরে রেখে তাণ্ডব চালাচ্ছে।
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ৬০-এর দশকের চেয়ে অন্তত ২৫ শতাংশ বেশি শক্তিমাত্রা বর্তমান ঝড়গুলোর। যে কারণে প্রভাব ও স্থায়িত্বকালও বেশি। সে কারণে ক্ষয়-ক্ষতিও বেশি। মধ্যম মানের এই ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে ৫০ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে থাকায় ক্ষয়ক্ষতিও বেশি হয়েছে।
গবেষক ড. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘টোটাল প্রক্রিয়ার মধ্যে বিশাল একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। এই যে ঝড়টা কেন এমন হলো, এটা গবেষণা ছাড়া লোকাল ফেনোমেনা দিয়ে বোঝা সম্ভব না।’
সাম্প্রতিক সময়ের দীর্ঘস্থায়ী ঝড়
গভীর নিম্নচাপ থেকে ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হয়ে রেমাল যখন উপকূলের দিকে এগোচ্ছিল তখন এর গতি ছিল ১৫ থেকে ১৭ কিলোমিটার। উপকূলের ঠিক কাছাকাছি এসে এটি আরো ধীর গতিতে আগানো শুরু করে। আঘাত হানার আগে এর গতিবেগ ছিল মাত্র ৫-৭ কিলোমিটার।
আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, রেমাল উপকূলে আঘাত হানার সময় এর কেন্দ্রে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ উঠেছিল পটুয়াখালীর খেপুপাড়ায়, রাত দেড়টায়। তখন ঘণ্টায় ১১১ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইছিল।
ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির পরিচালক আহমাদুল হক বলেন, ‘বাতাসের উপরের লেভেলের গতির কারণে খুব কাছাকাছি এসে দ্রুত ভূমিতে ল্যান্ডফল হয়েছে। ল্যান্ডফলের পরে এই স্পিডটাই আরো কমে গেছে। এটা তখন আরো কমে ঘণ্টায় তিন-চার কিলোমিটার গতিতে এগিয়েছে।’
এর আগে বাংলাদেশে আঘাত হানা বেশির ভাগ ঘূর্ণিঝড় দুই থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ ভূখণ্ড অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু এই ঝড় কেন এতটা সময় নিলো তা নিয়ে নানা ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. রেজওয়ান হোসেন ভুঁইয়া বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের গতিবেগ একটা বড় কারণ। রেমালের বাতাসের গতিবেগ ১২০-এর নিচে থাকায় এটি খুব দ্রুত বেগে ভূমি অতিক্রম করতে পারেনি।’
আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, ‘অনেকক্ষণ ধরে এক জায়গায় ঝড় থাকার ফলে ঝড়ের সাথে পানি ঢুকেছে। অত্যন্ত ধীর গতিতে এসেছে। তার ওপর এর বাতাসের গতি অত্যন্ত ধীর হয়ে গেছে।’
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেছেন, এই ঝড়টি কেন এত ধীরগতির হলো সেটা ব্যাখ্যা করার জন্য অনেকগুলো সাইক্লোন, তার ডিউরেশন নিয়ে গবেষণা করা প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তনসহ আরো যেসব কারণ
আবহাওয়াবিদরা বলেছেন, ২০০০ সাল থেকে ২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ উপকূলে যে ঘূর্ণিঝড়গুলো আঘাত হানে, সাধারণত দুই থেকে ছয় ঘণ্টার মধ্যে তা স্থল নিম্নচাপ থেকে দুর্বল হয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ড অতিক্রম করে যায়।
কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রেমাল আঘাত হানার পর যে স্থল নিম্নচাপটি তৈরি হয়েছে, তা আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থান করে।
এটি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার যে সব কারণের কথা বলেছেন বিশ্লেষক ও গবেষকরা তার মধ্যে অন্যতম জলবায়ু পরিবর্তন।
জিআইএস বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণগুলোকে বাইরে রেখে ঝড়ের প্রকৃতি বিশ্লেষণের সুযোগ নেই। বৈশ্বিক সিস্টেমে পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ায় এক ধরনের তারতম্য তৈরি হচ্ছে।’
গবেষকরা বলেছেন, সাধারণত নিম্নচাপে পরিণত হওয়ার পর এসব ঝড় একটি এলাকা অতিক্রম করতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু রেমাল একেকটি এলাকায় ৯ থেকে ১০ ঘণ্টার বেশি অবস্থান করেছে। যেটিকে অস্বাভাবিক বলেই মনে করা হচ্ছে।
এটাকে প্রাকৃতিক কারণ হিসেবে দেখছেন ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির আহমাদুল হক। তিনি বলেন, ‘এই ঝড়টির যখন এগোচ্ছিল তখন এর নিজের চলার গতি কমে গিয়েছিল। এর সাথে মৌসুমি বায়ুর একটা প্রভাব আছে। এসব কারণে এই ঝড়টি খুব কম গতিতে এগিয়েছে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে।’
আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে বঙ্গোপসাগরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পাশাপাশি ভূমির তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এ দুইয়ের গড় মিলের কারণে তার শক্তিমাত্রা পাচ্ছে। সে কারণে ভূমিতে ওঠার পর সে অনেকক্ষণ ধরে ভূমিতে থাকতে পারে।’
সূত্র : বিবিসি